ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণের লাগাম টেনে ধরা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখাই এর লক্ষ্য

এবার সতর্ক মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

এবার সতর্ক মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ টানা পাঁচ মাস দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশের উপরে রয়েছে। আমদানির চাপে দেশীয় মুদ্রার (টাকা) বিপরীতে ডলারের বিনিময় হারও আকাশচুম্বী। আবার রেমিট্যান্স প্রবাহে কাক্সিক্ষত গতি না আসা এবং আমদানি ব্যয়ের অনুপাতে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি না পাওয়ায় বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, আমদানি অর্থায়ন বৃদ্ধি এবং কিছু ব্যাংকের আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ছে কাক্সিক্ষত হারের চেয়েও বেশি। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থনীতির এমন নানা চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য নতুন সতর্ক মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের লাগাম টেনে ধরা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখাই এর লক্ষ্য। এ মাসের শেষ সপ্তাহে এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন গবর্নর ফজলে কবির। এদিকে, নির্বাচনী বছরের নতুন মুদ্রানীতির ভঙ্গিমা কী হবে সে বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের ভিন্ন ভিন্ন মতামত পাওয়া গেছে। কেউ বলছেন, মুদ্রানীতিতে আগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা উচিত। কেউ বলছেন, আগের চেয়ে আরও সতর্ক ও সংকোচনমূলক হওয়া উচিত। আবার কেউ বলছেন, মুদ্রানীতির ভঙ্গিমা সংকোচন নয়, কিছুটা সংকোচনমূলক করা উচিত; যাতে প্রকৃত চাহিদার ভিত্তিতে বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ে। তবে মুদ্রানীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের ভিন্ন মতামত পাওয়া গেলেও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর প্রশ্নে সবাই একমত পোষণ করেছেন। তারা বলছেন, আর্থিক খাতে যেসব সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধানে বিদ্যমান নিয়মকানুন যথাযথভাবে পরিপালনের ওপর জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকারদের যে দায়িত্ব সেটাও নিশ্চিত করতে হবে; যাতে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নতুন মুদ্রানীতির ভঙ্গিমা আরও সতর্ক ও সংকোচনমূলক করা হতে পারে। এক্ষেত্রে বেসরকারী ঋণের লক্ষ্য ১৬ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা হতে পারে। চলতি মুদ্রানীতিতে জুন পর্যন্ত এই লক্ষ্য ধরা আছে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু নবেম্বর পর্যন্ত বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তাই বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নামিয়ে আনা নতুন মুদ্রানীতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখার প্রয়াস থেকে প্রতি ৬ মাসের আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই আলোকে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে নিজস্ব কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপদেষ্টা ও সুশীল সমাজের (স্টেকহোল্ডার) প্রতিনিধিদের মতামত নেয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আরও কয়েকটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ওইসব বৈঠকের পর নতুন মুদ্রানীতির ধরন ও হাতিয়ারগুলো সংশোধন ও পরিমার্জন করা হবে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মুদ্রানীতি প্রথমার্ধে যেরকম ছিল দ্বিতীয়ার্ধেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা উচিত। কারণ চলতি মুদ্রানীতিতে বেসরকারী ঋণের যে লক্ষ্য ধরা রয়েছে, সেটা উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য যথেষ্ট সহায়ক। তাই বেসরকারী ঋণের লক্ষ্য অপরিবর্তিত রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, চলতি মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহের যে লক্ষ্য ধরা আছে, সেটা এরই মধ্যে অনেক বেশি হয়ে গেছে। এই ঋণ আসলে কোথায় যাচ্ছে সেটা দেখা উচিত। বিশেষ করে এই ঋণ বিনিয়োগে না অর্থপাচারে, নাকি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে সেটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেখা উচিত। এছাড়া ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও সুশাসনের যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর করণীয় সম্পর্কেও মুদ্রানীতিতে ইঙ্গিত দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। চলতি অর্থবছরের জুন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এরই মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার অসহনীয় মাত্রায় রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ডিসেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ; যা নবেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ৮৩ ভাগ। এ মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ; যা নবেম্বরেও ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা আছে ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির এই হার এরই মধ্যে অতিক্রম করেছে। এজন্য নতুন মুদ্রানীতি কিছুটা সংকোচনমূলক করা দরকার; যাতে মূল্যস্ফীতি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা যায়। তবে বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহের লাগাম টেনে না ধরার পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সম্প্রতি বেসরকারী ঋণপ্রবাহ অনেকটা বেড়েছে। তবে এটাকে জোর করে কমিয়ে মুদ্রানীতির ভঙ্গিমা সংকোচনমূলক করা ঠিক হবে না। প্রকৃত চাহিদার ভিত্তিতে গুণগতমানের ঋণপ্রবাহ বাড়লে মুদ্রানীতি কিছুটা সংকুলানমুখী হলেও সমস্যা নেই। কারণ বিনিয়োগ উৎপাদনশীল খাতে হলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে, বিদ্যমান কারখানাগুলোর সম্প্রসারণ হয়, কর্মসংস্থান, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও সাধারণ মানুষের বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হলেও মানুষের সমস্যা হবে না। কিন্তু ঋণ যদি অনুৎপাদনশীল খাতে যায়, ফান্ড ডাইভার্ট হয়, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর হস্তক্ষেপ থাকতে হবে। এদিকে, আমদানি ব্যয়ের চাপে প্রতিদিনই ডলারের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই গত এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান (টাকার অবমূল্যায়ন) কমেছে প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ। গত বছরের জানুয়ারিতে গড়ে ডলারের বিনিময়মূল্য ছিল ৭৮ টাকা ৭০ পয়সা। চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি এর বিনিময় মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৮২ টাকা ৮০ পয়সায়। যদিও বাস্তবে ডলারের বিনিময় মূল্য আরও বেশি। প্রতি ডলার কিনতে এখনও ব্যবসায়ীদের প্রায় ৮৪ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বাড়ায় ব্যবসায়ীরা তাদের দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন, যা মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী রাখতে সহায়ক হচ্ছে। তাই নতুন মুদ্রানীতিতে মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে। এ বিষয়ে সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন বলেন, সম্প্রতি আমদানি ব্যয় অনেক বেড়েছে। আর বেসরকারী ঋণের একটি অংশ যাচ্ছে আমদানি ব্যয় মেটাতে। এ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খোলা বাড়লেও বিনিয়োগ সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। তাই প্রকৃত অর্থে এর আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন তিনি। ডলারের বিনিময় হার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এতে রেমিটেন্স ও রফতানি আয় উৎসাহিত হবে, আবার আমদানি খরচও কম পড়বে। এদিকে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স উৎসাহিতে দীর্ঘদিন ধরেই টাকার অবমূল্যায়ন প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংক নীরব রয়েছে। তারপরও রেমিটেন্স ও রফতানি আয়ে কাক্সিক্ষত গতি ফিরছে না। অন্যদিকে, আমদানি ব্যয়ও বেড়েই চলেছে। এতে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে চাপ তৈরি হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই এই হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ৩৩৩ কোটি ডলার। তাই আমদানি ব্যয় হ্রাস ও বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য ঘাটতি কমিয়ে আনাও নতুন মুদ্রানীতির আরেকটি চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
×