ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

গলে হার এড়াতে পারবে তো বাংলাদেশ!

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১০ মার্চ ২০১৭

গলে হার এড়াতে পারবে তো বাংলাদেশ!

মিথুন আশরাফ ॥ গল টেস্টে তিনদিন না যেতেই বাংলাদেশের সামনে বিপদ ঘনিয়ে আসল। শ্রীলঙ্কা ১৮২ রানে এগিয়ে থাকায় এখন বাংলাদেশের সামনে টেস্ট বাঁচানোর ‘মহাকঠিন’ সমীকরণ যেন সামনে চলে আসল। এখনও শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় ইনিংস শুরুই হয়নি। তাতেই এ বিপদ দেখা যাচ্ছে। ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে যে বাংলাদেশ বড়ই অসহায়। প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কার গড়া ৪৯৪ রানের জবাবে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ৩১২ রান করে। মুশফিকুর রহীম (৮৫) ও মেহেদী হাসান মিরাজ (৪১) যদি হাল না ধরতেন, তাহলে তিন শ’ রানও অতিক্রম করতে পারত না বাংলাদেশ। শুরুতেই ১৮২ রানে পিছিয়ে যায় মুশফিকবাহিনী। যখন বাংলাদেশের ইনিংস ৯ উইকেটে ৩১১ রানে থাকে, তখন বৃষ্টি শুরু হয়। এই সময়ে চা বিরতিও পড়ে। দ্বিতীয় সেশনের আগেই ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। বৃষ্টি থামতেই আবার খেলা শুরু হয়। শুরু হতেই ১ রান যোগ করে অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। এরপর আবার বৃষ্টি শুরু হয়। খেলা আর মাঠে গড়ায়নি। এই বৃষ্টির আগেই বাংলাদেশের বারোটা বেজে যায়। শ্রীলঙ্কার এক সেঞ্চুরি ও তিন হাফ সেঞ্চুরির বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে মিলে তিন হাফ সেঞ্চুরি। দ্বিতীয়দিনের শেষ বেলায় ওপেনার তামিম ইকবাল আউট হয়ে যান। আউট হন মুমিনুল হকও। ২ উইকেট হারিয়ে ১৩৩ রানে বাংলাদেশ দ্বিতীয়দিন শেষ করে শ্রীলঙ্কা থেকে ৩৬১ রানে পিছিয়ে থাকে। ব্যাট হাতে থাকেন সৌম্য সরকার (৬৬*) ও মুশফিকুর রহীম (১*)। মনে করা হচ্ছিল, এ দুইজন বহুদূর এগিয়ে যাবেন। দলকেও এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু তৃতীয়দিনের শুরুতেই টেস্ট মেজাজ হারিয়ে বসেন সৌম্য (৭১)। লাকমালের করা লেগ স্ট্যাম্পে দেয়া শট বলটি ছেড়ে দেবেন কি, উল্টো পুল করতে গিয়ে বাজেভাবে ক্যাচ আউট হলেন। এরপর মুশফিক, সাকিব আল হাসান, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, লিটন কুমার দাস ও মেহেদী হাসান মিরাজ ছাড়া আর কোন গতি নেই। মিডল অর্ডারে বাংলাদেশের সেরা জুটি মুশফিক-সাকিব জুটি। বাংলাদেশ ইতিহাসের সেরা জুটিটিই তাদের গড়া। দুইজন মিলে এগিয়েও চলছিলেন সুন্দরভাবে। কিন্তু সাকিব একটি বাজে শট খেলে বসলেন। অনেকটা তামিমের মতোই। সান্দকানের বলটি মিডল স্ট্যাম্পে পড়ে লেগ সাইড দিয়ে চলে যাচ্ছিল। সাকিব কি করলেন, বলে ব্যাট লাগাতে চাইলেন। ব্যাটে বল লাগল ঠিকই। কিন্তু তা উইকেটরক্ষক ডিকওয়েলার হাতে গিয়ে জমা হলো। সাকিব (২৩) আউট হয়ে গেলেন। একের পর এক বাজে শটে বাংলাদেশের এগিয়ে চলার স্বপ্ন বাধাগ্রস্ত হতে থাকল। ১৭০ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশও বিপাকে পড়ে গেল। এরপর যখন ১৪ রান যোগ হতেই মাহমুদুল্লাহও (৮) সাজঘরের পথ ধরলেন, বাংলাদেশ বিপত্তিতে পড়ে গেল। মুশফিকের পরিবর্তে উইকেটরক্ষকের ভূমিকায় নেয়া হয়েছে লিটনকে। তাকে দলে টিকে থাকতে হলে ব্যাটিংটাই আগে ভাল করতে হবে। কিন্তু প্রস্তুতি ম্যাচে এত ভাল খেলেও আসল লড়াইয়ে এসেই নেতিয়ে গেলেন লিটন (৫)। সেই সঙ্গে বাংলাদেশকেও ফলোঅনের শঙ্কাতেই ফেলে দিলেন। তা থেকে এখন মুক্ত হওয়ার রাস্তা ছিল একটাই। মুশফিক ও মিরাজকে হাল ধরতে হবে। না হলে ফলোঅন নিশ্চিতই। এ দুইজনের পরে যে বোলাররা (তাসকিন, শুভাশীষ, মুস্তাফিজ) আছেন। হাল ধরলেনও তারা। ১৯২ রানেই যেখানে ৬ উইকেটের পতন ঘটেছিল, সেখান থেকে দলকে মুশফিক-মিরাজ মিলে শুধু ফলোঅনের হাত থেকেই বাঁচাননি। তিন শ’ রানের কাছাকাছিও নিয়ে গেছেন। নিজের প্রথম চার টেস্টে যেন অলরাউন্ডার মিরাজকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না। হায়দরাবাদে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট থেকেই সেই রূপে নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেন তিনি। হায়দরাবাদ টেস্টের প্রথম ইনিংসে অর্ধশতক করার পর গল টেস্টের প্রথম ইনিংসেও ৪১ রান করেন। মুশফিকের সঙ্গে সপ্তম উইকেটে ১০৬ রানের জুটিও গড়েন। হেরাথের তিন বলে দুটি চার হাঁকিয়ে ইনিংসের শুরুটা করেন মিরাজ। এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকেন। ৯ রানে অবশ্য একবার আউট হওয়া থেকে বাঁচেন মিরাজ। সুযোগটি পেয়ে এগিয়েও যেতে থাকেন। মধ্যাহ্ন বিরতির আগেই বাংলাদেশ ৬ উইকেট হারিয়ে বসে। এরপর মুশফিক ও মিরাজ মিলে উইকেটে থিতু হন। মধ্যাহ্ন বিরতিতে ৬ উইকেটে ২১৩ রান করে বাংলাদেশ। এই সময়ে মুশফিক নিজেকে অনেক চেষ্টা করে উইকেটে আঁকড়ে রাখেন। বল একবার মাথায় আঘাত হানলেও অবিচল থাকেন। অপরপ্রান্তে একেক করে ব্যাটসম্যান আসেন, কিছু রান করার চেষ্টা করে সাজঘরে ফেরেন। মুশফিক ঠিকই উইকেটের আরেকপ্রান্ত আগলে রাখেন। শেষ পর্যন্ত মধ্যাহ্ন বিরতিতে যাওয়ার সময় তো মুশফিকের স্কোর দাঁড়ায় ৮৪ বলে ২২ রান। আর মিরাজের ১৯ বলে ২ চারে ১১ রান। মধ্যাহ্ন বিরতি শেষ হতেই যেন অন্য এক মুশফিককে দেখার মিলে। ৮৯ বলে গিয়ে প্রথম বাউন্ডারি হাঁকান মুশফিক। সেটি আবার হেরাথের বলে ছক্কা মেরে। শুরু হয়ে যায় যেন মুশফিকের ব্যাটিং দ্যুতি। সেই সঙ্গে মিরাজের উইকেট আঁকড়ে থেকে দলকে বাঁচানোর তাড়না। একদিক দিয়ে মুশফিক বাউন্ডারি হাঁকাতে থাকেন। আরেকদিক দিয়ে মিরাজ। চলতে থাকে এভাবে। মধ্যাহ্ন বিরতিতে যাওয়ার আগে ফলোঅন এড়াতেই ৮২ রানের দরকার ছিল। মুশফিক ও মিরাজ মিলে দলকে সেই লজ্জা থেকে মুক্ত করে দেন। যেখানে ৮৯ বলে প্রথম বাউন্ডারি হাঁকান মুশফিক, সেখানে পরের ১৮ বলের মধ্যে ১০৭ বলেই চার বাউন্ডারি ও এক ছক্কায় হাফসেঞ্চুরি করে ফেলেন মুশফিক। উইকেটে আগে থিতু হতে হবে। এরপর রান আসবেই। অন্যরা যখন এ ‘ফর্মুলা’ই মেনে চলতে পারছেন না, সেখানে মুশফিক সফল। মনে করা হচ্ছিল, উইকেটকিপিংয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ায় এর প্রভাব ব্যাটিংয়ে পড়তে পারে। কিন্তু মুশফিক সেই ধারণা উড়িয়ে দিলেন। ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলে চার নম্বরে ব্যাট করে দলের এ মুহূর্তে সেরা ব্যাটসম্যান যে তিনিই, তার প্রমাণ আবার দিলেন। কি দুর্দান্ত ফর্ম যাচ্ছে মুশফিকের। টানা দুই টেস্টের প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি করার পর টানা তৃতীয় টেস্টেও সেই নৈপুণ্যের কাছে চলে যান। দেখতে দেখতে দুইজন মিলে দলকে ফলোঅনে পড়া থেকেও বাঁচান। ২৯৫ রান হতেই ফলোঅন এড়ায় বাংলাদেশ। কিন্তু আর ৩ রান যোগ হতেই ঘটে বিপত্তি। মিরাজ আউট হয়ে যান। পেরেরার বলে এলবিডাব্লিউ হয়ে যান মিরাজ। তবে আউট হওয়ার আগে দলকে অনেক ভাল অবস্থানে রেখে যান। সিনিয়র ক্রিকেটাররা যা করে দেখাতে পারেননি, মিরাজ তা করে দেখালেন। যদিও ৪১ রান খুব বেশি নয়। তবে সময়োপযোগী ইনিংস। এ ইনিংসটি বাংলাদেশ দলের জন্য এ মুহূর্তে খুব দরকার ছিল। বিশেষ করে মুশফিকের যোগ্য একজন সঙ্গী দরকার ছিল। যেটি মিরাজ হলেন। তাতে সবার প্রশংসাতেও ভাসছেন মিরাজ। কিন্তু দিনশেষে বাংলাদেশ বিপাকেই পড়ে থাকল। মিরাজ সাজঘরে ফেরার পরের বলেই তাসকিন আউট হয়ে যান। তখন বোঝা যায়, আর বেশিদূর যাওয়া হচ্ছে না। মুশফিককে সঙ্গ দেয়ার মতো যে এখন আর কেউ নেই। ৩০৮ রানে গিয়ে যখন মুশফিকও আউট হয়ে যান, তখন অনেক ব্যবধানে পিছিয়ে থাকবে বাংলাদেশ, তা বোঝা হয়ে যায়। মুশফিক ১৫ রানের জন্য টানা তৃতীয় টেস্টে সেঞ্চুরির সুযোগ হাতছাড়া করেন। এরপর আর ৪ রান যোগ হতেই অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। বৃষ্টি আর খেলা হতে দেয়নি। তাই দিন শেষ হয়ে যায়। তবে হাতে আছে এখনও দুইদিন। আর এই দুইদিনেই ম্যাচ হারের শঙ্কাতেই পড়ে গেছে বাংলাদেশ। তা বলাই চলে। শ্রীলঙ্কা ১৮২ রানে এগিয়ে আছে। দ্বিতীয় ইনিংসে এরসঙ্গে আর ২৫০ রান যোগ হলেই তো হারের মুখে পড়ে যাবে বাংলাদেশ। ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে যে ৪১৩ রানের বেশি করার রেকর্ড নেই বাংলাদেশের। তাও আবার একবারই শুধু বাংলাদেশ ৪০০ রানের বেশি করতে পেরেছে। সেটি ২০০৮ সালে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই, মিরপুরে। দুইবার তিন শ’ রানের ওপরে করেছে। বাকি ২০ ইনিংসেই তিন শ’ রানের নিচে করেছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার মাটিতে তো ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে ১৮৪ রানের বেশি করতেই পারেনি বাংলাদেশ। এ পরিসংখ্যানই বাংলাদেশের সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। ম্যাচের দুইদিন এখনও বাকি আছে। হারের শঙ্কাতেই পড়ে গেছে বাংলাদেশ।
×