ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করলেও বাঙালীকে দাবিয়ে রাখা যায়নি ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১৫ অক্টোবর ২০১৮

 বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করলেও বাঙালীকে দাবিয়ে রাখা যায়নি ॥ প্রধানমন্ত্রী

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া/ মুন্সীগঞ্জ থেকে ॥ ড. মুহম্মদ ইউনূূসের প্ররোচণায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। ড. ইউনূুস বেআইনীভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে ছিলেন। তাকে বলার পরও তিনি সরলেন না। উপদেষ্টার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে উল্টো সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করলেন। মামলায় হেরে আমেরিকায় চলে যান। সেখানে তার প্ররোচণায় তখনকার বিশ্বব্যাংক প্রধান এ প্রকল্পের অর্থ বন্ধে অর্ডার দিয়ে যান। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে দেশী-বিদেশী অনেক হুমকি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ষড়যন্ত্রও মোকাবেলা করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে যেমন বলেছেন, দাবিয়ে রাখ যাবে না। বাঙালীকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। বাংলাদেশকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু আজ বাস্তায়নের পথে। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে রবিবার পদ্মা সেতুর নামফলক উন্মোচনের পর এক সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের আইনে আছে, ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যাংকের এমডি থাকতে পারবেন। কিন্তু ড. ইউনূস কোন অনুমোদন ছাড়াই ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত অর্থাৎ ১০ বছর বেশি এমডির পদে থাকেন। সব সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করেন। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তাকে একটি চিঠি দেয়া হয়। অর্থমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী- এই দুজন ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাকে বলা হয়, আপনি ব্যাংকের ইমেরিটাস এ্যাডভাইজার হিসেবে থাকেন। কিন্তু তিনি আমাদের কথা শুনলেন না। তিনি দুটি মামলা করলেন। কোর্ট তাকে বলল, আপনার এমডি থাকা আইন অনুমোদন করে না। আপনি এ পদে থাকতে পারবেন না। তিনি বলেন, ওই সময় হিলারি ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি আমায় ফোন করলেন। টনি ব্লেয়ার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার স্ত্রী শেরি ব্লেয়ারও আমাকে ফোন করলেন। আমি তাদের বললাম- এটা তো আইনে পড়ে না। আমরা তাকে সম্মানজনক প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি রাখলেন না। এটা কোর্টের বিষয়, সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে কিছু বলাও হয়নি। তিনিই মামলা করে হেরেছেন। আমাকে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে ইউনূসকে সরালে পদ্মা সেতু হবে না। নোবেল পেয়ে গেছেন কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির পদের লোভ ছাড়তে পারেন না তিনি। এরপর একটি পত্রিকার স¤পাদক ও ইউনূস আমেরিকায় যান এবং হিলারি ক্লিনটনকে অনুরোধ করেন। তখন বিশ্বব্যাংকের বোর্ডসভায়ও আলোচনা হয়। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু বিশ্বব্যাংক প্রধান তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের দিন পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন বন্ধের অর্ডার দিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধের পেছনে ছিলেন ড. ইউনূস। তার মধ্যে যদি দেশপ্রেম থাকত তাহলে কী করে তিনি দেশের এত বড় ক্ষতি করেন? কিন্তু অর্থায়ন বন্ধ করে তারা দুর্নীতির ধোঁয়া তুলল। তাদের একজন অফিসার বাংলাদেশে এসে বলে গেলেন, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে। আমরা প্রমাণ চাইলাম। কিন্তু তারা তা দেখাতে ব্যর্থ হয়। ঘোষণা দিলাম নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে। শেখ হাসিনা বলেন, এই প্রকল্প নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে নানা দুর্নাম রটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমার ছেলে জয়কে আমেরিকার তদন্ত সংস্থা ডেকে নিয়েছে। জয় বলেছে- আপনারা দেখেন কোথায় কি হয়েছে? রেহানার দিকেও আঙুল তোলা হয়েছে। কিন্তু তারা কোথায়ও কিছু পেল না। এরপর সব কিছু ভুল প্রমাণিত করে কানাডার ফেডারেল কোর্ট বলে দিয়েছে, এ প্রকল্পে কোন দুর্নীতি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন বন্ধের পেছনে যে অপমান করা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে হেয় করা হয়েছে অথচ এর পেছনে উস্কানিদাতা আমার দেশেরই লোক। এদের কোন দেশপ্রেম থাকতে পারে না। গরিবের টাকায় সুদ খেয়ে যারা বড় লোক হয় তারা দেশের মানুষকে কখনও ভালবাসতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমি সমর্থন দিয়েছি। গ্রামীণ ফোনের লভ্যাংশ গ্রামীণ ব্যাংক পাওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে দরিদ্র মানুষের জন্য সেই টাকা ব্যয় করার কথা ছিল। কিন্তু ফোনের কোন লভ্যাংশ গ্রামীণ ব্যাংক পায়নি। শেখ হাসিনা বলেন, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দেয়ার পর দেশের মানুষ আমাকে সাহায্য করেছে। অনেকেই মনে করত বাংলাদেশ একটি দুর্যোগের দেশ, তাদের পক্ষে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ছাড়া পদ্মা সেতু করা সম্ভব নয়। আমি একটা কথা বিশ্বাস করি- বাংলার জনগণের ওপর আমার ভরসা ছিল। সেটা নিয়েই আমি এ প্রকল্পের কাজ শুরু করেছি। এখন পদ্মা সেতুর ৬০ শতাংশ কাজ হয়েছে। নদী শাসন করে সেতুকে ছোট করতে চাইনি। যতটুকু আছে সেটাই করা হচ্ছে। এখন ৭৫০ মিটার সেতু দৃশ্যমান হয়েছে। এটা কঠিন কাজ। যারা এর সঙ্গে স¤পৃক্ত তাদের ধন্যবাদ জানাই। তিনি বলেন, জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। সেই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করা, স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করা, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা আমার একমাত্র লক্ষ্য, আমার একমাত্র চাওয়া। আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন, এই পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে- বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যারা নষ্ট করতে চেয়েছিল, বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে যারা বাধা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল, বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্যসীমা অতিক্রমের পথ যারা বন্ধ করতে চেয়েছিল তাদের উপযুক্ত জবাব আমরা দেব। শেখ হাসিনা বলেন, পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের জন্য সুন্দর জীবন, ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত জীবন, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলব। আমরা ইতোমধ্যে সব সময় ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি, পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে আরও ৮ দশমিক ২ শতাংশ বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে। বলা যায়, আমরা দুই ভাগ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারব। পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে আমাদের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করতে খুব একটা কষ্ট হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম ও ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে এই দেশ আমরা স্বাধীন করেছি। এই বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল, বাংলার প্রতিটি মানুষ অন্ন ,বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার সুযোগ পাবে। উন্নত জীবন পাবে এটাই ছিল তাঁর স্বপ্ন। সাড়ে তিন বছরের মধ্যে একটা যুদ্ধবিধস্ত দেশকে গড়ে তুলে তিনি উন্নয়নের পথে যখন অগ্রযাত্রা শুরু করলেন, মানুষ উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল, সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। এর পরে আমরা দেখেছি হত্যা ও ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে হয়ত মুষ্টিমেয় লোকের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছিল, কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠী অবহেলিত। মানুষের পেটে খাবার ছিল না, পড়নে ছিন্নবস্ত্র, বিদেশ থেকে পুরনো কাপড় এনে দেয়া হতো, একবেলাও খাবার পেত না এমন বহু পরিবার। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই তো স্বাধীনতা। স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া, এটাই হচ্ছে আমাদের কর্তব্য। প্রধানমন্ত্রী সেতু নির্মাণের প্রথমদিককার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমাদের দক্ষিণ অঞ্চল অনেক অবহেলিত। যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত করুণ। আমি সরকার গঠন করার পর যখন জাপান গিয়েছিলাম, জাপানের প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন আমার দেশ উন্নয়নে কি প্রয়োজন। আমি দুটি সেতুর কথা বলেছিলাম: পদ্মা ও রূপসা সেতু। তারা সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। জাতির পিতা স্বাধীনতার পর যখন ’৭৩ সালে জাপানে গিয়েছিলেন তখন তিনি যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের কথা বলেছিলেন এবং জাপান সেখানে সহযোগিতা করেছিল। এর পরে ’৯৬ সালে আমি ক্ষমতায় এসে সেই সেতুটি নির্মাণ করি। ঠিক পদ্মা সেতুরও ফিজিবিলিটি জাপান করে দেয়। আমরা ২০০১ সালের জুলাই মাসে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি যখন আমাদের একেবারে শেষ সময়। কিন্তু পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসেছিল, তারা সেতুর কাজ বন্ধ করে দেয়। দ্বিতীয়বার আবার আমরা যখন ক্ষমতায় আসি, আবার আমরা এই সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেই। আমার ইচ্ছা ছিল একটু নতুন কিছু করা। তাই সড়কের সঙ্গে রেল সেতু সংযোগ করি। দুটি ডিজাইন আমার কাছে নিয়ে আসে। নিচে রেল ও উপরে সড়ক সেতু; এভাবে দোতলা একটি সেতুর ডিজাইন আমি পছন্দ করে দেই। সঙ্গে সঙ্গে অনেকই এগিয়ে আসে। সুধী সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সেতু ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় স্বাগত বক্তব্য রাখেন রেলমন্ত্রী মোঃ মুজিবুল হক। বক্তব্য রাখেন সেনাবাহিনী প্রধান আজিজ আহমেদ। মঞ্চে ছিলেন মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ মোঃ মহিউদ্দিন, মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ শেখ লুৎফর রহমান ও সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭ নম্বর খুঁটিতে পাইল স্থাপনের কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে মূল সেতুর কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। পদ্মা সেতুর ৪২টি খুঁটিতে ৪১টি ¯প্যান বসবে। এর মধ্যে ছয়টি স্প্যান বসেছে। ১৪টি খুঁটি বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। আর নদীতে ১৮০টি পাইল স্থাপন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জাজিরা প্রান্তে পৌনে এক কিলোমিটার সেতু দৃশ্যমান হয়েছে। আর মাওয়া প্রান্তে দৃশ্যমান হলো ১৫০ মিটার। দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানান, মাওয়া প্রান্তে ৬ ও ৭ নম্বর খুঁটি সম্পূর্ণ প্রস্তত হবার পর এই ৪ এবং ৫ নম্বর খুঁটিতে বসানো স্প্যানটি সরিয়ে নেয়া হবে। পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ কাজের উদ্বোধন ॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে নামফলক উন্মোচন ও রেলসংযোগ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের বৃহত্তম এ প্রকল্পের নির্মাণ কর্মযজ্ঞ সরেজমিন পরিদর্শন করতে বেলা সাড়ে ১০টায় ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে রওনা দিয়ে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের দোগাছির সার্ভিস এরিয়া-১ এ পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। পরে বেলা সোয়া ১১টার দিকে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়ে নামফলক উন্মোচন করেন। সেখান থেকে পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে তিনি পদ্মা সেতুর নামফলক উন্মোচন এবং মূল নদীশাসন কাজ সংলগ্ন স্থায়ী নদীতীর প্রতিরক্ষামূলক কাজেরও উদ্বোধন করেছেন। সুইচ টিপে একযোগে এই ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী মাওয়া অংশে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি এবং এন-৮ মহাসড়কের কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করেছেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, বেসরকারী বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল, মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ মোঃ মহিউদ্দিন, অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি এমপি, এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস এমপি, সেনাবাহিনী প্রধান আজিজ আহমেদ, পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম পিপিএম ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ শেখ লুৎফর রহমানসহ সেনাবাহিনী এবং মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা। ২১ জেলার সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের দুয়ার খুলবে ॥ আবুল বাশার শরীয়তপুর থেকে জানান, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুরসহ দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের দুয়ার খুলে দেবে পদ্মা সেতু। আধুনিকতার আলো দেখবে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ। আর্থ-সামাজিকতার উন্নয়ন ঘটবে তাদের। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৭ কোটি মানুষের প্রাণের দাবি স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়। বহু আকাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পার হয়ে গেলেও কোন সরকার শরীয়তপুরসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশী-বিদেশী সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সকল প্রকার বাধা আর প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সেই বহু কাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান হওয়ায় আনন্দিত দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার মানুষ। এ সেতুর কাজ শেষ হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে গোটা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অনেক মালিকানা দক্ষিণবঙ্গের বড় বড় ব্যবসায়ী। দেশের পোশাক শিল্পের কারণে রাজধানী ঢাকায় মানুষের চাপ দিন দিন বাড়ছে। পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পোশাক শিল্প গড়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে ঢাকাতে মানুষের চাপ কিছুটা হলেও কমবে। একটি বিশ^বিদ্যালয় যেমন একটি এলাকার পারিপাশির্^কতার পরিবর্তন করে তেমনি যেসব এলাকায় শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে সেখানে ব্যাপক উন্নয়ন সহায়ক হয়। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে খুলনা, বরিশালসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুবিন্যস্ত করতে পারলে ঢাকা শহরের বিপুল জনগোষ্ঠীর চাপ কিছুটা হলেও কমবে। স্বস্তি পাবে রাজধানী ঢাকাবাসী। এছাড়া অবহেলিত পদ্মাপারের মানুষ পাবে আধুনিকতার ছোঁয়া। পদ্মা সেতুর দু’পারে গড়ে উঠবে সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের আদলে বিশ^মানের শহর। দেশী-বিদেশী পর্যটক আসবে বিশে^র অন্যতম সৌন্দর্য্যম-িত এই পদ্মা সেতু দেখার জন্য। পদ্মাপারে শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে গড়ে উঠবে বিশ^মানের রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, হোটেল, মোটেলসহ বিলাসবহুল নানা প্রতিষ্ঠান। গড়ে ওঠার সম্ভাবনার তালিকায় রয়েছে বিমানবন্দরও। বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় ভরে যাবে এ এলাকা। শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে। সর্বক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে বলে আশা করেছে পদ্মাপারের মানুষ। এক সময় ৬৪তম নম্বরে থাকা অবহেলিত শরীয়তপুর জেলা হতে যাচ্ছে সোনালী সেতুর শ্যামল ভূমি। পদ্মা সেতুর জন্য বাপ-দাদার ভিটামাটি হারিয়ে যারা ভাবছিলেন সরকার তাদের ধোঁকা দিচ্ছে তারাও আজ শান্তি পাচ্ছে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান দেখে। তাদের মনে এখন আর দুঃখ নেই। পদ্মাপারের মানুষ ভাবছে এ সেতু এখন আর না হওয়ার কোন সুযোগ নেই। এদিকে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নেয়ার কারণে অবহেলিত ও অনুন্নত শরীয়তপুর জেলা এখন অর্থনৈতিক জোন হিসেবে গড়ে উঠতে সম্ভাবনার ডানা মেলতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে শরীয়তপুরের বিভিন্ন এলাকার ভূমির আর্থিক মূল্য। পাল্টে যাচ্ছে শরীয়তপুরের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো। বিশেষ করে শরীয়তপুরের গোঁসাইরহাট উপজেলার চরজালালপুর মাঝেরচর এলাকার বিশাল চরাঞ্চলকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অর্থনৈতিক জোন বা অঞ্চল হিসেবে বাছাই করে নেয়া হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যেই শরীয়তপুরসহ ১০ জেলাকে অর্থনৈতিক জোন বা অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। আর এ অর্থনৈতিক জোনের খবরে এলাকায় ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। শরীয়তপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠলে বিভিন্ন শিল্প কারখানা গড়ে ওঠাসহ শ্রমজীবী মানুষের অসংখ্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ ব্যবসায়িক কেন্দ্র গড়ে উঠবে এসব এলাকায়। সোনালী সেতুর শ্যামল ভূমির এ জেলা হবে দেশের অন্যতম ব্যবসায়িক ও পর্যটন কেন্দ্র। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যোগ দেবে এ অঞ্চলে। আর মেঘনার পারে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলে চিত্তবিনোদনের জন্য মানুষের মনে স্থান করে নেবে শরীয়তপুর জেলাকে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই বড় বড় ব্যবসায়ী এ অঞ্চলকে ঘিরে নানা পরিকল্পনা করছে। তারা সময়োপযোগী ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরি, হিমাগার, ট্যানারি শিল্প কারখানসহ নানাবিধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে জমি ক্রয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা আশা করছেন, শরীয়তপুর জেলা হবে বাংলাদেশর জন্য বিশাল একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র আর বাংলাদেশের অন্যতম সামুদ্রিক বন্দর মংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহনের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে শরীয়তপুরের সঙ্গে। এ কারণেই এ স্থানটিকে সরকার প্রাধান্য দিয়ে বাছাই করে নিয়েছে। এ ব্যাপারে শরীয়তপুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সামসুর রহমান শাহজাদা বলেন, এ জেলায় অর্থনৈতিক জোন হলে জেলার ব্যাপক উন্নয়ন হবে। মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অর্থনৈতিকভাবে এ জেলা হবে দেশের অন্যতম স্থান। জাজিরায় পদ্মা সেতুর নামফলক উদ্বোধন ॥ রবিবার দুপুরে শরীয়তপুরে জাজিরাপারে নাওডোবায় টোলপ্লাজার পাশে পদ্মা সেতুর নামফলক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর প্রধানমন্ত্রী মাদারীপুরের শিপচর কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে পদ্মাপারে জাজিরার নাওডোবাসহ শরীয়তপুরের সর্বত্র ছিল উৎসবের আমেজ। বিশ^বাসীকে তাক লাগিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর ৬০ ভাগ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসী কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাতে ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল শরীয়তপুরবাসীর। শরীয়তপুর থেকে জাজিরার নাওডোবা পযর্ন্ত ৩০ কিলোমিটার রাস্তাসহ শরীয়তপুরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সর্বত্র স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসমূহের নির্মিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের ছবিসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সংবলিত অসংখ্য ব্যানার-ফেস্টুনে সাজানো হয়েছিল শরীয়তপুর। এছাড়াও তাঁর আগমন উপলক্ষে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে শত শত সুদৃশ্য তোরণ। শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে বলেন, শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে দলীয় কর্মী-সমর্থকসহ শরীয়তপুরের হাজার হাজার জনগণ যোগদান করেছেন।
×