ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার নির্দেশ ॥ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস

প্রকাশিত: ২৩:১৫, ২৭ অক্টোবর ২০২১

ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার নির্দেশ ॥ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ দেশে দুর্গাপূজায় বিভিন্ন জেলায় পূজাম-পে ও হিন্দুদের বাড়িতে হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের স্থানীয়ভাবে সহায়তা দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ। অপরদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করছে সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনও। সাম্প্রদায়িক হামলায় দেশের ১৭ জেলায় ৮৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। এর মধ্যে অপরাধের দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে দেশের ৪ জেলায় ৯ জন। দেশের বিভিন্ন জেলায় গ্রেফতার হয়েছে ৭শ’ জন। যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াত, যুবদল, ছাত্রলীগ ও উগ্র মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ঘোর সমর্থকগণ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। দেশে দুর্গাপূজায় বিভিন্ন জেলায় পূজাম-পে ও হিন্দুদের বাড়িতে হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের স্থানীয়ভাবে সহায়তা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। দেশের যেসব জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, লুটপাট ও হামলা হয়েছে, তার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করার পাশাপাশি জরুরী ভিত্তিতে সাহায্য সহযোগিতা করছে স্থানীয় প্রশাসন। ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাবের চিত্র পেতে আরও কয়েকদিন সময় নেবে, যা ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে সরকার। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষয়ক্ষতির একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। পূজা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় আটটি মন্দিরে হামলার পর দেশের ২৩ জেলায় শতাধিক মন্দির ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। আরও শতাধিক বাড়িঘরে হামলা ও আগুনের ঘটনা ঘটেছে, যার আর্থিক ক্ষতি নির্ণয় করা হয়নি। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের পীরগঞ্জের অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে ঘরবাড়ি করে দেয়ার কথা বলেছেন। রংপুরে সমস্যা হবে না। সেখানে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। অন্যান্য জায়গায় এখানও পুরোমাত্রায় শুরু হয়নি। তবে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও সহায়তা করছেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে ৫০ লাখ টাকা পাঠানো হয়েছে রংপুরের জন্য। এখন প্রয়োজন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে দ্রুত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে সহায়তা দেয়াসহ নিরাপত্তার বিষয়টি এখন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক প্রবীর কুমার সাহা বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ-৪এর সাংসদ একেএম শামীম ওসমানের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জের ব্যসায়ীরা মিলে আমরা রংপুরের ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য সহায়তার জন্য ৫০ লাখ টাকার চেক দিয়েছি জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরীন শারমিনের হাতে। দেশের কয়েকটি জেলার ডিসিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে সরকারের নির্দেশে তারা কমিটি করে ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয়ের চেষ্টা করছেন। সেটা করার পর প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেবেন। নোয়াখালী জেলার ডিসি মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান বলেছেন, আমরা একটি কমিটি করে দিয়েছি। তারা প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির একটা হিসাব করেছেন। এখন সেটা আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি। চূড়ান্ত করার পর মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠাব। তিনি জানান, এরই মধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাথমিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলোকে ৫০ হাজার করে টাকা এবং ৫ মেট্রিক টন করে চাল দেয়া হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে পাঁচ হাজার করে টাকা, খাদ্য সহায়তা এবং ঢেউটিন দেয়া হয়েছে। অন্যান্য জেলায়ও ডিসিরা সরকারী তহবিল থেকে প্রাথমিক সহায়তা করছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মোঃ এনামুর রহমান বলেছেন, রংপুরের পীরগঞ্জে যেদিন রাতে হামলা হয়েছে তার পরের দিন ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার, ১০০ বান্ডিল টিন, গৃহ নির্মাণের জন্য তিন লাখ টাকা, নগদ সাড়ে ছয় লাখ টাকা, শাড়ি, লুঙ্গি এবং কম্বল বিতরণ করেছি। পীরগঞ্জে ১৮টি ঘর পুড়েছিল সবই নতুন করে তৈরি করে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে কুমিল্লা এবং নোয়াখালীতে সহায়তা দেয়ার কথা জানান তিনি। নোয়াখালীতে দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৫০ মেট্রিক টন চাল এবং পাঁচ লাখ টাকা নগদ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এখন পুরো ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে আমরা আরও যে সহায়তা লাগে তা দেব। পীরগঞ্জে প্রত্যেকটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ঘর তৈরি করতে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছে। যেসব ছাত্রছাত্রীর বই পুড়ে গেছে তাদের বই কিনে দেয়া হয়েছে। ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে কুমিল্লার এক পূজাম-পে কোরান রাখার ঘটনার জেরে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলার মধ্যে দেশের ১৬ জেলায় হিন্দুদের বাড়িঘর, পূজাম-প, মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় দায়ের করা ৮৫টি মামলায় প্রায় ২৫ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭শ’ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আসামি ও গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক উভয়ই রয়েছে। প্রায় ২৪ হাজার আসামির বেশির ভাগই অজ্ঞাতনামা বলে মামলার এজাহারে বলা হয়। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর ও রংপুর জেলায় দায়ের করা মামলাগুলোতে আসামি ও গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীই বেশি। এদিকে রংপুরে গ্রেফতার হওয়াদের মধ্যে ছাত্রলীগের এক নেতা রয়েছেন। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে হামলা-ভাংচুর ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ২৪ মামলায় ৭ হাজার ৯৬১ জনকে আসামি করা হয় এবং ১৬২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাকেও হুকুমের আসামি করা হয়েছে। এই মামলায় ৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে জেলা যুবদলের সভাপতি মঞ্জুরুল আজিম ওরফে সুমনসহ দলের ১০-১২ নেতাকর্মীকে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পূজাম-পে ভাংচুর ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় ১০ মামলায় ৫ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৩৩ জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে জামায়াত নেতা ও সাবেক শিবির সভাপতি মোঃ কামাল উদ্দিন আব্বাসীকে (৪০) গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা তিনি স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ। চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় পূজাম-পে হামলা ও তোরণ ভাংচুরের ঘটনায় পৃথক ৭টি মামলায় ৩ হাজার ৮৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং ২০১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জামায়েতের আমির জাফর সাদেক, বাঁশখালী উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান, হাটহাজারী উপজেলা বিএনপির যুগ্মআহ্বায়ক মাহবুবুল আলম চৌধুরীসহ বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম নগরের জে এম সেন হলের পূজাম-পে তোরণ ভাংচুরের মামলায় ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন যুব ছাত্র অধিকার পরিষদের ১০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা পরিকল্পনা ও হামলাকারী ছিল যাদের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। রংপুর জেলার পীরগঞ্জে মাঝিপাড়া গ্রামের বড়করিমপুর এলাকার সনাতন সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৪ মামলায় ৬৪ জন আটক হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পীরগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান। এর মধ্যে ছাত্রলীগের এক নেতা ও মসজিদের একজন মুয়াজ্জিন রয়েছেন। রবিবার তারা দুজনই আদালতে পীরগঞ্জে সহিংস ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। কুমিল্লায় মন্দির ও পূজাম-পে হামলা এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় ৯ মামলায় ৭৯২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এসময় ৫৬ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ফেনীতে ৪টি মামলায় ৬৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন যুবদল, অপরজন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা।
×