ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চড়কমেলা

প্রকাশিত: ০৭:১৬, ২২ এপ্রিল ২০১৭

চড়কমেলা

বৈশাখ মানেই বাড়তি আনন্দ, বাড়তি চাপ। তবে চাপ যতই থাক, বৈশাখ উদযাপনে বাঙালীর কোন কিছুরই কমতি থাকে না। বৈশাখ এলেই দেশের সর্বত্র সাজ সাজ পড়ে যায়। বর্ষবরণ করতে মেতে ওঠে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ। বৈশাখে দেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্র মেলার জমজমাট আয়োজন এ দেশের চিরাচরিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে নতুনমাত্রা যোগ করে। বৈশাখে বর্ষবরণের উৎসব ছাড়াও বাঙালী সমাজের ধর্ম, সংস্কার আর প্রথাগত নানা ধাঁচের মেলা বৈশাখী মেলাকে আরও জীবন্ত করে তোলে। বৈশাখে তেমনি বিকল্পধারার আয়োজনের নাম চড়কমেলা। শহুরে মানুষ যখন বর্ষবরণের আনন্দে মাতোয়ারা থাকে, তখন গ্রামীণ জীবনে চড়কের মেলা গ্রামীণ লোকজনের সে চাহিদা পূরণ করে। নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী, আবাল বৃদ্ধ, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে যোগ দেয় চড়কের মেলায়। চড়ক পূজাকে কেন্দ্র করে মূলত চড়কমেলা বসে। উল্টোভাবে বললে যে মেলায় চড়ক ঘোরে সেটাই চড়কের মেলা। নাটোর শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে আদিবাসী অধ্যুষিত শংকরভাগ গ্রামে বৈশাখে বসে চড়কের মেলা। ত্রিশ বছর ধরে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে প্রথাগত এই চড়কমেলার আয়োজনকারী মূলত স্থানীয় আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর লোকজন। শংকরভাগ গ্রামের ১৭০ পরিবার প্রতিবছর চাঁদা তুলে চড়ক পূজা বা চড়ক মেলার আয়োজন করে। সাধারণত বিকেলে জমে ওঠে এই মেলা। চড়কমেলার ২/৩ দিন আগে পানিতে ডোবানো চড়ক গাছকে পূজা অচর্নার মাধ্যমে জাগ্রত করা হয়। আগেকার দিনে চড়ক পূজার সময় সন্ন্যাসীরা আগুনের ভেতর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে পার হওয়ার কাহিনী প্রচলিত থাকলেও ইদানীং তা আর চোখে পড়ে না। মেলার আগের রাতে সংক্রান্তিতে মহাদেব শিবের পূজা অর্চনা শেষ হয়। চড়ক ঘোরানোর সময় হলে উপবাসী ভক্তদের ইচ্ছানুযায়ী তাদের পিঠে, ঊরুতে কখনও কখনও জিহ্বায় বান ফুঁড়ে চড়কে তোলা হয়। এরপর শুরু হয় চড়ক ঘোরানো। চড়কমেলার বিশেষত্ব বা প্রধান আকর্ষণ মূলত পিঠে বান বা বড়শি ফুঁড়ে চড়কে ঘোরানো। প্রতিবছর চড়কমেলা দেখতে দূর-দূরান্তের হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। কে হিন্দু কে মুলসমান ভেদাভেদ ভুলে উৎসুক জনতার পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। রোগ-শোক থেকে মুক্তি লাভের জন্য বাতাসা, মিঠাই মানত করে নারী-পুরুষ যোগ দেয় মেলায়। মেলাকে কেন্দ্র করে শত শত দোকানি বিভিন্ন ধরনের জিনিষপত্রের পসরা সাজিয়ে বসে। নানারকমের খেলনা, জিলাপি, মুড়ি-মুড়কি, দা-বটি, ঘটিবাটি, খুন্তি, আসবাবপত্র ইত্যাদির মতো গৃহস্থালি সামগ্রী ছাড়াও হরেক রকমের জিনিস পাওয়া যায় মেলায়। চড়কমেলা গ্রামীণ জীবনে উৎসব আমেজে নতুন মাত্রা যোগ করে। বৈশাখে শহরের বর্ষবরণ আমেজ বঞ্চিত গ্রামীণ মানুষদের আনন্দ পুষিয়ে দেয় এই চড়কমেলা। কালের পরিক্রমায় নগর জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে চড়কমেলার আয়োজনেও ভাটা পড়ছে। -কালিদাস রায়, নাটোর থেকে
×