ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য বড় বড় মিল মালিকই দায়ী

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য বড় বড় মিল মালিকই দায়ী

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য দেশের বড় বড় চালকল মালিকরাই দায়ী বলে অভিযোগ করেছেন ছোট ছোট চালকল মালিকরা। বড় মিল মালিকরা মৌসুমের শুরুতে কম দামে বেশিরভাগ ধান কিনে মজুদ গড়ে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। এদিকে রাজশাহীতে ডিলারদের একটি অংশ মজুদ গড়ে তুলে চালের বাজারে সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। মজুদদারদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে সাঁড়াশি অভিযান। এছাড়া চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে ঠাকুরগাঁও ও নওগাঁতেও। এদিকে অতিরিক্ত দামে চাল বিক্রি করায় পাবনায় এক চাল ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়েছে। অবৈধভাবে চাল মজুদ রাখায় নাটোরের এক চাল ব্যবসায়ীকে এক বছরের কারাদ- দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় গোডাউন থেকে জব্দ করা হয় ১০০ টন চাল। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের। দফায় দফায় চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ চালকল সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি কুষ্টিয়ার আব্দুর রশীদ ও বায়জীদ বিশ্বাসের মতো বড় বড় চালকল মালিকরাই দায়ী। তারাই মৌসুমের শুরুতে কম মূল্যে দেশের বেশিরভাগ ধান কিনে মজুদ গড়ে এখন চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। এবার এমন অভিযোগ তুললেন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরের ছোট ছোট চালকল মালিকরা। মঙ্গলবার খাজানগর মোকাম ঘুরে ছোট (হাস্কিং) চালকল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আব্দুর রশীদ ও দৌলতপুরের বায়জীদ বিশ্বাসের মতো বড় বড় চালকল মালিকরা বোরো মৌসুমে ধান কাটা শুরু হলে সারাদেশের মোকাম থেকে লাখ লাখ টন ধান কিনে গুদামজাত করেন। নিজস্ব চালকল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা এসব ধান গুদামজাত করে রাখেন। গত বোরো মৌসুমেও ওই চালকল মালিকরা ব্যাংক ঋণের সুবিধা নিয়ে বিপুল পরিমাণ ধান কিনে গুদামে মজুদ রেখেছেন। মরিয়াম রাইস মিলের মালিক রহিচুল ইসলাম ঝন্টু বলেন, খাজানগরে ছোট-বড় মিলিয়ে ৫শ’ চালকল রয়েছে। তবে এখন চালের ব্যবসা তাদের সবার হাতে নেই। চাল ব্যবসা কুক্ষিগত করে ফেলেছেন অটো চালকল মালিকরা। তিনি বলেন, অটো চালকল মালিকরা চাইলে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ওই টাকায় ইচ্ছামতো কিনে গুদাম ভরেন। এদিকে, খাজানগরে বাংলাদেশ চালকল সমিতির সভাপতি আব্দুর রশীদ ও বায়জীদ বিশ্বাস এ্যাগ্রোফুড চালকলে অভিযানের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ চালের মোকামে চালের দাম কেজিপ্রতি দেড় থেকে দুই টাকা কমেছে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে স্থানীয় খুচরা বাজারে এখনও তার কোন প্রভাব পড়েনি। চালকলে অভিযানের পর থেকে মজুদদার চালকল মালিকদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তানভীর রহমান জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বিভিন্ন রাইস মিলে চাল বা ধানের অতিরিক্ত মজুদ আছে কি-না তা খতিয়ে দেখার জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান। নাটোরে চাল ব্যবসায়ীর এক বছরের কারাদ- অবৈধভাবে চাল মজুদ রাখার অপরাধে নাটোরের লালপুরের গোপালপুরে চান্দু মিয়া নামে এক চাল ব্যবসায়ীকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদ- দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় গোডাউন থেকে জব্দ করা হয় প্রায় ১০০ টন চাল। মঙ্গলবার বিকেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ মর্তুজা খান এ আদেশ দেন। চাল ব্যবসায়ীর জরিমানা পাবনার ভাঙ্গুড়া বাজারের অসাধু চাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুজজামান মঙ্গলবার এ অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে ভাঙ্গুড়া বাজারের বজলুর চাউল ভা-ারকে অতিরিক্ত মূল্য ও প্লাস্টিকের মোড়কে চাল বিক্রির অপরাধে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ঠাকুরগাঁওয়ে চলছে চালবাজি এবার সরকারীভাবে ঠাকুরগাঁওয়ে চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি খাদ্য বিভাগ। লোকসানের অজুহাতে চুক্তিবদ্ধ হয়নি জেলার বেশিরভাগ মিলার। জেলায় এবার ৩৬ হাজার মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু মিলার (চাল সরবরাহকারী) সঙ্কটের কারণে চাল সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকাংশে ব্যর্থ হয়। মিল মালিকরা বলছেন, বাজারে ধান সঙ্কটের কারণে চাল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সরকার এবার ধানের দাম বৃদ্ধি করে সরকারী গুদামে ৩৪ টাকা কেজি দরে চুক্তিবদ্ধ করায় অনেকে লোকসানে পড়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলায় অধিকাংশ মিলে চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। খুচরা ব্যবসায়ী সাদেকুল ইসলাম জানান, তারা মিলগুলোতে চাল কিনতে গিয়ে ব্যাপক মজুদ লক্ষ্য করেছেন। তারা জানান, মিলগুলোতে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করলে চালের বাজার অনেকটা স্বাভাবিক হতে পারে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বৃদ্ধির অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহামুদ হাসান রাজু জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বেড়েছে চালের দাম। এক্ষেত্রে মিল মালিকদের কোন কারসাজি নেই। নওগাঁয় চালের বাজার অস্থির নওগাঁয় চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। গত এক মাসের ব্যবধানে প্রকারভেদে এখানে প্রতি কেজিতে চালের দাম বেড়েছে ১২ থেকে ২০ টাকা। বিদেশ থেকে চাল আমদানি করেও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এদিকে মূল্য বৃদ্ধির জন্য খুচরা ব্যবসায়ী ও প্রান্তিক ক্রেতারা চালকল মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন। আবার চালকল মালিক আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা দায়ী করছেন ভারতের সিন্ডিকেটকে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে খোলা বাজারে চাল বিক্রি শুরু করায় দু’-একদিনের মধ্যে চালের বাজার স্থিতিশীল হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। নওগাঁ অঞ্চলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সোমবার বিকেলে শহরতলীর বেলকোন অটো রাইস মিলের গুদামে অভিযান চালায় জেলা টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্স সূত্র জানায়, বেলকোন গুদামের ধান-চাল বাজারে ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সোমবার থেকে জেলা সদরে ১৪ জন ডিলারের মাধ্যমে ৩০ টাকা কেজি দরে খোলা বাজারে চাল বিক্রি শুরু হয়েছে। তবে চালের মান খুব একটা ভাল না হওয়ায় ক্রেতার সংখ্যা কম। খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা হয়েও ঈদের আগে থেকেই তিন দফায় পাইকারি ও খুচরা বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ১২ থেকে ২০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। নওগাঁ পৌর ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক উত্তম সরকার বলেন, হাট-বাজারে ধান নেই। বড় বড় চালকল মালিক ও এক শ্রেণীর মজুদদার আগেই অনেক ধান কিনে মজুদ রেখেছে। সে ধান ছাঁটাই করে চাল বাজারে ছাড়লেও তারা দাম বর্তমান মূল্যেই নিচ্ছে। বড় ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণেই বর্তমানে চালের বাজারে উর্ধগতি। নওগাঁ জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, চালের বাজার এখন ভারতের হাতে। তারাই এটি নিয়ন্ত্রণ করছে। ভারত যেভাবে চালের দাম রাখছে, আমাদের এখানে সেভাবেই চালের বাজার উঠছে। জেলা প্রশাসক ড. মোঃ আমিনুর রহমান বলেন, বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাজার কর্মকর্তাকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যেই সরকার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে খোলা বাজারে চাল বিক্রি শুরু করেছে। রাজশাহীতে চালকলে চালের স্তূপ চালকলগুলোয় মজুদ বাড়ানোর কারণে রাজশাহী অঞ্চলে বাড়ছে চাল সঙ্কট। এ কারণে বাড়ছে মোটাসহ সব ধরনের চালের দাম। চলতি বোরো মৌসুমে সিদ্ধ চাল সংগ্রহ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার তিন ভাগের মাত্র একভাগ। এছাড়া চাল দিতে চুক্তিতে আসেনি বিভাগের চার হাজার ৩৪৫ মিলার। এ ডিলারদেরও একটি অংশ মজুদ গড়ে তুলে চালের বাজারে সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। এদিকে, চাল মজুদদারদের বিরুদ্ধে রাজশাহীতেও শুরু হয়েছে সাঁড়াশি অভিযান। রাজশাহী আঞ্চলিক খাদ্য দফতরের হিসাবে, এ অঞ্চলে চুক্তিযোগ্য ছয় হাজার ২২৬ মিলারের এক হাজার ৮৮১ জন ৬৭ হাজার ৩৭৮ টন চাল দিতে চুক্তি করেন। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাল দেবেন মিলাররা। চুক্তিতে না আসা এ অঞ্চলের চার হাজার ৩৪৫ মিলারকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে খাদ্য অধিদফতর।
×