ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতা

প্রকাশিত: ০২:০৫, ১৪ এপ্রিল ২০২২

কবিতা

বৃন্তচ্যুত পাতাদের জন্য বিমল গুহ মধ্যরাতে দিগন্তের পেট ফুটো করে বের হলো নতুন সকাল আদিরশ্মি কণাগুলি ছুটে গেলো দ্রুতগতি মেঘে মেঘে ফুটে আছে ভোরের জ্বলন্ত রোদ ভূপ্রকৃতিজুড়ে; এ রকম পরিবেশে প্রকৃতির পাতাগুলি সতেজ সবুজ রূপ নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায় প্রকাশ্য আঙ্গিনায়। বাইরের পরিবেশ যতটা ¯িœগ্ধ হতে পারে- সেরকম আমাদের চোখে সেরকম প্রকৃতি উজ্জ্বল অম্লাণ! তবু কিছু ঘটে যায় প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে প্রতিদিন তবু কিছু লেখা হয় আকাশের নীলে মেঘের ডানায় লতাগুল্ম তৃণলতা বেড়ে ওঠে ভোরে সূর্যসকালে ন¤্র পাতাগুলি খুলে ধরে সবুজ-স্বভাব তবু কিছু পাতা ঝরে; প্রতিদিন মরাপাতা ঝরে পড়ে ঘাসে তবু কালবৈশাখীর তা-বে সবুজ সতেজ কিছু পাতা বিপর্যস্ত হয়; এইভাবেÑ মানুষের, প্রকৃতির, বৃক্ষদের, পাতাদের জীবনকাহিনী লেখা হয়। কত পাতা ঝরে পড়ে তার কোনো হদিস থাকে না আমাদের সতেজ সবুজ পাতা ঝরে গেলে বুকে বড় লাগে! মধ্যরাতের পেট ফুটো করে যে-সকাল রৌদ্র বিছিয়েছে পাহাড়ে পাহাড়ে, দেশে দেশে, বাগানে বাগানেÑ কোটি আলোবর্ষ দূরে রোদের বিভায় আজো স্পষ্ট হয় পাতাঝরা দুপুরের তপ্ত দৃশ্যাবলি আমাদের চোখে। আমরা সে-ঝরাপাতার মর্মর শুনে কখনো ব্যথিত হই। এই প্রকৃতির কোলে সূর্যের তীর্যক রেখায় এইসব পাতার মর্মর ধ্বনি শুনতে শুনতে ভাবিÑ গতকাল আমারও শরীর যদি প্রকাশ্য মর্মরে মিশে যেতো আমিও প্রকৃতিলগ্ন পাখি হয়ে হয়ত উড়তাম পুবাকাশে; ঝরা পল্লবের মর্মরে যেরকম ভেসে বেড়াচ্ছে দিকে দিকে মরমিয়া সুর বাতাসের কানেÑ কালবৈশাখীর ঝরে বৃন্তচ্যুত সেইসব পাতাদের জন্য আমি লিখে যাচ্ছি ভোরবেলা সকরুণ শোকগাথা নিজস্ব নিয়মে। ** মানুষ শেখ আতাউর রহমান মানুষকে চেনা বড় দায় মানুষের কাছে এলে, ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কাটালে তবেই তাকে চেনা যায় ক্ষুদ্রতা ও মহত্ত্ব মিলিয়েই মানুষ-নারী ও পুরুষ ‘এরর ইজ হিউম্যান’ কথাটা মনে রেখো হারিওনা কা-জ্ঞান মানুষই মানুষের শেষ আশ্রয় মানুষকে মানুষের কাছে ফিরে আসতেই হয় শেষাবধি তাই মানুষই মহান!! ** আমাদের প্রথম বর্ষবরণ মারুফ রায়হান রমনার বটমূলে দুজনার প্রথম বর্ষবরণ আমাদের প্রথম যৌথ পহেলা বৈশাখ পথে-পথে আজ একাত্তরের সুবাস, বর্ণমালার পাপড়ি প্রথম প্রেমে পড়া কিশোরের মতো আমি উৎকণ্ঠিত আমি শিহরিত তুমি আসছো নগরীর পশ্চিম প্রান্ত হতে সর্বউত্তরের উত্তরা নামের গ্রাম থেকে আমি সূর্যোদয়ের আগে আমরা ঠিক পৌঁছে যাব এই আমাদের অলিখিত অঙ্গীকার দেখা হওয়া মাত্রই আমাকে সুযোগ না দিয়ে তুমি আগে সম্ভাষণ জানাবেÑ শুভ নববর্ষ আমি বলতেই পারতাম ‘স্বাগত নব হর্ষ’ অথচ প্রত্যুত্তর দেবার কথা ভুলে তোমার কপালে সদ্যফোটা সূর্যের সঙ্গে পুবের প্রকা- ওই গোল টিপ মিলিয়ে দেখছি তখন বিমূর্ত বেলিতে নক্শা-তোলা বুঝি তোমার আঁচল তোমার রঙধনু চুড়ি নিভৃতে গাইছে গুনগুন তুমি চোখ নাচিয়ে বলবে: এইমাত্র এলেন বুঝি আমি তো সেহরি খেয়েই বেরিয়ে পড়েছি মিস করলেন লাইসার গান; আমি বলবো, আচ্ছা বলতে পারেন ইফফাত আজ গাইবেন কিনা? আমরা সামনাসামনি আপনি বলি আর মনে মনে তুমি, পরস্পর হাত ধরি না বটে, তবু কি নেই অদৃশ্য ছুঁয়ে থাকা! শাহবাগ আমাদের আহ্বান করে, আমরা এগোই ঋষিজের মঞ্চ কি আছে আজ? নেই হায় ফকির আলমগীর তোমাকে বলি: ওই উদ্যানে আমরা যারা কবিতা পড়তাম সেই কবিদের ভেতর আজ নেই অনেকেই, তাঁরা নেই... তুমি দৃঢ়তায় বলো, এখনও আমরা আছি যতক্ষণ আছি যেন একসঙ্গে প্রাণ ভরে সৃজনে আনন্দে বাঁচি সুস্মিত সান্ত¡না পেয়ে আমি তাকাই তোমার দিকে তোমার মুখের হাসিতে তখন জ্বলজ্বল করছে বাংলা নববর্ষ আর শোভাময় পহেলা বৈশাখ ॥ ** পলেস্তারা- মেঘ তারিক-উল ইসলাম শুধু তোমাকে নিয়ে নয়। আমাকে নিয়েও নয়। সঘন-মেঘ আকাশ নিয়েও নয়। পাখি নিয়ে? না, তাও নয়। ফুল নিয়েও নয়। হেসে-ভেসে চলা রোদ নিয়েও নয়। -হতে পারে নদী-জলস্রাত! হতে পারে ডাল ছুঁয়ে দুলতে থাকা গাছের একাকী পাতা! না, না, তাও নয়। আপাতত ভাবছি বোশেখ নিয়ে। ভাবছি রিনিঝিনি কাচের চুড়ি নিয়ে। সবুজ স্বদেশ পতাকার মধ্যে লালরং সূর্যবৃত্ত টিপ নিয়ে। অবারিত ফসলের মাঠ নিয়ে। কিশোরের হাতে থাকা মেলার বাঁশি নিয়ে। চুমকিমাখা কিশোরীর মুখ নিয়ে। ভাবনা আছে ধু-ধু প্রান্তর নিয়েও। -কেন? কি সেই ভাবনা? শুরু মহামারী দিয়ে। অবশ্য মহামারীর চেয়েও ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে, এমন আন্দাজ করা যাচ্ছিল আগে থেকেই। শেষ হয়নি সেই যন্ত্রণা। জনপদ জেগে ওঠার পর থেকেই আজকাল ফের বুকের মধ্যে ঘাতকের ছুরি শানানোর শব্দ শুনি। আঁচড়ে হতশ্রী টিপ। জেল ঘুরে আসা বিজ্ঞানের শিক্ষক। মুখ না দেখানো নারীর ছবি। মুক্ত চরাচরে ঘরবন্দী সেই মানুষ। এই বোশেখে মাছি খায় মেলার বাতাসা, মুড়কি, মুরালি। নেই মানুষ। ফানুসের মতো ওড়ে ভয়। মেঘে বিদ্যুৎ নেই। বৃষ্টি নেই। রোদে উত্তাপ নেই। স্থিরচিত্র পাখি। কোথায়ও উড়াল নেই। চুড়িতে শব্দ নেই। বাঁশিতে সুর নেই। চুমকির রং নেই। নাগরদোলায় কথা নেই। সার্কাসের সঙ, তাও নেই। মাঝে মধ্যে দেখা যায় হাঁসের গ্রীবার মতো আশ্চর্য রণপা। চিনি না কাউকেই। ভাবছি বোশেখ নিয়ে। বোশেখটা ঠিক আর বোশেখের মতো নেই। -নেই। নেই। নেই! মৃত মাছের আঁশের মতো ভাসে আমাদের উৎসব। সঘন মেঘে জল নেই। বাতাস নেই। মেঘ যেন আমাদের শৈশবের মতো, কৈশোরের মতো পলেস্তারা-সুরকির ধুলো হয়ে ঝরে। ** এমন একটি বোশেখ কি নেই... রাহমান ওয়াহিদ ভুবন কাঁপানো ঝড়ের মুখ কখনও দেখিনি শৈশবের খর রোদ্দুরে কেবল একটি মিছিল দেখেছি টগবগে সে আগুন মিছিল কী দারুণ ফুলকি ছড়িয়ে মিশে গ্যালো মেঠো সড়ক হয়ে ঘন জন অরণ্যে! তারপর সেই সব ফুলকি হলো পোড়া বুনো ঘাস তারপর কুয়াশার মতো দীর্ঘ হলো ঘন দীর্ঘশ্বাস। তারপর আর কোন মিছিল এল না এই ধূসর শহরে তারপর কোন নদীও স্থির হলো না ক্লিন্ন নহরে। আহা! এমন একটি বোশেখও কি নেই, যে আমার সমস্ত চৈতন্য জুড়ে নাচাবে অসুর দানব অথবা আমাকেই বানিয়ে দেবে ছায়া বৃক্ষ পাখির নয়তো দানবেরই প্রতিশব্দ কোন অনমিত মানব? ** বৈশাখ আলম মাহবুব সকাল-সন্ধ্যা অর্কেস্ট্রা বাজে বৈশাখের ভোরের দরোজায় কড়া নাড়ে রোদ দীর্ঘশ্বাস ওঠে অসুখী পাতায় জং ধরা হাড়ে আড়াল সুতো কাটে নকল মুখ, আতঙ্কের প্রচ্ছায়ায় বটের শেকড় টাইম ওয়াচের হৈ চৈ পাখনার নীচে। বিষাদিত কুসুমেরা বিভোর হলে প্রাণোচ্ছল নাচে নির্জনতার ফণা জঞ্জাল উড়িয়ে নেয় বৈশাখী ঝড়ের হাওয়া। চন্দ্রের অসুখে নদী ডুবে যায় দিকচিহ্নহীন ওড়ে বিহ্বল প্রজাপতি। ** শূন্যতা সানজিদা সিদ্দিকা এই শূন্যতা, অন্ধকার, একা একটি ঘর সব কিছুই জিনের ভেতর অসীম শূন্যতায় আমার জন্ম সব কিছু পেয়েও থাকে অপূর্ণ। এই দীর্ঘশ্বাস, দুঃখের কোলাজ সব কিছুই জীবনের ক্যানভাস; বার বার এঁকে যাই, রং ঘষে রং সাজাই মুখের আদলে মুখোশ বসাই। দিন শেষে- জীবন পাতাঝরা বৃক্ষের মত শূন্য।
×