ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দেশে দেশে

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ৩১ মে ২০১৮

মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দেশে দেশে

হাসান নাসির ॥ মিয়ানমারে উৎপাদিত ‘ইয়াবা’র প্রধান গন্তব্য একদা ছিল পর্যটনের দেশ থাইল্যান্ড। তখনও বাংলাদেশে এ ট্যাবলেট অতটা পরিচিতি পায়নি। বিচ্ছিন্নভাবে সীমান্ত পথে কিছু এলেও তা মূলত চট্টগ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ইয়াবার ছোবলে যখন থাইল্যান্ডের যুব সমাজ ধংসের পথে, তখন কঠোর অবস্থান গ্রহণে বাধ্য হয় দেশটির সরকার। রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজের পরামর্শে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা। দিনটি ছিল ২০০৩ সালের ২৮ জানুয়ারি। বুলেটের মুখে প্রাণ যায় হাজার হাজার। এরমধ্যে অধিকাংশই ছোট-বড় মাদক কারবারি। থাইল্যান্ডে ইয়াবার প্রবেশ দুরূহ হয়ে পড়ে। এরপর মিয়ানমারে তৈরি ইয়াবার গন্তব্য হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশে দুই দশক আগেও মাদক হিসেবে ইয়াবার ব্যবহার এতটা দেখা যায়নি। এখানে বহুল ব্যবহৃত মাদক ছিল ফেনসিডিল। এছাড়া সেই আদিকাল থেকে গাঁজা, আফিম, তাড়ি ও চোলাই মদ ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়ে আসছিল নেশা দ্রব্য হিসেবে। তবে প্রথম ভয়াবহতা সৃষ্টি করেছিল ফেনসিডিল। ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রতিষ্ঠিত কিছু কারখানায় উৎপাদিত ফেনসিডিল প্রবেশ করছিল দেদারছে। এক্ষেত্রে অভিযোগের তীর সীমান্ত এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকেও। ভারতের সঙ্গে সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের কারণে সৃষ্ট বোঝাপড়ায় সেই কারখানাগুলোতে ফেনসিডিল উৎপাদনের ওপর কড়াকড়ি আরোপ হলে অনেক কমে যায় ফেনসিডিলের প্রবাহ। এতে স্বস্তি এলেও নতুন আপদের নাম ইয়াবা। ফেনসিডিল বোতলজাত হওয়ায় বহন করা কষ্টসাধ্য। কিন্তু ইয়াবা আকারে ছোট হওয়ায় পকেটে বা দেহের যে কোন অংশে লুকিয়ে পাচার করা যায় সহজেই। আর এর দামও বেশ ভালই। লাভজনক হওয়ায় ফেনসিডিলের পরিবর্তে নেশাকারী দ্রব্যের বাজার দখল করে নেয় ইয়াবা। বিগত কয়েক বছরে ইয়াবার প্রবেশ অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। বাড়তে থাকে এই ড্রাগের চাহিদাও। বাংলাদেশের মাদক অর্থনীতিতে বেশ শক্ত অবস্থান নিয়ে ফেলে এই নেশাকারক বড়ি। চাহিদা থাকায় স্রোতও জোরালো। সীমান্তবর্তী জেলার কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম এবং রাজধানী ঢাকাতেও ইয়াবার কারবার করে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যায় কিছু চোরাকারবারি। টাকার জোরে ক্ষমতাবান এরা গডফাদারও বটে। মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে আর্মস এবং মানব পাচারের। ফলে গর্হিত তিনটি কাজই চলছে সমান তালে। অতঃপর যুদ্ধ ঘোষণা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। দেশে মাদকবিরোধী যুদ্ধে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে শতাধিক। গ্রেফতার হয়েছে প্রায় ১০ হাজার। কোন পর্যায়ে গিয়ে এ যুদ্ধ থামবে তা কেউ জানে না। কেননা, বিশ্বের দেশে দেশে মাদকবিরোধী যে যুদ্ধ আরও অনেক আগে শুরু হয়েছে তাও চলমান রয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়ে দিয়েছেন, মাদক ব্যবসায় একেবারে বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে। অভিযোগ কিংবা অপরাধ প্রমাণিত হলে কেউ ছাড়া পাবে না। একই ধরনের কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে যে বাহিনী দিয়ে ইয়াবা দমনের যুদ্ধ চলছে সেই বাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধেও রয়েছে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ। পুলিশ সদর দফতর থেকে গত মঙ্গলবার গত মঙ্গলবার বিবৃতি অনুযায়ী দশ দিনেই গ্রেফতার হয়েছে ৯ হাজার ২০ জন। এরা সকলেই মাদক কারবারি। মামলা হয়েছে ৭ হাজার ২৬টি। ওই সময়ের মধ্যে ১৭ লাখ পিস ইয়াবা, ২ হাজার ২৮৬ কেজি গাঁজা, ৫৫ হাজার লিটার দেশীয় মদ, ২৩ কেজি হেরোইন, ১৬ হাজার বোতল ফেনসিডিল এবং ১ হাজার ২১০ ক্যান বিদেশী বিয়ার উদ্ধার হয়েছে। তবে ক্রসফায়ার বা বন্দুক যুদ্ধে বিচার বহির্ভূত হত্যার তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু পুলিশ না জানালেও বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুসারে নিহতের সংখ্যা শতাধিক। বিশ্বে মাদকের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। ১৯৭১ সালের ১৮ জুন প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি মাদকবিরোধী যুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। গণমাধ্যমের কারণে তার এই যুদ্ধ বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়। কেননা, অনেক আগে থেকেই মাদকের নেশায় দুলছিল দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়া, ব্রাজিল এবং মার্কিন সীমান্তবর্তী মেক্সিকোসহ বিরাট অঞ্চল। কলম্বিয়া সরকারও যুদ্ধ ঘোষণা করে মাদকের বিরুদ্ধে। নিষিদ্ধ করা হয় কোকেন উৎপাদনের উপাদান কোকা চাষ। এই যুদ্ধে কত লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। কারণ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সোচ্চার প্রতিবাদের মুখে যুদ্ধ ঘোষণাকারী সরকারগুলো প্রকৃত তথ্য তুলে ধরেনি। তবে বিভিন্ন প্রতিবেদনে শুধু কলম্বিয়ায় নিহতের সংখ্যা ৫৯ হাজার উল্লেখ করা হয়েছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোসহ পুরো দক্ষিণ আমেরিকায় নিহতের সংখ্যা ৪ লক্ষাধিক। এরমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি ছাড়াও মাদক ব্যবসায়ীদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণপাতের ঘটনাও রয়েছে। সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার পর মাদকের জন্য হাল সময়ে বেশ আলোচিত হয়ে উঠে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। মাদকের করালগ্রাস অনেকটা মাতাল করে দেয় ফিলিপিন্স ও থাইল্যান্ডের যুব সমাজকে। তবে সকলে একবাক্যে বলছেন, উৎপাদনকারী দেশটি মিয়ানমার। এই এলাকায় অন্যান্য মাদক থাকলেও শীর্ষে ইয়াবা। ফিলিপাইনে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তে। সে দেশে এই যুদ্ধে গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন এক সিটি মেয়রও। শুধু তাই নয়, মাদকের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হলে নিজের সন্তানকেও হত্যা করবেন বলে ঘোষণা দেন তিনি। ফিলিপিন্সে এই যুদ্ধ শুরু হয় ২০১৬ সালের ১ জুলাই। গালফ নিউজ ফিলিপিন্স জানিয়েছে, ওই দেশে ১৩ লাখ মাদক বিক্রেতা আত্মসমর্পণ করেছে। পত্রিকাটির রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৩ হাজার ৮৫০ জন। তবে এই পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজারের বেশি বলে জানা যায়। এই অভিযানে বিভিন্ন বাহিনীর ২৮৯ জন সদস্যও মারা গেছেন। পার্লস এশিয়া রিসার্চ এর জরিপের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানায়, দেশের ৮৮ শতাংশ মানুষ এই যুদ্ধকে সমর্থন করেছে। থাইল্যান্ডের মাদকবিরোধী যুদ্ধ এখন মোটামুটি বন্ধ বলা যায়। রয়েল থাই পুলিশ তাদের অভিযানে ২ হাজার ২৭৫ জন নিহত এবং ৭০ হাজার গ্রেফতারের কথা স্বীকার করেছে। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থা তথ্য অনুযায়ী ওই দেশে মাদকবিরোধী যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা অন্তত ১১ হাজার। থাইল্যান্ডে সাধারণ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে মদ এবং বিয়ার পাওয়া গেলেও ইয়াবা বা এ ধরনের নেশাকারী ড্রাগ এখন মেলে না। পর্যটনের এই দেশটির সরকার মদ এবং বিয়ারকে বৈধতা দিয়েছে। কারণ, গবেষণায় এ্যালকোহলিক মাদকের ক্ষতির বিষয়টি সেভাবে প্রমাণিত নয়। কিন্তু ড্রাগজাতীয় মাদকগুলো মানুষের জীবনী শক্তি শেষ করে দেয়। মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিকভাবে অবরুদ্ধ একটি দেশ। ওই দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও তেমন ছিল না। ফলে ইয়াবা উৎপাদন এবং সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে বিক্রিটাও দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকা-ে ভূমিকা রেখে আসছিল। সেক্ষেত্রে প্রধান টার্গেট থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ ও ভারত। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় এদেশেই ঢুকছে ইয়াবার চালান। এখান থেকে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। ফলে বাংলাদেশ অনেকটা ইয়াবার ট্রানজিট হিসেবেও কাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রায় পাঁচ দশক আগে মাদকের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তার সম্প্রসারণ ঘটেছে বিশ্বের দেশে দেশে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের জন্য বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোরালো বক্তব্যের মধ্যেও এই অভিযান একপর্যায়ে গিয়ে অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। সমালোচনার মধ্যেও সমর্থনকারীর সংখ্যাও বরাবরই বেশি। বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত মাদকবিরোধী যুদ্ধকেও অধিকাংশ মানুষ সমর্থন করছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু বিতর্কিত অভিযানের কারণে প্রশ্নবিদ্ধও হতে শুরু করেছে এই অভিযান। মাদক পুরোপুরি নির্মূল করা যায় না। তবে কঠোর অবস্থানের মধ্য দিয়ে এই মরণ নেশা ড্রাগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করেন সমালোচকরাও।
×