ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘বন্ধু ইমনকে হত্যার পর লাশ এসিডে গলিয়ে ফেলার চেষ্টা করে সন্ত্রাসী অমিত’

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

‘বন্ধু ইমনকে হত্যার পর লাশ এসিডে গলিয়ে ফেলার চেষ্টা করে সন্ত্রাসী অমিত’

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ পুলিশের দুর্বল রিপোর্টের কারণে ছিঁচকে সন্ত্রাসীরা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হয়ে উঠছে। ১৩ মামলার আসামি হয়েও এলাকায় প্রভাব খাটিয়ে প্রতিপত্তি গড়ে তুলেছে অমিত মুহুরী নামের এক সন্ত্রাসী। সে তার স্ত্রী চৈতীকে ব্যবহার করে মাদকসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট নিজ বাসায় ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইমনকে খুনের মধ্য দিয়ে লোমহর্ষক ঘটনার নজির সৃষ্টি করেছে অমিত। হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে এলাকায় আতঙ্ক ছড়ানোর কারণে ঘটনার সাক্ষীও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে গত পাঁচ বছরে বেড়ে ওঠা এ সন্ত্রাসী পুলিশকে ম্যানেজ করেই মামলার দুর্বল রিপোর্ট তৈরি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে থানা ও গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, অপরাধের স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলা অমিত মুহুরীকে গত কয়েক বছর ধরে ছাড় দিয়েছে পুলিশ। পুলিশ হত্যা মামলার তদন্ত যেমন দায়সারা করেছে তেমনি এই সন্ত্রাসীকে জামিন পেতে মামলায় জামিনযোগ্য ধারা ব্যবহার করেছে। সিআরবিতে ডাবল মার্ডরের ঘটনায় কোতোয়ালি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলেও চার বছরেও অস্ত্র উদ্ধার করার চেষ্টা করেনি। গত এপ্রিলে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে নগরীর ঝাউতলায় প্রভাব খাটালেও খুলশী পুলিশ তাকে তদন্তে ছাড় দিয়েছে। ভূমি দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করেও পার পেয়েছে এ সন্ত্রাসী। আরও অভিযোগ রয়েছে, সর্বশেষ গত ২৮ এপ্রিল নগরীর খুলশী থানার ঝাউতলা এলাকায় মারামারির ঘটনায় অস্ত্র উঁচিয়ে ভীতি প্রদর্শন করার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা দায়ের হয়। এ ঘটনায় তাকে ২৫ মে গ্রেফতার করা হলেও পুলিশের দুর্বল রিপোর্টের কারণে ২৬ জুন সে জামিনে বেরিয়ে আসে। এর আগে গত পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে পুলিশের ওপর চড়াও হয় অমিত ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। কিন্তু পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোন কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি। ২০১৩ সালে কোতোয়ালি থানার সিআরবি সাতরাস্তার মোড় এলাকায় এক মাদ্রাসাছাত্রসহ প্রতিপক্ষের নেপাল নামের একজন মারা যায়। গুলির আঘাতে এ দুজনের মৃত্যু হলেও দীর্ঘ প্রায় দু’বছর পর ২০১৫ সালের ৫ নবেম্বর তাকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তার দুর্বল রিপোর্টে আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে অমিত মুহুরী। জানা গেছে, গত ৯ আগস্ট নগরীর নন্দনকাননের বেঙ্গল হোল্ডিংয়ের ই/৫ নামক ফ্ল্যাটে এক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। হত্যার শিকার অমিতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইকরামুল করিম ইমন। কিন্তু হত্যার পর ইমনের মরদেহ গুম করতে কৌশল নেয় অমিত ও তার স্ত্রী চৈতী। ইমনের লাশ ড্রামে ঢুকিয়ে এসিড ও চুন ঢেলে গলিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু মৃতদেহ না গলে শক্ত হয়ে যায়। ফলে অমিত আবারও ইমনের লাশ টুকরা-টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ঘটনার কয়েকদিন পর কোতোয়ালি থানার এনায়েতবাজার পুলিশ ফাঁড়ির একটি টিম রানীরদীঘি থেকে ড্রামভর্তি একটি গলিত লাশ উদ্ধার করে। কোতোয়ালি থানার এনায়েতবাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মোহাম্মদ হারুন জানান, দীর্ঘ ১৭ দিনের তদন্ত শেষে দেখা গেল এ লাশ অমিতের বন্ধু ইমনের। ইমন কোন এক সময় অমিতের স্ত্রীকে খারাপ নজরে দেখার কারণে এমন ঘটনার উৎপত্তি হয়েছে। এমন তথ্য অমিতের বন্ধু ইমাম হোসেন মজুমদার ওরফে শিশিরের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে উঠে এসেছে। এ ঘটনায় ভবনের দারোয়ান শফিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। চট্টগ্রাম আদালত সূত্রে জানা গেছে, ইমন হত্যার ঘটনায় গত শনিবার কুমিল্লার ‘আদর’ নামে একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র থেকে অমিতকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর রবিবার মহানগর হাকিম মেহনাজ রহমানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে অমিত। কিন্তু আদালতকে জানিয়েছে, ইমাম প্রথমে ইমনকে ছুরি দিয়ে আঘাত করলে ইমন মাটিতে পড়ে যায়। এরপর অমিত ও চৈতী মিলে তাকে ড্রামে ঢুকিয়ে গলানোর চেষ্টা করে। লাশ শক্ত হয়ে যাওয়ার পর কেটে টুকরা করে ফেলারও চেষ্টা করে কিন্তু চুন আর এসিডের কারণে শক্ত হয়ে যাওয়ায় তাও সম্ভব হয়নি। এর আগে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে এ হতক্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত শিশির। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোহাম্মদ হারুন হত্যাকা-ের অন্যতম হোতা অমিতকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রবিবার আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। সোমবার চট্টগ্রাম আদালতের বিচারক আবু সালেহ মোহাম্মদ নোমান আজ মঙ্গলবার এ রিমান্ড আবেদন শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছেন। একই আদালত মামলার আরেক আসামি ও ‘বেঙ্গল হোল্ডিং’ ভবনের দারোয়ান শফিকুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একদিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছে। কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম জনকণ্ঠকে জানান, এ পর্যন্ত অমিতের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে বিভিন্ন থানা থেকে। হত্যা, অস্ত্র, ডাকাতি ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের রেকর্ড রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অজ্ঞাতনামা হিসেবে প্রথম অবস্থায় এসআই সামছুল হক মামলা দায়ের করলেও এখন রহস্য উদ্ঘাটন হচ্ছে। লোমহর্ষক এ হত্যাকা-ের নেপথ্যের অপরাধীগুলোকে পুলিশ আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে। অমিতের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে ও হত্যার ঘটনায় পৃথক পৃথক মামলা রয়েছে। এসব তথ্য বের করতে হলে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। ঘটনার পরপরই অমিত গা-ঢাকা দিয়ে কুমিল্লায় পালিয়ে যায়। দাড়ি-গোঁফ ফেলে অমিত নিজের বেশভূষার পরিবর্তন করলেও ফেসবুক থেকে নেয়া ছবিতে শরীরে ট্যাটু আঁকা থাকায় পুলিশের কাছে ধরা পড়ে অমিত।
×