ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘বিচার বিভাগকে বিক্ষুব্ধ করবেন না, ... অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর’

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৩০ মে ২০১৭

‘বিচার বিভাগকে বিক্ষুব্ধ করবেন না, ... অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সুপ্রীমকোর্টের পরামর্শ ছাড়া প্রেষণে থাকা বিচারকদের বিদেশ যাওয়া নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, এমন কিছু করা নির্বাহী বিভাগের উচিত হবে না, যাতে বিচার বিভাগ বিক্ষুব্ধ হয়। ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্কর’। আইন মন্ত্রণালয় যদি মনে করে তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত তাহলে মারাত্মক ভুল করবে। আইন মন্ত্রণালয়ে সহকারী জজ থেকে জেলা জজ পদ মর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা প্রেষণে কাজ করছেন। আজ সুপ্রীমকোর্টের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত নেন সিনিয়র বিচারকরা। অনেক চিন্তাভাবনা করেই সুপ্রীমকোর্র্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এখন যদি আইন মন্ত্রণালয় আইনের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে তাহলে খুব ভুল হবে। বিচারকদের চাকরিবিধির গেজেট প্রকাশ নিয়ে সোমবার আপীল বিভাগের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এ মন্তব্য করেন। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে তিনি বলেন, ‘আপনারা যদি আইন না জানেন, তাহলে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা চাইবেন। সংবিধান অনুসারে ব্যাখ্যা আমরা দেব। নির্বাহী নয়। এগুলো মনে করে চলবেন। অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশ না করে সোমবার আবারও সময়ের আবেদন করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৭ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সোমবার শুনানি শেষে আরও দুই সপ্তাহ সময় প্রদান করেন। এর আগে সকালে শুনানির শুরুতে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিধিমালা গেজেট প্রকাশের জন্য আরও দুই সপ্তাহ সময়ের আবেদন করেন। তখন প্রধান বিচারপতি এ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, কারণ কী? জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেলÑ প্রসেস চলছে। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা হাসবো না কাঁদবো? যাই হোক, আমি কিছু বলছি না। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হয়ে গেছে। কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে, কিছু অনিয়ম আছে। এগুলো নিয়ে সারাজীবন নয়। আমরা চাচ্ছি একটা সিস্টেমে চলে আসতে। প্রধান বিচারপতি অনিয়ম থেকে নিয়মে আসতে গেলে বলেÑ গেল গেল। তিনি আরও বলেন, ‘পত্রিকায় বলা হয়’ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্ব। আপনার মিনিস্ট্রিকে (আইন মন্ত্রণালয়) বলবেন, জেনারেল ক্লজ এ্যাক্টের ২১ পড়তে। সরকারকে বলবেন, যেসব বিচারক প্রেষণে আছে তারা সরকারী কর্মচারী না। সুপ্রীমকোর্ট জানতে চেয়েছিল প্রেষণে থাকাদের মধ্যে কারা বিদেশে যায় তাদের নাম।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা বিচার বিভাগকে বিক্ষুব্ধ করবেন না’ রাষ্ট্রপতির অনুশাসন বলে এমন কিছু করতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতির কাছে কোন ফাইল পাঠিয়ে যদি বলা হয়, করবেন। তখন তিনি হ্যাঁ বলেন, না বললেÑ না বলেন। তাই বলছি ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয়। সিনহা বলেন, ‘ভুল বোঝাবুঝি যত কম হয় ততই ভাল। তারা (আইন মন্ত্রণালয়) মনে করলে সুপ্রীমকোর্টের ওপর আদেশ করবে, তা ভুল করবে। তারা আইন না জেনে একের পর এক ব্যবধান সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্র এরকম করতে পারে না। সুপ্রীমকোর্টের প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত সিনিয়র বিচারকগণ চিন্তা করে নেয়। তারা (আইন মন্ত্রণালয়) যদি মনে করে যে, আইনের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে দেবে তাহলে খুব ভুল করবে।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা যদি আইন না জানেন তাহলে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা চাইবেন। বিডিআরের মামলা কোন আইনে চলবে সেটা আমাদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। আমরা বলে দিয়েছি। সংবিধান অনুসারে ব্যাখ্যা আমরা দেব। নির্বাহী নয়। এগুলো মনে করে চলবেন।’ তিনি বলেন, ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্কর। মারাত্মক ভুল হয়ে যাবে। তারা যদি আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে বলে এটাই কারেক্ট, খুব ভুল হয়ে যাবে।’ ‘যত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ডেপুটেশনে দিয়েছি, যদি তাদের প্রত্যাহার করি, তাহলে কারও কিছু করার নেই। বিচারকদের ডেপুটেশনে দিয়ে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে কাজ করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। ১৮৯৭ সালের সেকশন জেনারেল ক্লজ এ্যাক্ট ২১ দেখেন। যদি না হয় এটা ডিলিট করে দেন। এটা এত দিন ধরে চলে আসছে।’ গত ৯ মে সুপ্রীমকোর্টের জারি করা এক সার্কুলারে বলা হয় ‘বিচারিক পদে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ, আইন মন্ত্রণালয়, সংসদ সচিবালয় বা যেখানে প্রেষণে কর্মরত থাকুক না কেন, সুপ্রীমকোর্টের পরামর্শ ব্যতিরেকে বিদেশ গমন না করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।’ এরপর গত ১৬ মে আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে একটি পত্র পাঠায়। ওই পত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে গত বছর ১১ এপ্রিল মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা একটি পত্রের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সুপ্রীমকোর্টের একটি স্মারকপত্রের প্রেক্ষিতে অধস্তন আদালতের বিচারকরা প্রেষণে কর্মরত থাকাকালে বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে সুপ্রীমকোর্টের পরামর্শ গ্রহণের আবশ্যকতা নেই। রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিয়ে প্রেষণে থাকা বিচারকরা বিদেশ গমন করেছেন এবং করছেন। এর আগে গত ১৫ মে আপীল বিভাগ গেজেট প্রকাশে দুই সপ্তাহের সময় দিয়েছিলেন। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশ না করায় আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিবকে ১২ ডিসেম্বর হাজির করতে নির্দেশ দেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। এর মধ্যে ১২ ডিসেম্বর নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশের প্রয়োজন নেই বলে সিদ্ধান্ত দেন রাষ্ট্রপতি। পরে অবশ্য দুই সচিব আদালতে হাজির হওয়ার পর গেজেট প্রকাশে সময় দেয় আদালত। ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় (বিচার বিভাগ পৃথককরণ) ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়া হয়। ওই রায়ের ভিত্তিতে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল। আপীল বিভাগের নির্দেশনার পর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় একটি খসড়া শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধি প্রস্তুত করে সুপ্রীমকোর্টে পাঠায়। গত বছরের ২৮ আগস্ট শুনানিকালে আপীল বিভাগ খসড়ার বিষয়ে বলেন, শৃঙ্খলা বিধিমালা সংক্রান্ত সরকারের খসড়াটি ছিল ১৯৮৫ সালের সরকারী কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপীল) বিধিমালার হুবহু অনুরূপ। যা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থী। এরপরই সুপ্রীমকোর্ট একটি খসড়া বিধিমালা করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠান। পরবর্তীতে গেজেট প্রকাশে আরও কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে নেন রাষ্ট্রপক্ষ।
×