ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি বহুমুখীকরণে দেশ অগ্রগামী

প্রকাশিত: ০০:৫১, ১৭ জানুয়ারি ২০২১

কৃষি বহুমুখীকরণে দেশ অগ্রগামী

কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশে দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে প্রকৃতি ও জনসংখ্যার সঙ্গে সমন্বয় রাখতে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলেছে। স্বাধীনতার পূর্বে যেখানে সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন চাহিদায় হিমশিম খেতে হতো, কাল পরিক্রমায় স্বাধীনতার চার দশক পর ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মিটানো সংগ্রামে নিয়োজিত বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা। সময়ের বিবর্তনে এসেছে নতুন নতুন ফসল, প্রসারিত হচ্ছে নব নব প্রযুক্তি। ১৯৭০ সালে দেশে চাল উৎপাদন হতো প্রায় এক কোটি টনের মতো। কৃষিকে বহুমুখীকরণে বাংলাদেশ এখন অনেক অগ্রগামী। কৃষি সেক্টরে ধান, পাটের পাশাপাশি মৎস্য ও পশু পালন, দুগ্ধ উৎপাদন, হাঁস-মুরগি পালন, নার্সারি, বনায়ন এবং কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটছে বাংলাদেশে। কাজেই কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য কৃষকের কথা বলতে হবে। কৃষকের কথা শুনতে হবে। কৃষক বাঁচলে কৃষি বাঁচবে। কৃষি বাঁচলে দেশ বাঁচবে। কৃষকের জ্ঞানকে স্বীকৃতি দিতে হবে : কৃষি আমাদের সমৃদ্ধির অন্যতম উৎস। এই কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন গ্রাম বাংলার কৃষক। বন্যা, খরা কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই দমাতে পারেনি বাংলার কৃষকদের। নিঃস্ব, শূন্য অবস্থান থেকেও বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলার কৃষক। ফলিয়েছে সোনার ফসল। কৃষকরা প্রকৃতি ও স্বভাবগতভাবে উদ্ভাবক, সৃজনীক্ষমতার অধিকারী ও প্রকৃতি বিজ্ঞানী। গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাত্ত্বিক সূত্র না জানলেও নিবিষ্ট চিন্তা-চর্চা ও প্রকৃতির গতিবিধির সঙ্গে সখ্যর খেলায় উদ্ভাবন করেন নতুন পদ্ধতি-প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিক চর্চায় নতুন জাতের ‘হরি ধান’ উদ্ভাবন করে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন কৃষক হরিপদ কাপালি। তিনি পেয়েছেন চ্যানেল আইয়ের স্বীকৃতিÑ কৃষি পদক। আবার অনেক কৃষক নিবিষ্ট মনে কাজ করে যাচ্ছেন। উদ্ভাবন করছেন নতুন নতুন জাতের ফসল এবং কৃষিবান্ধব প্রযুক্তি। যশোর অঞ্চলের আফাজ পাগলার ঔষধি গ্রাম, কার্তিক প্রামাণিক কিংবা আজিজ কোম্পানির বৃক্ষপ্রেম এখন রেঁনেসা’স দৃষ্টান্ত। চ্যানেল আইয়ের কৃষি পদক এ ধরনের উদ্যোগের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও বটে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃষকদের স্বীকৃতি দিতে হবে। কৃষি গবেষকদের সঙ্গে কৃষকের যোগসূত্র তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। কৃষক ও প্রযুক্তি-প্রজন্মের মেলবন্ধন : এখন অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগ। চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ-সুবিধাসহ তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের ফলে কৃষকরা অনলাইনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রিতে ছয়গুণ বেশি লাভ করতে পারছে। অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ সুযোগটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে সম্ভব। এর ফলে কৃষক ন্যায্যমূল্যের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়েও সমৃদ্ধ ও সচেতন হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটলে তরুণরাও হয়ে উঠবে কর্মোদ্দীপক। ২ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে মেধা, শ্রম, পুঁজি ও সময় খাটিয়ে যতটুকু লাভবান হবে- তার চেয়ে বহুগুণে দেশের মাটিতে কম টাকা বিনিয়োগ করে গ্রামীণ এলাকা থেকেও বিপুল আয় করা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের কৃষি ভাবনা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন, গ্রামের উন্নতির মধ্যেই সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভরশীল। কেননা, আমাদের শহুরে জীবনের উপভোগ্য অধিকাংশই গ্রাম থেকে আসে। তাহলে গ্রামের কৃষকদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারলেই সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন ঘটবে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য কৃষিকে বহুমুখী করার বিকল্প নেই। তাই তিনি কি করে কৃষককে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করা যায়, উৎপাদন বাড়াতে কিভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যায়, কৃষকের সন্তানকে কি করে শিক্ষা দেয়া যায়Ñ এসব নিয়ে ভেবেছেন এবং কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল পুরস্কারের ১০ লাখ ৮০ হাজার জমা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন কৃষি ব্যাংক। কৃষির উন্নয়নে তিনি নিজের সন্তান, জামাতা এবং বন্ধু পুত্রকে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজে না পাঠিয়ে ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠান। উচ্চশিক্ষায় উন্নত ভদ্রলোক হওয়ার চেয়ে উন্নত কৃষক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তিনি বহু আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কমছে মাটির উর্বরা শক্তি : প্রকৃতির বিপক্ষে চলে যাচ্ছে মানুষ। গাছ কেটে সাবার করছে বন-জঙ্গল। বেশি ফলনের আশায় মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কমে যাচ্ছে মাটির প্রকৃতিগত উর্বরা শক্তি। বিষের বিষবাষ্পে এখন ঘরে ঘরে হানা দিচ্ছে ডায়াবেটিস, আলসার, ক্যান্সার। এসব দৈনদশা থেকে বাঁচতে হলে কৃষককে সচেতন করার বিকল্প নেই। কমছে আবাদি জমি : নীতিমালা না থাকায় কৃষি জমি ব্যবহার করে বানানো হচ্ছে কল-কারখানা, ঘরবাড়ি, রাস্তা-ঘাট, ইটখোলা প্রভৃতি। ফলে প্রতিবছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর কৃষি জমি। আশার কথা হলো, কৃষি আইন কার্যকরণে সরকার উদ্যোগী ও মনোযোগী হয়েছে। কৃষিজমি সংরক্ষণ আইন চূড়ান্ত হয়েছে। কৃষি জমিতে স্থাপনা নিষিদ্ধ হচ্ছে। লক্ষ্য রাখতে হবে- উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কৃষি জমি যেন নষ্ট না হয়। কৃষি শুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী মোট কৃষি জমির পরিমাণ ১ কোটি ৯০ লাখ ৯৮ হাজার একর। দেশে পরিত্যক্ত জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৮৭ দশমিক ৪০ একর। এরমধ্যে ইজারার মাধ্যমে ১ হাজার ১৪৫ দশমিক ৫৩ একর সরকারের দখলে এবং ১ হাজার ৯৪১ দশমিক ৮৭ একর বেদখলে রয়েছে। অনাবাদি পতিত জমি ভূমিহীন ও বর্গাচাষীদের মাঝে বন্দোবস্ত করে দিলে উৎপাদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কৃষি ক্ষেত্রে সৌর বিদ্যুত : বোরো মৌসুমে দেশে প্রায় বিশ লাখ একর চাষযোগ্য জমিতে ১৬ লাখ ৩০ হাজার সেচ পাম্প ব্যবহৃত হয়। এরমধ্যে ১৬ লাখ একর জমি চাষে ব্যবহার হয় ১০ লাখ ৮০ হাজার বিদ্যুতচালিত সেচ পাম্প। বাকি ১১ লাখ ৫৮ হাজার সেচ পাম্প ব্যবহৃত হয় ডিজেল চালিত। সারা দেশে বিদ্যুত ও ডিজেল চালিত সেচপাম্পগুলোকে সৌর বিদ্যুতের আওতায় আনা সম্ভব হলে বছরে ৭৬০ মেঘাওয়াট বিদ্যুত ও ৮০ কোটি লিটার ডিজেল সাশ্রয় হবে। যার ফলে ডিজেল ও বিদ্যুত ক্ষেত্রে সরকারের ৮৫৩ কোটি টাকা ভর্তুকি বেঁচে যাবে। এই ভর্তুকির টাকাটা পরপর ৩ থেকে চার বছর সৌর বিদ্যুতের পেছনে ভর্তুকি হিসেবে ব্যয় করলে সরকার পরবর্তী ২০ বছরের জন্য ভর্তুকি প্রদান থেকে বেঁচে যাবে। পাশাপাশি জাতীয় বিদ্যুত তো সাশ্রয় হবেই। বাড়াতে হবে গ্রামীণ বিবিয়োগ : গ্রামের মানুষদের উপেক্ষা করে প্রকৃত উন্নয়ন অসম্ভব। গ্রামীণ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। গ্রাম এলাকায় অন্তত উপজেলা পর্যায়ে শিল্প, কারখানা, গার্মেন্টস, কুটির শিল্প স্থাপনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোক্তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। গ্রামীণ বিনিয়োগ বাড়লেই ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এলাকায় কাজ পেলে মানুষ আর শহরমুখী হবে না। শহরে মানুষের অযাচিত চাপ কমবে।
×