ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনুকরণীয় রিক্সাচালক তারা মিয়া

প্রতিদিনের আয়ের অর্ধেক ব্যয় করেন দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পেছনে

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

প্রতিদিনের আয়ের অর্ধেক ব্যয় করেন দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পেছনে

সঞ্জয় সরকার ॥ ত্রিশোর্ধ এক রিক্সাচালক। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রিক্সা চালান। রোদে পোড়েন। বৃষ্টিতে ভেজেন। তা থেকে যা আয় হয় তাতে তার নুন আনতে পান্তা ফুরায়। স্ত্রী-সন্তানসহ চার সদস্যের পরিবার নিয়ে কোনরকমে দিন গুজরান করেন। কিন্তু এর বাইরে অবিশ্বাস্য রকমের একটি বিরল কাজ করেন এই শ্রমজীবী যুবক। তা হলো প্রতিদিনের আয়ের অর্ধেক তিনি ব্যয় করেন দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পেছনে। এ কারণে লেখাপড়া না জানা নিম্ন আয়ের মানুষ হয়েও এলাকার সবার কাছে তিনি এখন অনুকরণীয়। কিছুটা ব্যতিক্রম চরিত্রের এই মানুষটির নাম তারা মিয়া (৩৩)। বাড়ি নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী দুর্গাপুর উপজেলার চকলেঙ্গুরা গ্রামে। দিনমজুর বাবা আব্দুল হেলিমের ছেলে তারা মিয়া শৈশবে পরিবারের অভাব-অনটন ও অজ্ঞতার কারণে লেখাপড়া করতে পারেননি। তাই দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা ও উৎসাহ দেয়ার মধ্য দিয়ে লেখাপড়া শিখতে না পারার কষ্টটুকু ভুলে থাকার চেষ্টা করেন। জানা গেছে, ৭ বছর ধরে রিক্সা চালান তারা মিয়া। আগে পা-চালিত রিক্সা চালাতেন। এখন ব্যাটারিচালিত রিক্সা চালান। এতে দৈনিক গড়ে সাতশ’ টাকা আয় হয় তার। আয় যেমনই হোক, প্রতিদিন তার অর্ধেক খরচ করেন সংসারের জন্য। আর বাকি অর্ধেক রেখে দেন। এভাবে মাস শেষে কিছু টাকা জমা হলেই তা দিয়ে খাতা, কলম, স্কুল ব্যাগ, পেন্সিল বক্স, টিফিন বক্স, খেলাধুলার সরঞ্জাম কিনে নিয়ে ছুটে যান পূর্বনির্ধারিত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের সহযোগিতায় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বাছাই করে নিজ হাতে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেন তিনি। আর উৎসাহ দেন মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করার। দুর্গাপুর উপজেলার অপেক্ষাকৃত দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার ১৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসায় সাত বছর ধরে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে আসছেন তিনি। এসব শিক্ষার্থীর একটা বড় অংশ গারো, হাজং প্রভৃতি ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর। এর বাইরে চকলেঙ্গুরা গ্রামের একটি কবরস্থানও নিজ খরচে এবং শ্রমে রক্ষণাবেক্ষণ করেন। দুপুরের প্রখর রোদে বা বৃষ্টিতে ভিজে কোন শিক্ষার্থীকে বাড়ি ফিরতে দেখলে তাকে নিজ রিক্সায় উঠিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেন। নলুয়াপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অমিয় কুমার গুপ্ত বলেন, ‘তারা মিয়া প্রায় সময় আমার স্কুলে এসে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেন। করোনায় স্কুল বন্ধ হওয়ার কিছুদিন আগেও আমাদের স্কুলে ৯০টি খাতা, সাতটি টিফিন বক্স, ৩০টি বলপেন ও একটি ফুটবল বিতরণ করেছেন।’ ধানশিরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সাজেদা বেগম জানান, তার স্কুলে গত কিছুদিনে ৫শ’ ৭২টি খাতা বিতরণ করেছেন তারা মিয়া। চকলেঙ্গুরা গ্রামে অবস্থিত বায়তুল কোরান ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক নূর মোহাম্মদ জানান, মাসখানেকের মধ্যে তারা মিয়া দুই দফায় তার মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে কোরান শরীফ, খাতা, কলম ও ফুটবল বিতরণ করেছেন। এমন সহযোগিতা তিনি প্রায় সময়ই করেন, যোগ করেন নূর মোহাম্মদ। চকলেঙ্গুরা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল খালেক বলেন, ‘তারা মিয়া একজন দরিদ্র মানুষ। রিক্সা বেয়ে সংসার চালায়। কিন্তু মনের দিক দিয়ে অনেক বড়। প্রতিদিন তার আয়ের টাকার একটি অংশ জমা করে রাখে। মাস শেষে তা দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে স্কুলে স্কুলে বিতরণ করে। অথচ আমাদের চোখের সামনে এমন অনেক বিত্তবান আছেন- যারা সমাজের জন্য একটি টাকাও খরচ করেন না।’ জানা গেছে, তারা মিয়ার এমন শিক্ষাসহায়ক কর্মকা-ের খবর পেয়ে ‘ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড’ নামে রাজধানীর একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালে তাকে এক লাখ টাকা এবং ঢাকার অপর একটি গ্রুপ অব কোম্পানি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) চলতি বছর ৫০ হাজার টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল। সে টাকাও এলাকার দরিদ্র মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। একটি টাকাও রাখেননি নিজের জন্য। ওই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল খালেক জানালেন তার এমন মহানুভবতার কথা। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর প্রথম দিকে তারা মিয়ার আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপরও কারও কাছে সাহায্যের জন্য হাত বাড়াননি তিনি। উপরন্তু তার জমানো ১০ হাজার ২শ টাকা দুর্গাপুরের উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর করোনা সহায়তা তহবিলে জমা দিয়ে আলোচিত হন। ওই সময় একটি বেদেপল্লীর খাদ্যাভাবের কথা জানতে পেরে কয়েকটি চালের বস্তা এবং কিছু নগদ টাকা নিয়ে ছুটে গেছেন সেখানেও। ৫০ জন অতি দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীকে বাছাই করে তাদের মাঝেও বিতরণ করেছেন কিছু টাকা। করোনা পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও তারা মিয়ার শিক্ষা-সহায়তা কার্যক্রম এখনও চলমান। গ্রামে গ্রামে গিয়ে অথবা শিক্ষার্থীদের খবর পাঠিয়ে স্কুলে এনে শিক্ষা উপকরণ তুলে দিচ্ছেন তিনি। চকলেঙ্গুরা গ্রামের একটি চৌচালা টিনের ঘরে স্ত্রী, ১১ বছর বয়সী ছেলে রিফাত মিয়া ও দেড় বছর বয়সী মেয়ে সুমাইয়াকে নিয়ে বসবাস করেন তারা মিয়া। তার স্ত্রী নাজমা বেগম আগে সোমেশ্বরী নদীতে কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। কিছুদিন হয় ওই কাজ ছেড়ে দিয়ে এখন ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করেন। ছেলে রিফাত মিয়া স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলেমেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন এ দম্পতি। তারা মিয়ার কার্যক্রম সম্পর্কে তার স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী অনেক বড় মনের মানুষ। তা না অইলে রিক্সা বাইয়া এমন কাম করতে পারত না। উনি এভাবে খরচ না করলে হয়তো আমরা আরেকটু ভালাভাবে খাইতে-পরতে পারতাম। কিন্তু তা নিয়া কোন দুঃখু নাই আমরার। তার মাধ্যমে অনেক গরিব-ছেলেমেয়ে লেহাপড়ার উৎসাহ পাইতাছে- এইটা শুনলে আমার খুব ভালা লাগে।’ এমন মহৎ কাজের উদ্দেশ্য কী? জানতে চাইলে তারা মিয়া বলেন, ‘পরিবারের অভাব-অনটন আর অসচেতনতার কারণে ছোডু বেলায় লেহাপড়া শিখতাম পারি নাই। বড় অইয়া যখন বুঝতাম পারছি নিরক্ষর জীবন মূল্যহীন- তহন আর কিছুই করার ছিল না। তাই আমি চাই, টেহা-পয়সার লাইগ্যা যাতে কোন বাচ্চার লেহাপড়া বন্ধ না অয়। হয়তো আমি সবার অভাব দূর করতাম পারতাম না। কিন্তু সামান্য সহযোগিতা বা একটু উৎসাহ তো দিতাম পারবাম। এইডা চিন্তা কইরাই আমি এইসব কাজ করতাছি। আমি কোন ইস্কুলে গেলে ছেলেমেয়েরা খুব আনন্দ পায়। তাদের লেহাপড়ার প্রতি উৎসাহ বাড়ে।’ সরকার বা সমাজের অন্য কারও কাছে কিছু চাওয়ার আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘কারও কাছে আমি কিছু চাই না। শুধু দোয়া চাই- যাতে সারাজীবন এই কাজডা করতাম পারি।’ তারা মিয়ার মানবিক কার্যক্রম সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত দুর্গাপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ফারজানা খানম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা মিয়া একজন মহৎপ্রাণ এবং সাদামনের মানুষ। আত্মপ্রচারের ধার ধারেন না। একজন রিক্সাচালক হয়েও দেশ বা সমাজ নিয়ে ভাবেন। শিক্ষার প্রসারের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। তার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। তিনি আমাদের কাছে একটি বিরল উদাহরণ।’ তারা মিয়াকে দেখে সমাজের বিত্তবান মানুষদেরও এ ধরনের সমাজকল্যাণমূলক কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এ কর্মকর্তা।
×