ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রিমান্ড নিয়ে ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন হাইকোর্ট

প্রকাশিত: ২১:৪৮, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

রিমান্ড নিয়ে ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন হাইকোর্ট

স্টাফ রিপোর্টার॥ চিত্রনায়িকা পরীমনিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডে পাঠানোর ক্ষেত্রে দেয়া সিএমএম আদালতের দুই বিচারক দেবব্রত বিশ্বাস ও আতিকুল ইসলামের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন হাইকোর্ট। নিম্ন আদালতের দুই বিচারক হাইকোর্টে ক্ষমা চেয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। জবাবে হাইকোর্ট বলেছেন, আমরা এ ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নই। বিচারকদের ব্যাখ্যায় হাইকোর্টকে আন্ডারমাইন (হেয়) করা হয়েছে। আদালত এই মামলার পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন। ওইদিন পরীমনির মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে আবারও আদালতে হাজির হতে হবে। একই দিনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় চিত্রনায়িকা পরীমনি সিএমএম আদালতে হাজিরা দেন। মামলার পরবর্তী হাজিরার তারিখ আগামী ১০ অক্টোবর নির্ধারণ করা হয়েছে। বুধবার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ ও ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত এ দিন ধার্য করেছেন। হাইকোর্টে আদালতে পরীমনির পক্ষে শুনানি করেন এ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না ও মোঃ মুজিবুর রহমান। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল ও সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ মিজানুর রহমান। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কেএম জাহিদ সারওয়ার কাজল সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চে বিষয়টি বুধবার উত্থাপিত হয়। এ সময় আদালত বলেন, দুই ম্যাজিস্ট্রেটের একজন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মাদকের ভয়াবহতার কথা লিখেছেন। আর রিমান্ড মঞ্জুরের ক্ষেত্রে যে ত্রুটি হয়েছে, অন্য ম্যাজিস্ট্রেট তা ‘বিশ্বাসই করেন না’। হাইকোর্টকে আন্ডারমাইন করা হয়েছে। সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের মাধ্যমে বিচারকদের লিখিত ব্যাখ্যা মঙ্গলবার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে জমা দেয়া হয়। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে বুধবার লিখিত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়। রিমান্ডের বিষয়ে ওই ব্যাখ্যায় ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের এই দুই বিচারকের একজন লিখেছেন ‘এটি অনিচ্ছাকৃত ভুল’। আরেকজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পরীমনিকে বারবার রিমান্ডের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে মাদকের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রের আত্মহত্যার কথা বলেছেন। মামলায় ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস দ্বিতীয় দফায় পরীমনির দুদিন এবং ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম তৃতীয় দফায় একদিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন। রিমান্ড মঞ্জুরের কারণ তুলে ধরার পাশাপাশি পৃথক লিখিত ব্যাখ্যায় দুই ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড মঞ্জুরের আদেশে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকলে তা অনিচ্ছাকৃত ও সরল বিশ্বাস বলে উল্লেখ করেছেন। আর অনিচ্ছাকৃত ও সরল বিশ্বাসে করা ভুলত্রুটি মার্জনা করে পৃথক ব্যাখ্যা গ্রহণ করে অধিক ব্যাখ্যার দায় থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেয়ার আর্জিও জানিয়েছেন দুই মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট। বুধবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ক্রম অনুসারে বিষয়টি উঠলে হাইকোর্ট বলেন, ‘দুজন ম্যাজিস্ট্রেটকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছিল। তাঁরা উত্তর দিয়েছেন। অংশবিশেষ পড়ে শোনাতে চাই।’ এ সময় ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল বলেন, তদন্ত কর্মকর্তাকে আসতে বলা হয়েছিল। আদালত বলেন, তিনি এসেছেন, দেখেছি। তিনি আছেন। এ সময় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার উদ্দেশে আদালত বলেন, লার্নেড ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টকে শিক্ষা দিয়েছেন কিছু। এই অংশটুকু পড়ছি। রাষ্ট্র মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। এই মামলার আসামি পরীমনি বিদেশী মদ, এলএসডি, আইসসহ গ্রেফতার হন। প্রশ্ন হচ্ছে, এলএসডি ও বিদেশী মদ পেলে শাস্তি কী? তখন এ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, পাঁচ বছর হতে পারে। আদালত বলেন, এটি পরিষ্কার করতে হবে। যে পরিমাণ এলএসডি ও আইস পাওয়া গেছে, তাতে শাস্তির পরিমাণ কত? তখন সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান বলেন, ইয়াবা বড়ির ক্ষেত্রে যে সাজা, এলএসডির ক্ষেত্রেও তাই হবে। আদালত বলেন, তাহলে দুই থেকে পাঁচ বছর হতে পারে। জেড আই খান পান্না বলেন, পাঁচ বছর হবে, মাই লর্ড। বিচারকের লিখিত ব্যাখ্যা তুলে ধরে আদালত বলেন, এলএসডি মাদক যে কত ভয়ানক, তা পুরো দেশবাসী অবগত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের রহস্যজনক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। এলএসডিকে ভ্রম উৎপাদক মাদক হিসেবেও বলা হয়। ওই ছাত্র এলএসডি গ্রহণের পর একজন ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে ছুরি নিয়ে নিজের গলায় পোঁচ মেরে আত্মহননের পথ বেছে নেন। আদালত বলেন, আমরা তাদের (বিচারক) কারণ দর্শাতে বলেছি, কেন দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে? এখানে তাঁরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এলএসডি গ্রহণের পর একজন ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে ছুরি নিয়ে নিজের গলায় পোঁচ মেরেছেন। এখানে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের নির্দেশনা ও প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে তিনি (বিচারক)। এ কারণে তাঁদের জবাবে আমরা সন্তুষ্ট নই। এ জন্য ২৯ সেপ্টেম্বর পরবর্তী আদেশের জন্য রাখছি। প্রসঙ্গত, এর আগে গত ৫ আগস্ট পরীমনি ও দীপুর চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদ। পরে দ্বিতীয় দফায় গত ১০ আগস্ট পরীমনি ও আশরাফুল ইসলাম দীপুর দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস। এরপর তৃতীয় দফায় গত ১৯ আগস্ট পরীমনির একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম। পরে গত ২৯ আগস্ট সুপ্রীমকোর্টের রায় না মেনে মাদক মামলায় আটক চিত্রনায়িকা পরীমনিকে বারবার রিমান্ডে নেয়ার বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টের স্বপ্রণোদিত আদেশ প্রার্থনা করে একটি আবেদন করা হয়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্রের (আসক) পক্ষে সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী সৈয়দা নাসরিন এ আবেদন জানান। এদিকে বিচারিক আদালত থেকে কোর্ট রিপোর্টার জানান, নায়িকা পরীমনি বেলা পৌনে ১১টার দিকে কালো রঙের একটি গাড়িতে আদালতে আসেন। আদালতে হাজিরা দেয়ার পর তিনি দুপুর সোয়া ১২টার দিকে আদালত থেকে চলে যান। এ সময় গাড়িতে দাঁড়িয়ে পরীমনি হাত নেড়ে ভক্তদের শুভেচ্ছা জানান। মাদক মামলায় হাজিরা দিলেন পরীমনি ॥ ঢাকাই চলচ্চিত্রের আলোচিত চিত্রনায়িকা শামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমনি বনানী থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। বুধবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সত্যব্রত শিকদারের আদালতে বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে তিনি উপস্থিত হয়ে হাজিরা দেন। পরীমনির পরবর্তী হাজিরার তারিখ আগামী ১০ অক্টোবর নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিন নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে পরীমনি নিজেই হাজতখানার গেট দিয়ে প্রবেশ করেন। এসময় পুলিশ ও তার কিছু আত্মীয় হাজতখানার ভেতরে প্রবেশ করেন। এর আগে গত ৩১ আগস্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশের আদালত ৫০ হাজার টাকার মুচলেকায় পরীমনির জামিন মঞ্জুর করেন। আবারও পরীর হাতে ‘রহস্যময়’ বার্তা ॥ আদালত চত্বরে প্রবেশের সময় গাড়িতে দাঁড়িয়ে ভক্তদের অভিবাদন জানান পরী। এ সময় আগেরবারের মতো তার হাতের তালুতে মেহেদীর রঙে আঁকা ‘রহস্যময়’ বার্তা চোখে পড়ে। যেখানে লেখা, ‘... ‘মি মোর’। অবশ্য এই বার্তা যে তার নিন্দুকদের উদ্দেশে, সেটা সহজেই অনুমেয়। ‘গাড়ি-আইফোন-প্রসাধনী’ ফেরত চাইলেন ॥ গাড়ি, আইফোন ও প্রসাধনীর বাক্স জব্দ করায় ‘ভোগান্তিতে’ পড়েছেন জানিয়ে আদালতে সেসব ফিরে পাওয়ার আবেদন করেছেন চিত্রনায়িকা পরীমনি। বুধবার ঢাকার মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদারের আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি গাড়ি, ল্যাপটপ, আইফোন, প্রসাধনী ও চাবির বাক্সসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফিরে পেতে আবেদন করেন। পরীমনি তার আবেদনে বলেছেন, গাড়িটি আমার। গাড়িটির সকল কাগজপত্র আমার কাছে আছে। গাড়িটি না থাকায় আমি চলাচলে খুব সমস্যা বোধ করছি। মোবাইলের কারণে আমি কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। জব্দ হওয়া প্রসাধনীর বক্সটি আমার খুব প্রয়োজন । এছাড়া চাবির বাক্স রয়েছে। এগুলো আমার খুব প্রয়োজন । আমি অনুরোধ করছি এগুলো ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। মঙ্গলবার পরীমনির আইনজীবী নীলাঞ্জনা রিফাত সৌরভী তার (পরীমনির) সাদা রঙের গাড়িটি, মোবাইল, ল্যাপটপসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জব্দ হওয়া জিনিসপত্র চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। শুনানিতে পরীমনির আইনজীবী বলেন, আমরা আদালতে দুইটি আবেদন করেছি। একটি পরীমনির ব্যবহৃত সাদা গাড়িটি জিম্মায় নেয়ার এবং আরেকটি হচ্ছে তার মোবাইল, ল্যাপটপসহ জব্দ করা অন্যান্য জিনিসপত্রের। এগুলো পরীমনির নিজের ব্যবহৃত জিনিস। অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এগুলো জব্দ করে। সেজন্য আমাদের কাছে কোন ডকুমেন্ট নেই। যেহেতু তিনি একজন আলোচিত চিত্রনায়িকা । অন্ততপক্ষে গাড়িটি তার জিম্মায় দেয়া হোক। রাষ্ট্রপক্ষ আবেদনে বিরোধিতা করে বলেন, যেহেতু এই ডকুমেন্টগুলোর কোন কাগজপত্র নেই, তাই যাচাই-বাছাই করা সম্ভব নয়। তাদের আবেদন নামঞ্জুর করার দাবি জানাচ্ছি। এরপর উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক তদন্ত কর্মকর্তাকে বিআরটিএ থেকে গাড়িটির সঠিক মালিকানা যাচাই করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এই হাত ধরবেন না ॥ বুধবার আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়ার সময় চিত্রনায়িকা পরীমনিকে কয়েক পুলিশ সদস্য আদালত কক্ষের দিকে নিয়ে রওনা হন। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তার পাশে থাকা একজন নারী পুলিশ সদস্য আসামিদের যেভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সেভাবে পরীমনির হাত ধরার চেষ্টা করলে মুহূর্তে হাত সরিয়ে নিয়ে বলেন, ‘এই হাত ধরবেন না’। তারপর তিনি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আদালতের বারান্দায় প্রবেশ করেন।
×