ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বিএনপি শিবিরে হতাশা

চাঙ্গা আওয়ামী লীগ

শরীফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:০২, ১৩ জুন ২০২৩

চাঙ্গা আওয়ামী লীগ

গাজীপুরের পর বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত

গাজীপুরের পর বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হওয়ায় দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই তিন সিটির ভোটের পরিবেশ দেখে দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকরাও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা উৎফুল্ল। তাদের মধ্যে চাঙ্গাভাব দেখা দিয়েছে। বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ না নিলেও তাদের সকল আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে সুষ্ঠু ভোট করতে পারায় সর্বমহলে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তাই বিএনপি শিবিরে হতাশা বিরাজ করছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নির্বাচন কমিশনও (ইসি) স্বস্তিতে রয়েছে। 
সিটি করপোরেশন নির্বাচন শুরুর আগেই বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল থেকেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। তবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়, যে কোনো মূল্যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে করা হবে। এজন্য তিন সিটির নির্বাচনের সময়ই পুরো নির্বাচনী এলাকায় তিনস্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। কেন্দ্রে কেন্দ্রে রাখা হয় সিসি ক্যামেরা। ভোটগ্রহণকালে আগারগাঁও নির্বাচন ভবন থেকেই সিসি ক্যামেরায় ভোট পর্যবেক্ষণ করা হয়। কোথাও কোনো অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নেওয়া হয় ব্যবস্থা। আর এভাবেই সর্বমহলে আস্থার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ইসি। 
দলীয় সরকারের অধীনে ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না বলে জানিয়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে বিরত থাকে বিএনপি। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে তিন সিটিতে কাউন্সিলর পদে শতাধিক স্থানীয় নেতা নির্বাচন করে। এর মধ্যে বেশ ক’জন বিজয়ীও হয়। নির্বাচন কমিশন কঠোর অবস্থানে থেকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করে। যদিও বিচ্ছিন্নভাবে বরিশালে একজন প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। তবে ইসির নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। 
নির্বাচন কমিশনের কঠোর পদক্ষেপ এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোর তৎপরতার কারণে তিন সিটির নির্বাচনেই সার্বিক পরিস্থিতি ছিল সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুকূলে। তাই বিএনপিসহ বিভিন্ন মহলের আশঙ্কা থাকার পরও সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তিন সিটির নির্বাচনই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস আগে তিন সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এই নির্বাচনের ঢেউ সেই নির্বাচনে পড়বে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। 
২৫ মে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন (ইসি) অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে ভোট করে আস্থার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। এই সিটির ভোটগ্রহণ নিয়ে কোনো প্রার্থীই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করতে পারেননি। এমনকি কোনো রাজনৈতিক দল বা নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও কোনো অভিযোগ আসেনি। এটা বর্তমান ইসির জন্য বিশাল অর্জন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমতউল্লাহ খান পরাজিত হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে অভিনন্দন জানান।

বিজয়ী মেয়রও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমতউল্লাহ খানকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার সহযোগিতা চান। যা দেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নির্বাচন কমিশনের জন্যও এ বিষয়টি ইতিবাচক। তবে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হওয়ার পরও ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব হওয়ায় এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নির্বাচন কমিশন থেকে অবশ্য জানানো হয়, অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করে নির্ভুল ভোটের হিসাবসহ ফল ঘোষণা করতে গিয়ে বিলম্ব হয়েছে।
১২ জুন বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। খুলনায় শতভাগ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হলেও বরিশালে বিচ্ছিন্নভাবে একটি কেন্দ্রে হাতপাখার মেয়র প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় কিছুক্ষণের জন্য পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকলেও পরে তা নিয়ন্ত্রণে আনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর ফলে দুপুরের দিকে এ ঘটনা ঘটলেও বিকেল পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট সম্পন্ন হয়। ইভিএমে ভোট গ্রহণে কিছুটা ধীরগতি হওয়ায় বিকেল ৪টার পরও কেন্দ্রে উপস্থিত ভোটারদের ভোট নেওয়া হয়। এই সিটিতে ভোট পড়ে শতকরা ৫১ দশমিক ৪৬ ভাগ। বরিশালে মেয়র নির্বাচিত হন  আওয়ামী লীগের আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। তিনি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হাতপাখার মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমকে ৫৩ হাজার ভোটে পরাজিত করেন।

আর খুলনা সিটি করপোরেশনে হাতপাখার প্রার্থী আব্দুল আউয়ালকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের তালুকদার আব্দুল খালেক। তবে ইসলামী আন্দোলন দুই সিটির ফলাফল প্রত্যাখ্যান ও ২১ জুন অনুষ্ঠিতব্য সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরও ইসলামী আন্দোলনের এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক। তবে তাদের এ সিদ্ধান্তের কারণে সিটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হবে না। কারণ, সারাবিশ্বেই নির্বাচনে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে থাকে। 
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, খুলনা, বরিশাল ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা ছিল বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে ইসির প্রত্যাশা ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন। তাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। কারণ, বরিশালের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ভোটগ্রহণ নিয়ে কোনো প্রার্থী, নির্বাচন পর্যবেক্ষক কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলই অভিযোগ উত্থাপন করতে পারেননি। 
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন যেভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে সেটাই হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মডেল। তবে সিটি নির্বাচনের মতো জাতীয় নির্বাচন ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হবে না বিধায় সেখানে পরিস্থিতি কিছুটা অন্য রকম হতে পারে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের সময় আরও বেশি সতর্ক থাকবে বলে জানা যায়। 
বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিএনপি ও তাদের সমমনা দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই ইসির পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আর এই ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বলতে থাকে সুষ্ঠু নির্বাচন করাই তাদের চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের প্রথম পরীক্ষা দেন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও ফলাফল ঘোষণায় বিলম্বসহ ছোটখাটো কিছু ঘটনা নিয়ে ইসির বিরুদ্ধে সামান্য সমালোচনা হয়। তবে এর পর ইউপিসহ কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কিছু সহিংস ঘটনা ঘটায় সমালোচনার মুখে পড়ে ইসি। কিন্তু জাতীয় সংসদের গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়ম হওয়ায় ওই নির্বাচন স্থগিত করার পর আবারও সুষ্ঠু নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে ইসি নিজেদের ইমেজ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। 
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে আন্দোলন করতে থাকায় এবং জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিতের আহ্বান জানানোর পর ইসি নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে অধিকতর সতর্ক হয়। এরই অংশ হিসেবে জাতীয় নির্বাচনসহ সকল নির্বাচন সুষ্ঠু করতে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করে। তিন সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে তারা দেশী-বিদেশী মহলের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়। 
তিন সিটি নির্বাচনের দিনই পুরো এলাকা ছিল নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। তাই বরিশালের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আর কোনো সংঘর্ষ বা হতাহতের ঘটনা ছাড়াই এ নির্বাচন শেষ হয়। সব কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট হয়। সকল প্রার্থী স্বস্তিতে ভোট দিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট হওয়ার কথা জানান। ভোটাররা নিজ নিজ কেন্দ্রে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট প্রদান করেন। ফলাফল ঘোষণার সময়ও  পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর। 
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে বলেন, শান্তিপূর্ণ ও আনন্দমুখর পরিবেশে সিটি নির্বাচনে ভোট হয়েছে। সিটি নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিও সন্তোষজনক বলে তিনি জানান। 
নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সবার প্রচেষ্টায় নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ভোটার উপস্থিতিও আশানুরূপ ছিল। 
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, বরিশাল সিটিতে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনা প্রমাণ করে এই সরকার ও ইসির অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আমরা আগে থেকেই বলে আসছি, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাব না। 
সিটি নির্বাচন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপি ভোট বর্জন করলেও জনগণ করেনি। তাই বরিশাল ও খুলনা সিটিতে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পড়েছে। ভবিষ্যতেও বিএনপি ভোট বর্জন করলে জনগণ ব্যাপকভাবে ভোট প্রদান করবে। তাই সিটি নির্বাচন থেকে বিএনপির শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।

×