ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

এম. নজরুল ইসলাম

এর চেয়ে বড় কোন বেদনার ইতিহাস নেই

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ১৫ আগস্ট ২০১৭

এর চেয়ে বড় কোন বেদনার ইতিহাস নেই

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। পৃথিবীর ইতিহাসে লেখা এক কালো দিন। বাঙালীর প্রিয় নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল এই দিনে। অথচ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরেছিলেন নায়কের বেশে। পেয়েছিলেন বীরোচিত সংবর্ধনা। তাঁকেই প্রাণ দিতে হলো নিজের দেশে, ঘাতকের হাতে। সদ্যস্বাধীন দেশ তখনও বিধ্বস্ত। যুদ্ধের ছাপ মুছে ফেলা যায়নি। ভেঙ্গে যাওয়া অর্থনীতির চাকা সচল করার চেষ্টা চলছে। চলছে দেশকে নতুন করে গড়ার পরিকল্পনা। মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, সেই সময়ে কেন দেশের স্থপতিকে খুন করা হলো? এ প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা। কিন্তু সমীকরণ আজও মেলে না। বাঙালীর জাতীয় জীবনে অনেক কালো অধ্যায় আছে। কিন্তু ১৫ আগস্ট রাতে রচিত হলো যে কৃষ্ণ অধ্যায়, বাংলার ইতিহাসে তার চেয়ে বেদনার আর কী আছে? নিজের বাড়িতে সপরিবারে নিহত হলেন জাতির পিতা। জাতি পিতৃহীন হলো। যে জাতি মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে বুকের রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার সূর্য, সেই জাতিই কলঙ্কিত হলো পিতৃঘাতক হিসেবে। ইতিহাসের এই দায় কি কোনদিন পরিশোধ করা যাবে? ১৯৭৫ সালের সেই দিনটির কথা আজও মনে পড়ে। এখনও পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাই স্বাধীনতা-উত্তরকালের দিনগুলো। সদ্যস্বাধীন দেশে আমরা তখন হাওয়ায় ভেসে চলছি যেন। চারদিকে মুক্তির আনন্দ। নতুন করে দেশ গড়ে তোলা হচ্ছে। আমি তখন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক। জগন্নাথ কলেজের ছাত্র হলেও দিন কাটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অফিসে। কেন্দ্রীয় নেতারা সবাই চেনেন, জানেন। স্নেহ করেন। চোখ বন্ধ করলে এখনও যেন দেখতে পাই ফেলে আসা সেই দিনগুলো। স্পষ্ট মনে আছে সব স্মৃতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থন করে বহিষ্কার হওয়ার পর এই দ্বিতীয়বার তিনি যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। এর আগে তেহাত্তর সালে গিয়েছিলেন ঘাতকের ঘেরাও থেকে তাদের উদ্ধার করার জন্য। জাতির পিতাকে সর্বোচ্চ সম্মানের সঙ্গে স্বাগত জানাতে আমাদের প্রস্তুতির অন্ত নেই। দিনরাত কাজ আর কাজ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ তো, কিছুক্ষণ পরই মিরপুর রোডে ছাত্রলীগের কার্যালয়ে কাজ। রাতে কোনমতে একটু ঘুম। সকাল থেকেই আবার কাজের তোড়জোড়। কেমন মঞ্চ হবে, কে কোথায় কোথায় কোন্ দায়িত্ব পালন করবে। রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হবে। নানা প্রস্তুতি। ১৪ আগস্টের সারাদিন কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ও মহানগর ছাত্রলীগের অফিসে। মনে পড়ে, সন্ধ্যার পর থেকে কয়েকজনের সঙ্গে আমিও ছিলাম ৩০ মিরপুর রোডের মহানগর ছাত্রলীগের অফিসে। ছাত্রলীগ অফিসের কাছাকাছি ঢাকা কলেজের ঠিক উল্টো দিকে ছিল চিটাগাং রেস্টুরেন্ট। সেখানে রাতের খাবার খেয়ে আমরা তিনজন (ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন ও আমি) আমাদের পথ ধরি। বলাকা সিনেমা হলের সামনে গিয়ে একটা রিক্সা পেয়ে যাই। চেপে বসি ওই রিক্সায়। নিউমার্কেট, নীলক্ষেত হয়ে আমাদের রিক্সা ঢোকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। আমাদের রিক্সা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। টিএসসি পেরিয়ে বাংলা একাডেমির সামনে দিয়ে আমরা গেলাম তোপখানা রোডে (জাতীয় প্রেসক্লাবের ঠিক উল্টো দিকে) জাতীয় যুবলীগের অফিসে। রাত সাড়ে ১২টায় গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে। ৩১৭ নম্বর রুমের বাসিন্দা ওবায়দুল হক বাবুল ভাইয়ের কাছে। ওই রুমেই ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভেঙ্গে গেল কাকভোরে, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে। দরজা খুলতেই দেখা গেল সেখানে উপস্থিত হলের ক্যান্টিন ম্যানেজার। ভদ্রলোক জানালেন, তিনি রেডিওতে শুনেছেন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। খবর শুনে আমরা একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। রেডিও অন করতেই খবরটি শুনতে পাই আমরা। তাড়াতাড়ি হল থেকে বেরিয়ে পড়ি। কোন উপায় নেই। আত্মগোপনে যেতে হবে আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তল্লাশি হতে পারে। কাজেই হল থেকে বেরিয়ে চলে যাই আলুবাজারে। সেখান থেকে বেরিয়ে চলে গেলাম রথখোলা মোড়ে। জগন্নাথ কলেজের সাইদুর রহমান (এস আর হল) হলে আমি থাকি তখন। গোটাকয়েক কাপড় নিয়ে সোজা গেলাম যাত্রাবাড়ীর দিকে। রাস্তায় কোন মানুষ নেই। একটা দুটো রিক্সা চলে। আমরা তিনজন হাঁটছি। কোথায় গিয়ে থামব জানি না। একসময় গিয়ে পৌঁছলাম তোফাজ্জল ভাইয়ের পোস্তগোলা বটতলার বাড়িতে। গত রাতের পর থেকে পেটে কিছু পড়েনি। তার ওপর এই দুশ্চিন্তা। কথা ছিল, আজ সকালে পুরান ঢাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভিক্টোরিয়া পার্কে এসে জড়ো হবে। সেখান থেকে আমরা তিনজন নেতৃত্ব দিয়ে তাদের নিয়ে আসব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোথা থেকে কী হয়ে গেল! কেমন শুরু হওয়ার কথা ছিল আজকের দিনটি, কেমন হয়ে গেল। কখন সকাল হয়েছে জানি না। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়েছে কখন বুঝিনি। আমরা পোস্তগোলা থেকে বেরিয়ে যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জে একটা প্রেসে এসে আশ্রয় নিলাম। বাঁশের চাটাইয়ের বেড়ার ঘর। ওপরে টিনের ছাউনি। সে আমলের হ্যান্ড প্রেস। চারদিকে কালি আর কেরোসিন তেলের গন্ধ। সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হলো। আলো জ্বালানোর মতো মানসিক শক্তি আমাদের ছিল না। মাঝেমধ্যে রেডিওতে খবর শুনছি। হতাশায় ভরে যাচ্ছে মন। সন্ধ্যার পর থেকে বিদ্যুত নেই। থাকলেও কোন লাভ ছিল না। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সকাল থেকে আনন্দে মেতে থাকার কথা ছিল আমাদের। জাতির পিতাকে সংবর্ধনা জানানোর কৃতিত্বের অংশীদার হওয়ার কথা ছিল। কিছুই হলো না। রাতের অন্ধকারে আমরা তিনটি প্রাণী দয়াগঞ্জের সেই বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া দেয়া প্রেসে মুখোমুখি বসে থাকলাম। আমাদের মুখে কোন কথা নেই। অন্ধকার আমাদের শরীর ছুঁয়ে আছে। সেদিন কি আলোর মুখ দেখেছিলাম আমরা? সেদিন কি সূর্য উঠেছিল? নাকি বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অন্ধকারে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট? ১৫ আগস্ট বাঙালীর জাতীয় শোক দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের এই দিনে। পরিকল্পনাটি ছিল সুদূরপ্রসারী। শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা নয়, তাঁর আদর্শকেও নির্বাসনে পাঠানোর গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। ঘাতকের বুলেট সেদিন ধানম-ির ওই বাড়িতে শেখ পরিবারের কাউকে রেহাই দেয়নি। রেহাই পায়নি বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র রাসেল কিংবা পুত্রবধূরাও। এই জঘন্য হত্যাকা-ের ঘটনাটি যে ঘাতকচক্রের পূর্ব পরিকল্পনা, তা স্পষ্ট হয় হত্যা পরবর্তী কর্মকা- থেকেই। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু বা তাঁর পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে হত্যাকারীদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করেছিল, পুরস্কৃত করেছিল। খুনীদের রক্ষা করার জন্য দেশের সংবিধানেও হাত দেয়া হয়েছিল। এই পৈশাচিক হত্যাকা-ের বিচার রহিত করা হয়েছিল ইনডেমনিটি আইন পাস করার মাধ্যমে। কাজেই এটা স্পষ্ট যে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনা শুধু ব্যক্তি মুজিবকে হত্যার প্রয়াস ছিল না, ছিল জাতির স্বাধীনতার শক্তিকে হত্যার অপচেষ্টা। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে খুন করে তারা একটি আদর্শকে খুন করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ দেশে তা সম্ভব হয়নি, কখনও হবে না। আজ বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। মুজিবাদর্শে দীক্ষিত বাঙালী চায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। অন্ধকারের পর্দা ভেদ করে ইতিবাচক দিনের যাত্রা শুরু হয়েছে। বাঙালীর অগ্রযাত্রাকে রোধ করা সম্ভব হয়নি, হবে না। বাঙালী শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করেছে। আজ ১৫ আগস্ট, পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই মহান বাঙালীকে, যাঁর পরিচয়ে বাঙালী পরিচিত। বিশ্বজুড়ে তিনিই তো বাঙালীর পরিচয়সূত্র। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক [email protected]
×