ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

একজন ক্লপ ও ইতিহাস বদলানোর নায়ক

প্রকাশিত: ০০:২৬, ১৫ জুলাই ২০২০

একজন ক্লপ ও ইতিহাস বদলানোর নায়ক

জার্গেন ক্লপকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছুই নেই। বিশ্ব ক্লাব ফুটবলে যে ক’জন স্বনামধন্য এবং তারকাখচিত কোচ রয়েছেন তাদের মধ্যে শীর্ষসারিতেই অবস্থান তার। জার্মানির মেইঞ্জ এবং বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের ইতিহাস বদলে দিয়েই নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান তিনি। তারপর নতুন করে ঠিকানা গড়েন ইংলিশ জায়ান্ট লিভারপুলে। এবার সেই লিভারপুলের ইতিহাসও বদলে দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেলেন আরও উচ্চতায়। ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে গেলেন জার্গেন ক্লপ। ২০১৫ সালে স্বদেশী ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে যোগ দেন ক্লাব লিভারপুলে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে আসার পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে অবিশ্বাস্য সব সাফল্য পাচ্ছেন তিনি। ২০০৭ সালের পর গত বছর লিভারপুলকে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা উপহার দেয়। ২০১৯ সালে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হওয়ারও অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়ে অলরেডরা। ইউরোপ সেরার মুকুট জয় এবং ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এবার আরাধ্য ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের শিরোপাও নিজেদের করে নিল লিভারপুল। দীর্ঘ ৩০ বছর পর ক্লাবটিকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের শিরোপা জিতিয়েছেন জার্গেন ক্লপ। এর ফলে ইংল্যান্ডের শীর্ষ ফুটবলের ১৩১ বছরের ইতিহাসে প্রথম জার্মান কোচ হিসেবে প্রিমিয়ার লীগ জয়ের রেকর্ড গড়েছেন ৫৩ বছর বয়সী এই ক্লপ। ১৯৮৯-৯০ সালে প্রথমবারের মতো সিনিয়র পর্যায়ে পেশাদার কোন ক্লাবের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন জার্গেন ক্লপ। তবে ততদিনে অন্তত সাতটি প্রফেশনাল ক্লাবের জুনিয়র টিমে খেলার অভিজ্ঞতা হয়ে যায় তার। ১৯৯০ সালের এক গ্রীষ্মের দুপুরে মেইঞ্জ ০৫ ক্লাবের সিনিয়র দলে তার অন্তর্ভুক্তি হয়ে যায় পাকাপোক্ত। ক্লপ খেলা শুরু করেন একজন জাত স্ট্রাইকার হিসেবে। তবে ১৯৯৫ সাল থেকে খেলার ধরন পাল্টে বনে যান রাইটব্যাক। প্রফেশনাল ক্যারিয়ারের সিংহভাগই কাটিয়েছেন মেইঞ্জ ক্লাবের হয়ে। ১৯৯০ সালের শুরুতে যোগ দিয়েছিলেন ক্লাবে। টানা ১১ বছরের সে যাত্রা গিয়ে থামল ২০০১ সালের শুরুতেই। ততদিনে শতবর্ষী ক্লাবের প্রিয়জনে পরিণত হয়ে গিয়েছেন ক্লপ। পাশাপাশি তাদের অলটাইম গোলস্কোরারের তমকাটাও গায়ে জড়িয়েছেন। অবসরে যাওয়ার ক’দিন পরেই মেইঞ্জ তাদের কোচ এ্যাকহার্ড ক্রায়ুথজুনকে বরখাস্ত করে এবং অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসেবে ঘোষণা করে জার্গেন ক্লপের নাম। ফুটবলার ক্লপের কোচিংয়ের শুরুটা মূলত এখান থেকেই। মেইঞ্জ তখন রেলিগেশন শঙ্কায় দিন পার করছিল। সেবার এক ম্যাচ হাতে রেখে ১৪ নাম্বার হয়ে মৌসুম শেষ করে বাঁচিয়ে রাখেন দ্বিতীয় বিভাগে খেলার স্বপ্ন। ২০০১-০২ মৌসুমে তাকে পুরোদস্তুর এক ফুটবল কোচ হিসেবে আবিষ্কার করে জার্মানবাসী। ক্লাবকে রীতিমতো বদলে ফেলেন তার আপন মহিমায়। রেলিগেশন শঙ্কায় থাকা ক্লাবটি পরবর্তী মৌসুম শেষ করে লীগে চতুর্থ স্থান দখল করে। তবে শীর্ষ তিনে জায়গা না পাওয়ায় বুন্দেসলিগায় খেলা হলো না সেবার। টানা দুই মৌসুমে হতাশার আগুনে দগ্ধ হওয়া ক্লপ ২০০৩-০৪ মৌসুম শেষে ঠিকই হাসলেন বিজয়ের হাসি। ৩য় বারের চেষ্টায় ক্লপ তার দলবল নিয়ে হানা দিলেন জার্মান ফুটবলের শীর্ষস্থান বুন্দেসলিগায়। এটিই ছিল ক্লাবের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বুন্দেসলিগায় স্থান দখল করা। সবচেয়ে কম বাজেট, দেশের সবচেয়ে ছোট স্টেডিয়াম আর অল্প সংখ্যক ফ্যান নিয়ে বুন্দেসলিগায় মেইঞ্জের পথচলা শুরু হলো ক্লপের হাত ধরে। জার্মানির টপ ক্লাবগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেইঞ্জ ২০০৪-০৫ মৌসুম শেষ করল ১১তম স্থানে। ২০০৬-০৭ মৌসুমে বুন্দেসলিগা থেকে রেলিগেটেড হয়ে যায়; তবু ক্লপ ক্লাবের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরবর্তী মৌসুমে বুন্দেসলিগায় স্থান নিতে না পারায় অভিমানে ক্লাবের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করলেন ক্লপ। স্মৃতিতে রেখে গেলেন ক্লাবের রেকর্ড পরিমাণ ১০৯টি জয়। জার্মানির ফুটবলে ক্লপ তখন চেনা মুখ। মেইঞ্জের সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদের সুযোগ নিতে চাইল জার্মান চ্যাম্পিয়ন বেয়ার্ন মিউনিখ। তবে তাদের হতাশ করে ২০০৮ সালের মে মাসে দু’বছরের চুক্তিতে ক্লপ নাম লেখালেন বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের কোচদের তালিকায়। বরুশিয়া তখন খারাপ সময় পার করছিল। বেয়ার্নকে হারিয়ে ক্লপ বরুশিয়ায় প্রথম মৌসুমেই জিতে নেন জার্মান সুপারকাপের শিরোপা। আর মৌসুম শেষ করেন ৬ নাম্বারে থেকে। পরবর্তী মৌসুমে লীগের সবচেয়ে তারুণ্যনির্ভর দল নিয়ে মৌসুম শেষ করেন ৫ম স্থানে থেকে। ২০১০-১১ মৌসুমটা স্বপ্নের মতো কাটল বরুশিয়ার। ১৫ ম্যাচের ১৪টিতেই টানা জয় পেয়ে ক্রিসমাসের ছুটি কাটাতে যায় ক্লপের শিষ্যরা। দুই ম্যাচ হাতে রেখেই ২০১০-১১ মৌসুমে লীগ শিরোপা ঘরে তুলে বরুশিয়া। এটি ছিল বরুশিয়ার ৭তম লীগ শিরোপা জয়, তবে এর আগে এত তরুণ দল নিয়ে কেউ লীগ জিততে পারেনি। ২০১১-১২ মৌসুমে টানা ২য় বারের মতো শিরোপা জয়ের উল্লাস করল ক্লপ বাহিনী। মৌসুম শেষে বরুশিয়ার ৮১ পয়েন্ট ছিল বুন্দেসলিগার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ রেকর্ড। পাশাপাশি লীগে বেয়ার্নের ২৫ ম্যাচ জয় থাকার রেকর্ডটিও ছুঁয়ে ফেলে তারা। মে মাসে ডিএফবি-পোকাল কাপের ফাইনালে বেয়ার্নকে বিধ্বস্ত করে মৌসুমে ডাবল শিরোপা ঘরে তুলে তারা। ২০১৪-১৫ মৌসুম ছিল বরুশিয়ায় ক্লপের শেষ মৌসুম। সিগনাল ইদুনা পার্কের লন ধরে শেষ পদক্ষেপের আগ পর্যন্ত অসংখ্য-অগুনতি দর্শকের ভালবাসা আর শ্রদ্ধা নিয়ে শেষ ¤্রয়িমান হাসি হাসেন ক্লপ। বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে যার আগমন ঘটেছিল। দুই হাত উজাড় করে দিয়েছেন সেই ক্লাবকে। ক্লাবের রেকর্ডবুক, ট্রফি ক্যাবিনেট কিংবা ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার সবখানেই তিনি সফল। তারই হাত ধরে সাফল্যের গল্প এবার নতুন করে রচিত হচ্ছে লিভারপুলে। ২০১৫ সালে ক্লপ লিভারপুলে যোগ দেয়ার পর হিমশিম খেয়েছিলেন। কিন্তু বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের এই সাবেক কোচ শিরোপা জয়ের ব্যাপারে ছিলেন অবিচল। তার গড়া স্কোয়াডটি আরও কয়েক বছরের জন্য আদর্শ দল হয়েই থাকবে। ক্লপ বলেন, ‘গত দুইতিন বছরে তারা যা করে দেখিয়েছে তা এক কথায় বিরল। এমন একটি দলের কোচ হতে পারাটা আমার জন্য নিখাঁদ একটি উপভোগ। এখানে আসার প্রথমদিন থেকে রোমঞ্চকর একটি পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এটি এখনও শেষ হয়নি। এটিই ভাল একটা দিক। দলটিকে দেখেই মনে হচ্ছে আরও কয়েকটি বছর তারা ভাল করতে পারবে। সত্যিকার অর্থে এই অর্জন আমার স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে গেছে।’
×