ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মার্কেট শপিংমলে উপচেপড়া ভিড়

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ১১ এপ্রিল ২০২১

মার্কেট শপিংমলে উপচেপড়া ভিড়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কঠোর লকডাউনের আগে বৈশাখ আর ঈদের কেনাকাটার হিড়িক পড়েছে রাজধানীর বিপণিবিতান ও শপিংমলগুলোতে। উর্ধমুখী সংক্রমণে দিন দিন দেশের করোনা পরিস্থিতির অবনতি হলেও তা যেন নাড়া দিচ্ছে না সাধারণ মানুষকে। ভিড় ঠেলে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে দোকানে ছুটছেন ক্রেতারা। মুখে মাস্ক থাকলেও উধাও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা। গাদাগাদি করে কার আগে কে কিনবেন পছন্দের পোশাক বা প্রয়োজনীয় সামগ্রী, চলছে যেন তারই প্রতিযোগিতা। শপিংমল খোলার দ্বিতীয় দিনে শনিবার সকাল থেকেই নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাথ ও বিপণিবিতানে বাড়তে থাকে ক্রেতাসমাগম। এদিকে মার্কেটের প্রবেশপথে জীবাণুনাশক টানেল থাকলেও তা ব্যবহারে চরম অনীহা দেখা যায় ক্রেতা-দর্শনার্থীদের। আবার বিপণিবিতানের ভেতরে মাস্ক ছাড়া দেখা যায় বিক্রয় কর্মীদেরও। ক্রেতাদের অনেকেরই দাবি, অনেকটা বাধ্য হয়ে এসেছেন কেনাকাটা করতে। সরকার ঘোষিত সাত দিনের ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ আজ রবিবার শেষ হতে যাচ্ছে। এছাড়া দুদিন বাদে আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে ফের কঠোর লকডাউনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ওই সময় অতি জরুরী সেবা দেয় এমন প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব ধরনের সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে লকডাউনের মেয়াদ আরও বাড়ানোর আভাস দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ৯ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত মার্কেট, শপিংমল ও বিপণিবিতান খোলা রাখার সুযোগ দেয় সরকার। প্রথমদিন শুক্রবার মার্কেটে ক্রেতা সমাগম একটু কম হলেও শনিবার ছিল উপচেপড়া ভিড়। ঠিক যেন ঈদের আগের দিন চাঁদ রাতের কেনাকাটা শুরু হয়েছে। রাজধানী ঢাকার গাউছিয়া, নিউমার্কেট, এ্যালিফ্যান্ট রোড, মিরপুর রোড, গুলিস্তান, নিউ বেইলি রোড, মৌচাক, তালতলা সিটি কর্পোরেশন মার্কেট, বসুন্ধরা শপিংমল ও যমুনা ফিউচার পার্কসহ আশপাশের মার্কেট এলাকাগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে যারাই কেনাকাটা করতে এসেছেন তারা ভুলে গেছেন এখন করোনাকাল চলছে। ক্রেতাদের ভিড়ে গাউছিয়া মার্কেটে পা ফেলার জায়গা নেই। ঠাসাঠাসির ভিড় ঠেলে প্রবেশ করতে হচ্ছে গাদাগাদির মার্কেটে। সামাজিক নিরাপত্তা দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে না। মুখে নেই মাস্ক ও হাতে নেই স্যানিটাইজার। অথচ করোনা থেকে বাঁচতে হলে মুখে মাস্ক পড়ার কথা বলেছেন ডাক্তাররা। এছাড়া এটি একটি ছোঁয়াচে ও সংক্রমণ রোগ বিধায় সামাজিক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শ রয়েছে। কিন্তু কে শুনবে কার কথা। সবাই কেনাকাটা করেই খুশি। শনিবার বিকেল তিনটায় নিউমার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এলাকাটি লোকে লোকারণ্য। নিউমার্কেট ও গাউছিয়া মার্কেটে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। এখানকার ফুটপাথে আগের মতোই পোশাক-পরিচ্ছদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। আর এসব পোশাক কিনতে ক্রেতারও কোন কমতি নেই। বরং স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভিড় চোখে পড়ল। নিউমার্কেটের ফুটপাথে নারীদের ওড়না বিক্রেতা সাদেক হোসেন বলেন, ‘বহু কষ্টে দোকান খুলছি। কাস্টমার তো একটু থাকবোই।’ মাস্ক অনেকে পরলেও সামাজিক দূরত্বে কোন বালাই ছিল না মার্কেটগুলোতে। মার্কেটের বিক্রেতাদের কাছে সামাজিক দূরত্বের বিষয়ে জানতে চাইলে, ‘দেশে করোনাভাইরাস বলে কিছু নেই’, ‘সবকিছুই মানুষের মনগড়া’ বলে মন্তব্য করেন কেউ কেউ। আবার কেউ স্বাস্থ্যবিধির গুরুত্ব বুঝলেও তা মানতে পারছেন না বলে জানান। নিউ সুপার মার্কেটের সামনের ওভারব্রিজে নারীদের চুলের ক্লিপ বিক্রি করেন সোহেল রানা। লকডাউনে দোকান বন্ধ থাকায় তার বিশাল ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি। সোহেল বলেন, ‘এক লকডাউনেই তো খবর হইয়া গেছে। এই কয়দিনে একটা টাকাও ইনকাম নাই। আমরা কী খাই, ক্যামনে চলি কেউ খবর রাখে?’ চাঁদনি চক মার্কেটের ব্যবসায়ী রহমত মিয়া বলেন, ‘বন্ধের পর দোকান খুলে কাস্টমারের সংখ্যা মোটামুটি ভাল। তবে জীবন এবং জীবিকা দুইটাই দেখার বিষয়। এখন জীবন যদি বাঁচে তবে জীবিকা হবে।’ নিউ সুপার মার্কেটের নিউ ঢাকা ফ্যাশনের মালিক আবু সুফিয়ান জানান, লকডাউন দেয়া হবে তাদের ওপর সরকারের এক রকম নির্যাতন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান খোলা রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার যেন পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে মার্কেট খোলা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মার্কেট কমিটি আমাদেরকে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসছেন। আমরা নিয়ম মেনে বেচাবিক্রি করছি। আমাদের তো বাঁচতে হবে।’ গাউছিয়া ও চাঁদনি চক মার্কেটের মূল ফটকে বসানো হয়েছে জীবাণুনাশক টানেল। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখা যায়, টানেলটি অকেজো। এছাড়া ফটকের সামনে দাঁড়ানো নিরাপত্তা কর্মীর হাতে হ্যান্ডস্যানিটাইজার দেখা গেলেও মার্কেটে ঢুকছে এমন ক্রেতাদের তা দেয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে নিরাপত্তাকর্মীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি মার্কেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, এমন ক্রেতাদের হ্যান্ডস্যানিটাইজার দিতে শুরু করেন। এর কারণ জানতে চাইলে ওই কর্মী এক গাল হেসে বলেন, ‘একভাবে দিলেই তো হয়।’ মার্কেটগুলো ঘুরে প্রায় ৮০ শতাংশ ক্রেতা-বিক্রেতাকে মাস্ক পরা অবস্থায় দেখা গেলেও প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ মাস্ক পরেননি। আবার অনেকে মাস্ক পরলেও তা সঠিক জায়গায় পরেননি। মাস্ক ব্যবহার করছেন না এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই তরুণী ও ফুটপাথের ব্যবসায়ী। এদিকে নিউমার্কেট এলাকার আশপাশের প্রায় সব খাবার হোটেল ও রেস্তরাঁ খোলা ছিল। এমনকি সরকারী নির্দেশনা উপেক্ষা করেই এসব হোটেল ও রেস্তরাঁয় টেবিলে খাবার পরিবেশন করতে দেখা গেছে। শনিবার বিকেল পাঁচটায় মার্কেট ও দোকান বন্ধের কথা থাকলেও তা বন্ধ হয়েছে সাড়ে পাঁচটার পরে। আর ফুটপাথের দোকান বন্ধ হয়েছে ৬টা নাগাদ। দোকান বন্ধের পরেও নিউ মার্কেট এলাকায় ক্রেতাদের ভিড় যেন কমতেই চায় না। বাড়তি ক্রেতার চাপ পড়ে নিউমার্কেটের আশপাশের সড়কে। এদিকে এলিফ্যান্ট রোড এলাকার সব মার্কেট ও জুতার দোকানেও ক্রেতার প্রচুর ভিড় ছিল। এখানে অধিকাংশ মার্কেটের সামনে নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে হ্যান্ডস্যানিটারজার থাকলেও ক্রেতাদের মাত্রাতিরিক্ত ভিড় থাকার কারণে সবাইকে স্যানিটাইজার দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান দোকানিরা। আবার ক্রেতাদের অনেকেই মাস্ক ছাড়াই প্রবেশ করছেন মার্কেট ও দোকানগুলোতে। বেশ কিছু দোকানের বিক্রেতাদের মুখেও মাস্কের দেখা মেলেনি। ক্রেতাদের ভিড় চোখে পড়ার মতো ছিল বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে। শনিবার সকালের দিকে মার্কেটটিকে ক্রেতার আনাগোনা কিছুটা কম থাকলেও দুপুরের পর তা বাড়তে থাকে। বিকেলে বাড়তে বাড়তে মার্কেটে ক্রেতার আনাগোনা ছিল অনেকটা ঈদের সময়ের মতোই। একই চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টোকিও স্কয়ারে। মার্কেটের অন্য তলায় ক্রেতা সমাগম কম থাকলেও মার্কেটের প্রথম ও ষষ্ঠ তলায় ক্রেতা ছিল অনেক। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি এখানে ছিল না থাকার মতোই। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের আরেক দুরবস্থা চোখে পড়েছে। মার্কেটটিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত ক্রেতার সংখ্যা বেশি। মার্কেটটির অর্ধেকের বেশি বিক্রেতাকে দেখা গেছে মাস্ক ছাড়া। ক্রেতাদের মধ্যে মাস্ক পরার প্রবণতা অনেকটাই কম। এছাড়া সামাজিক দূরত্ব পালনের সুযোগই নেই এই মার্কেটে। কেননা মার্কেটটির প্রতিটি গলির প্রস্থ তিন ফুটের মতোই। দোকানগুলোও ছোট ছোট হওয়ায় স্বাস্থ্যবিধির মানার প্রবণতা চোখে পড়েনি। এছাড়া বিকেল পাঁচটার পরেও দোকান খোলা ছিল কৃষি মার্কেটের মূল মার্কেটের বাইরে অংশে। ফুটপাথের দোকান বন্ধ করা হয়েছে অনেক পরে। কেউ দোকান সামান্য খোলা রেখে বেচাকেনা করেছেন। আর কৃষি মার্কেটের পেছনের অংশে বিহারি ক্যাম্প লাগোয়া দোকানগুলোতে পাত্তাই দেয়া হয়নি স্বাস্থ্যবিধির। এদিকে দেশে প্রতিদিনই বেড়েই চলেছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এই উর্ধগতির কারণ হিসেবে জনগণের সচেতনতার অভাব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে উদাসীনতাসহ বিভিন্ন কারণকে দেখা হচ্ছে। এর মধ্যে বাজার ও গণপরিবহন থেকে সর্বোচ্চ করোনা সংক্রমণ হচ্ছে বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। সম্প্রতি আইইডিসিআরের থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, বাজার ও গণপরিবহন থেকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে ৬১ শতাংশ। অন্যদিকে জনসমাগম স্থল থেকে করোনা ছড়ানোর ঝুঁকি শতকরা ৩৫ ভাগ। আইইডিসিআর জানায়, গত ৫ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে আট হাজার করোনা রোগীর তথ্য পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশেরই বাজারে যাওয়া এবং গণপরিবহন ব্যবহারের ইতিহাস আছে। এর বাইরেও সভা-সেমিনারসহ অন্য জায়গা থেকেও করোনায় সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে আইইডিসিআর।
×