ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে কৃতজ্ঞ জাতির শ্রদ্ধা নিবেদন

প্রজন্মের গণজাগরণ

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:২৯, ২৬ মার্চ ২০২৪

প্রজন্মের গণজাগরণ

ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান

দেশের পথে প্রান্তরে পত পত করে উড়েছে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা। আর এ পতাকা জানান দিয়েছে একটি স্বাধীন দেশের জন্মদিনের কথা। যে দেশটি অর্জনে ত্রিশ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। জাতি রাষ্ট্রের জন্মের ৫৩ বছর পূর্তির দিনে বর্ণিল আয়োজনে উদযাপন করেছে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি, যে দেশের মানুষের সামনে এখন সোনালি ভবিষ্যৎ।

তাই দেশের জন্মদিনে এক অন্যরকম স্বস্তি, আনন্দ ও শপথে জেগে উঠেছিল বাঙালি। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার ৫৩ বছর পূর্ণ হওয়ার ঐতিহাসিক দিনে মঙ্গলবার স্বাধীনতার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যয় জানিয়েছে বাংলাদেশ। 
জাতি রাষ্ট্রের জন্মের দিনটি বর্ণিল আয়োজনে উদযাপন করেছে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি। সারাদেশেই নতুন প্রজন্মের অভূতপূর্ব গণজাগরণ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবারের স্বাধীনতা দিবসে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তস্নাত লাল-সবুজের পতাকা হাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে-স্বাধীনতাবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদমুক্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যাশার কথা।

কালরাতের আঁধার পেরিয়ে আত্মপরিচয় অর্জন ও পরাধীনতার শিকল ভাঙার দিনটি বাঙালি জাতি হৃদয়ের গভীরতা থেকে শ্রদ্ধার সঙ্গেই পালন করেছে নানা অনুষ্ঠানমালায়। স্বাধীনতা দিবসে জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছে বাংলাদেশ নামক জাতির রাষ্ট্রের সুমহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতি পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ৫৩ বছর পূর্ণ করা বাংলাদেশে এবার স্বাধীনতা দিবস এসেছে নতুন অনুষঙ্গ নিয়ে। গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনকে বানচাল করে দেশকে আবারও অন্ধকারের দিকে ধাবিত করতে অনেক চেষ্টা করেছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ও তাদের মিত্র বিদেশী কিছু রাষ্ট্র। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি বাঙালি জাতি বীরের জাতি। স্বাধীনতাবিরোধীরা বারবার পরাজিতই হবে, ওই নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে তা আবারও বুঝিয়ে দিয়েছে বাঙালি জাতি।

বিএনপি-জামায়াত অপশক্তির সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় বসিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বাদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে। 
তাই এবারের স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযুদ্ধের সব পক্ষ শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে এসব অপশক্তিকে বিতাড়িত করার নতুন শপথে বলীয়ান হয়েছে। তাদের চোখেমুখে ছিল সামনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে আরও এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণে প্রতিটি অনুষ্ঠানেই ছিল স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিষদাঁত ভেঙে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃঢ় শপথ।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ঢাকা পুরাতন বিমানবন্দর (তেজগাঁও) এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি আর্টিলারি রেজিমেন্টের ৬টি গান ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধে বীর শহীদদের প্রতি গান স্যালুট প্রদর্শন করে। 
শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের ঢল নেমেছিল সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধুর বাসভবন এবং টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর মাজারে।

রাস্তায় বের হওয়া শিশু-কিশোর ও তরুণদের হাতে শ্রদ্ধার ফুল, কারও গালে কিংবা কপালে আঁকা ছিল রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা, প্রিয় মাতৃভূমির মানচিত্র। তরুণ প্রজন্মের ছেলেদের গায়ে জাতীয় পতাকা সদৃশ শর্ট পাঞ্জাবি বা গেঞ্জি এবং মেয়েদের পরনে লাল-সবুজের মিশ্রণে জাতীয় পতাকার মতো শাড়ি। সবাই অংশ নিয়েছিলেন এবারের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আনন্দ-উৎসবে।

রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠে তরুণ প্রজন্মরা শুনেছে তাঁদের বীরত্বগাথা ইতিহাস, জেনেছে একাত্তরে রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের গণহত্যা, মা-বোনদের সম্ভ্রমহরণ ও বুদ্ধিবীজীদের হত্যার কালো ইতিহাস। 
শুধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাধারণ মানুষই নয়, তরুণ প্রজন্মের চোখে-মুখে স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তীব্র স্বাধীনতা বার্ষিকীর  ঘৃণা-ধিক্কারের বহির্প্রকাশ ঘটেছে সর্বত্র। রাজধানী থেকে শুরু করে শহর-বন্দর-গ্রামে দেশের ৫৩তম জন্মদিনের প্রতিটি অনুষ্ঠানে নতুন প্রজন্মের ব্যাপক উপস্থিতি, তাদের চোখে-মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখার দৃপ্ত শপথ আর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার প্রচ-তা প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ। নতুন প্রজন্মের এমন গণজাগরণ আশাবাদী ও সাহসী করে তুলেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে। 

রাজনীতিক থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই দৃঢ় আশাবাদী- ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নতুন প্রজন্মের এমন জাগরণ জানান দিচ্ছে, যতই ফণা তোলার চেষ্টা করুক, জঙ্গিবাদ-সাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রবিরোধী অন্ধকারের শক্তির দিন শেষ। যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের নির্মূল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন এক জন্মভূমির যাত্রা শুরু হবেই।’
আনন্দ, বেদনা ও বিনম্র শ্রদ্ধায় মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণ এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদমুক্ত অসাম্প্রদায়িক স্বনির্ভর সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার বাঙালি জাতি অন্যরকম স্বস্তি ও উৎসবের আমেজে পালন করল মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস।

শ্রদ্ধাবনত জাতি ফুলে ফুলে ভরে দেয় সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি এবং টুঙ্গিপাড়ার বঙ্গবন্ধুর মাজারের বেদিমূল। লাল-সবুজ পতাকা হাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে একই সেøাগান- ‘মুজিবের বাংলায়, স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গিদের ঠাঁই নাই, জামায়াত-শিবির-রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়।’ 
তবে স্বাধীনতা দিবসে আনন্দমুখর এ উৎসবে বরাবরের মতো এবারও অন্তস্রোতে বয়ে গেছে স্বজন হারানোর বেদনা। আর বাঙালির জাতীয় জীবনে আনন্দ-বেদনার এমন দ্বৈরথের ঘটনা খুব বেশি নেই। বাঙালি জাতি আনন্দ আর বেদনার মহাকাব্য স্বাধীনতার সংগ্রামে একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সাহসিকতা আর হাজারো নারীর আত্মত্যাগের বীরত্বগাথা। অন্যদিকে বর্বর পাকসেনা আর রাজাকার-আলবদরদের নীচুতা, শঠতা ও হিংস্রতার কলঙ্কময় ইতিহাস। 
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় ৫৩ বছর আগের এ দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর দমন অভিযানের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ ভূখ-ের মানুষ। তার পরের ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর চক্র চালিয়েছে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। তাই স্বাধীনতা দিবসের এই দিনে দেশবাসী শ্রদ্ধা আর বেদনায় স্মরণ করে যুদ্ধে নিহত স্বজনদের আর অসম লড়াইয়ে বিজয়ী রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।

ঢাকাসহ সারাদেশে প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হয়। বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের জন্মের দিনে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে জাতির বীর সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ সফররত ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক। বরাবরের মতোই রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটি পালন করা হয়েছে জাতীয় দিবস হিসেবে। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং ভুটানের রাজা ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। 
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকস দল এই সময় রাষ্ট্রীয় সালাম জানায় এবং বিউগলে করুণ সুর বাজানো হয়। রাষ্ট্র প্রধান, সরকারপ্রধান এবং ভুটানের রাজাও স্মৃতিসৌধে রাখা দর্শনার্থী বইতে স্বাক্ষর করেন। পরে দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাঁর দলের পক্ষ থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে আরেকটি পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।
এ সময় জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত এম এনায়েতুর রহিমসহ, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, কূটনীতিক, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি এবং পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিও জাতীয় স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
মঙ্গলবার ছিল সাধারণ ছুটির দিন। সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তোলা হয় জাতীয় পতাকা। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপগুলো বর্ণিল সাজে সাজানো হয়। গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় গত কয়েক দিন ধরেই চলছে আলোকসজ্জা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ফেডারেশন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। 
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনায় দোয়া-প্রার্থনার পাশাপাশি মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিভিন্ন ঘাটে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের জাহাজগুলো সাধারণের দেখার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়।
স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল ॥ সাভার থেকে আমাদের প্রতিনিধি অঙ্গন সাহা জানান, মঙ্গলবার ৫৪তম মহান স্বাধীনতা দিবস পালন করলো জাতি। এদিন ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদি। একইসঙ্গে দেশাত্মবোধক গান ও মুহুর্মুহু স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠছিল স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ। শ্রদ্ধায় অবনত জাতি এদিন আবারও স্মরণ করেছে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানদের।

বাঙালি জাতির গৌরব ও অহংকারের এই দিনে ভোর ৫টা ৫৭ মিনিটে প্রথম প্রহরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে প্রথমে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। একই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। এ সময় তিন বাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। সেই সঙ্গে বিউগলে করুণ সুর বাজানো হয়। পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে তারা মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদ বেদিতে আরেকটি পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। 
এর পর রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও ভুটানের রাজাসহ মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণ এবং কূটনীতিকরা স্মৃতিসৌধ এলাকা ত্যাগ করার পর স্মৃতিসৌধ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার জণ্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে মানুষের ঢল নামে। ভোর থেকে স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করার জন্য যারা অপেক্ষা করছিলেন তারা তাদের ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে বেদিমূলের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।

বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের লোকজন সুশৃঙ্খল ও সারিবদ্ধভাবে স্মৃতিসৌধ বেদিতে পর্যায়ক্রমে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ করতে থাকেন । এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও পরিবেশ সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল রাখার জন্য সাহায্য করে।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), তৃণমূল বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি, সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশ কংগ্রেস, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা লীগ, গণ সংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি, জাকের পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্টসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, দুর্নীতি দমন কমিশন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও এর হলসমূহ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় ও এর হলসমূহ, সাভার গণবিশ^বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় বাংলাদেশ, ইসলামি আরবি বিশ^বিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ^বিদ্যালয়, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়, বিশ^ সাহিত্য কেন্দ্র, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলা একাডেমী, ভিলেজ এডুকেশন রিসোর্স সেন্টার (ভার্ক), সাস, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র, এডাব, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, একাত্তরের ঘাতক-দালার-নির্মূল কমিটি, জাতীয়  প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, কৃষি মন্ত্রাণালয়, বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন, সাব-এডিটরস কাউন্সিল, আশুলিয়া প্রেস ক্লাব, সাভার গণবিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বিকেএসপি, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই), পরমানু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ  পরমানু শক্তি কমিশন, পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি), বঙ্গবন্ধু কৃষি পরিষদ, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), বাংলাদেশ খ্রীস্টান এ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র, সড়ক ও জনপথ প্রকৌশলী সমিতি, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, নিরাপদ সড়ক চাই, ঢাকা জেলা প্রশাসক, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার, সড়ক বিভাগ, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ অজ¯্র সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠন এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 
ধানমন্ডিতেও কৃতজ্ঞ মানুষের ঢল ॥ স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রের সুমহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে মঙ্গলবার নেমেছিল কৃতজ্ঞ বাঙালির ঢল। দিনভর জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির সকল ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলার শপথ নেন সবাই। 
৫৪তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত তাঁর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা ও প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র ছোট বোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন।
শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। পরে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা তাঁর দলের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে আরেকবার পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় দলের জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু, বেগম মতিয়া চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের, শাজাহান খান, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, ড. হাছান মাহমুদ, মাহবুবউল আলম হানিফ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। 
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রধানমন্ত্রী এলাকা ত্যাগ করলে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য স্থানটি উন্মুক্ত করা হয়। এর পর দিনভর অসংখ্য রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়। 
দেশের জন্মদিনে স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস-২০২৪’ উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করেছেন। মঙ্গলবার সকালে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে এক অনুষ্ঠানে ১০ টাকা মূল্যের স্মারক ডাকটিকিট, ১০ টাকার উদ্বোধনী খাম এবং ৫ টাকার একটি ডাটা কার্ড উন্মোচন করেন।
অনুষ্ঠানে একটি বিশেষ সীলমোহর ও ব্যবহার করা হয়। আজ বুধবার ঢাকা জিপিওর ফিলাটেলিক ব্যুরো থেকে স্ট্যাম্প, ফাস্ট ডে কভারর্স এবং ডাটা কার্ড বিক্রি শুরু হবে। পরবর্তীতে সারাদেশের অন্যান্য জিপিও এবং প্রধান পোস্ট অফিসেও এসব পাওয়া যাবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধানমন্ত্রীর স্মারক উপহার ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস-২০২৪’ উপলক্ষে দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী অতীতের মতো এবারও তার শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরুপ রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার গজনভী রোডে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন কেন্দ্রে (মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার-১) যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য ফুল, ফল ও মিষ্টি পাঠান। প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস)-২ গাজী হাফিজুর রহমান লিকু এবং সহকারী প্রেস সচিব এবিএম সরওয়ার-ই-আলম সরকার তাঁদের হাতে উপহার সামগ্রী তুলে দেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান এবং প্রতিটি জাতীয় দিবস এবং স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ঈদ ও পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবে তাদের স্মরণ করার জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যার দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেন এবং দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য সন্তোষ প্রকাশ করেন। তাঁরা নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশের প্রান্তিক জনগণ ভালো থাকে এবং তাদের পরিবারসহ মুক্তিযোদ্ধারা ভালো থাকে বলে তারা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ধিত ভাতা, চিকিৎসাসেবা এবং বাসস্থান প্রদানের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

তাঁরা বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা মনে করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একদিন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত, সমৃদ্ধ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রধানমন্ত্রীর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন।

×