ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ॥ আজ দুপুরের মধ্যে অভিযান শেষ

হাজারীবাগের ট্যানারিতে গ্যাস বিদ্যুত পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৯ এপ্রিল ২০১৭

হাজারীবাগের ট্যানারিতে গ্যাস বিদ্যুত পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ গ্যাস, বিদ্যুত ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো অবশেষে স্থায়ীভাবে বন্ধ করার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। শনিবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে পরিবেশ অধিদফতর সংশ্লিষ্ট তিতাস গ্যাস, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষকে (ঢাকা ওয়াসা) সঙ্গে নিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্নের কাজ শুরু করে। বেলা দুইটা নাগাদ হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোতে উৎপাদন কার্যক্রম একদম বন্ধ হয়ে গেছে। আজ রবিবার দুপুরের মধ্যে এখানকার সব ট্যানারির গ্যাস, বিদ্যুত ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ শেষ করা হবে। এদিকে, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে হাজারীবাগের ট্যানারি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুশি স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলছেন, ট্যানারি বন্ধ হওয়ায় হাজারীবাগসহ বুড়িগঙ্গা নদী দূষণমুক্ত হবে। আর ট্যানারি মালিকরা বলছেন, এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নয় সাভারের চামড়া শিল্পনগরী। তাই হাজারীবাগের কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ায় এ শিল্প খাতের রফতানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এদিকে, এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের এই অভিযানে ১৯৩টি কারখানার বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশরাফ জানান, আমাদের কাছে ১৯৩টি তালিকা ছিল, সেগুলোর সব কয়টির বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ শেষ হয়েছে। গ্যাস সংযোগ ২০০টির মতো কাটা সম্ভব হয়েছে। পানি সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ৬০টি ট্যানারির। বাকি কারখানার গ্যাস, বিদ্যুত ও পানি সংযোগ আজ দুপুরের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করার কাজ শেষ করা হবে। এছাড়া কারখানা এলাকার বাসাবাড়ির বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগ চালু রাখা হয়েছে। সাধারণ মানুষের যাতে কষ্ট না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ডিপিডিসির পরিচালক (অপারেশন্স) এটিএম হারুনুর রশিদ বলেন, আদালতের নির্দেশে আমরা অভিযানে অংশ নিচ্ছি। মূলত পরিবেশ অধিদফতরের নেতৃত্বেই বিদ্যুত, পানি ও গ্যাস লাইন বিচ্ছিন্নের কাজ চলছে। অন্য সংস্থাগুলো পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সাহায্য করছেন। দুপুরে পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) ম আলমগীর বলেন, এখন পর্যন্ত ৬০টি ট্যানারির পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ২০০টির বেশি ট্যানারির। গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে কিছুটা সময় লাগে। তাই এখনও বলা যাচ্ছে না কতগুলো ট্যানারির গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তিনি আরও জানান, আজকে সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করা গেলে কালও চলবে এই কার্যক্রম। নিরাপত্তার জন্য সেখানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর আগে শনিবার সকালে সংযোগ বিচ্ছিন্নের সময় উপস্থিত পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ রইছউল আলম ম-ল সাংবাদিকদের বলেন, কাল দুপুর নাগাদ এ কাজ শেষ হবে। সংযোগ বিচ্ছিন্নের কাজে ট্যানারি মালিক ও শ্রমিকদের সহযোগিতা পাচ্ছেন। পরিবেশ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রোপলিটন অঞ্চলের পরিচালক সুকুমার বিশ্বাস বলেন, হাজারীবাগের চামড়া কারখানাগুলোর গ্যাস, বিদ্যুত ও পানিসহ সব ধরনের ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ নির্বিঘেœ চলছে। আজকের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে আগামীকালও অভিযান চলবে। কেউ বাধা দিচ্ছে না, সংশ্লিষ্ট সবাই সহযোগিতা করছে। প্রসঙ্গত, গত ৬ মার্চ হাইকোর্ট হাজারীবাগ ছাড়তে ট্যানারিগুলোর গ্যাস, বিদ্যুত ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেন। পরে এ রায় সুপ্রীমকোর্টে বহাল থাকে। ট্যানারি মালিকরা ঈদ-উল-আজহা পর্যন্ত সময় চেয়ে আবেদন করলে তা হাইকোর্টে খারিজ হয়ে যায়। ট্যানারিগুলোর গ্যাস, বিদ্যুত ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিষয়ে ১০ এপ্রিলের মধ্যে পরিবেশ অধিদফতরকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন আদালত। পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে ট্যানারি মালিকরা আর কোন আইনী লড়াইয়ে না যাওয়ায় সংযোগ বিচ্ছিন্নের কাজ শুরু হয়। ট্যানারিগুলোর জরিমানার বিষয়ে করা রিভিউ আবেদন এবং ১৫৪টি ট্যানারি মালিকের জরিমানা বকেয়া বাবদ ৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা স্থগিতের বিষয়ে আগামী ৯ এপ্রিল শুনানি গ্রহণ করবেন আদালত। এর আগে ১৯ মার্চ ১৫৪টি ট্যানারির মালিককে বকেয়া বাবদ ৩০ কোটি ৮৫ লাখ জরিমানা পরিশোধের আদেশ স্থগিত করে শুনানির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন আপীল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত। গত ২ মার্চ ১৫৪টি ট্যানারি কারখানাকে বকেয়া বাবদ ৩০ কোটি ৮৫ লাখ জরিমানা দুই সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। পরে এই আদেশ স্থগিত চেয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন ও ফিনিশড লেদার গুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন হাইকোর্টে আবেদন করেন। এদিকে, সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা গ্রামে ১৯৯ একর জমির ওপর চামড়া শিল্পনগর প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে ১৫৫টি ট্যানারি শিল্প-কারখানাকে সরিয়ে নেয়ার জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)। তবে বেশ কিছু ট্যানারি সেখানে প্লট পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও পরিবেশ অধিদফতরের দাবি, ওই ট্যানারিগুলোর পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। সে ক্ষেত্রে প্লট পায়নি এমন ট্যানারিগুলোর গ্যাস, বিদ্যুত ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে কি না, জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, বিষয়টি পরিবেশ অধিদফতরের এখতিয়ারবহির্ভূত। সব সংযোগই বিচ্ছিন্ন করা হবে। এদিকে, পুরান ঢাকার ট্যানারি মোড়, মনেশ্বর রোডের মোড়, ঢাকা ট্যানারি মোড়, বেড়িবাঁধ মোড়, হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোকে এ চার ভাগে ভাগ করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এমবি ট্যানারির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সময় কাঁদতে শুরু করেন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী রমজান আলী। তিনি বলেন, ৩২ বছর ধরে তিনি এখানে কাজ করেছেন। এখন কর্মহীন হয়ে পড়বেন। সামনে রোজা, ঈদ। বেতন-বোনাস কিছুই পাবেন না। সন্তানদের নিয়ে কিভাবে চলবেন বলেই কান্নাকাটি শুরু করেন তিনি। ট্যানারি মালিকদের অভিযোগ, হেমায়েতপুরে ট্যানারিগুলোর এখনই কাজ শুরু করার মতো অবস্থা নেই। বিসিক এখনও প্রস্তুত নয়। সেখানে পুরোপুরি গ্যাস-সংযোগ চালু করা যায়নি। এছাড়া কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) তৈরির কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। এ অবস্থায় হাজারীবাগে ট্যানারিগুলোর গ্যাস, বিদ্যুত ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি বন্ধ হয়ে যাবে। আর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ হিসেবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ঢাকাবাসী।
×