ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকছেই কিছু ধারায় সংস্কার আনা হচ্ছে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ল

দশটি ধারা নিয়ে বিপত্তি ॥ সড়ক আইন

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ২৯ নভেম্বর ২০২০

দশটি ধারা নিয়ে বিপত্তি ॥ সড়ক আইন

রাজন ভট্টাচার্য ॥ গত ২৭ অক্টোবর নেত্রকোনা সদর উপজেলার বাংলা এলাকায় একটি সিমেন্টবাহী ট্রাক চাপায় অটোরিক্সা চালক কমল মিয়াসহ দুই জনের মৃত্যু হয়। সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তÍ ব্যক্তির পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ও দোষী চালকের পাঁচ বছর কারাদণ্ড এমনকি উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পর মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের হস্তক্ষেপে স্থানীয় শালিসের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত অটো বিক্রি করে ৩০ হাজার টাকা ও নতুন অটো কেনার জন্য ৯০হাজার টাকা দেয়ার শর্তে পুরো ঘটনা মীমাংসা করা হয়। তাছাড়া দুর্ঘটনার জন্য শাস্তি দেয়ার কথা দণ্ডবিধি অনুযায়ী। নরহত্যা হলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড। হত্যা না হলে ৩০৪ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটালে ৩০৪ (বি) ধারা অনুযায়ী তিন বছরের কারাদণ্ড হওয়ার কথা। নতুন আইনে সড়ক দুর্ঘটনার সর্বোচ্চ শাস্তি করা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। আইনের ১০৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী, মোটরযান চলাচলজনিত দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে সেটি ১৮৬০ সালের পেনাল কোড অনুযায়ী অপরাধ বলে বিবেচিত হওয়ার কথা। অথচ এর কোন কিছুর পাত্তা নেই। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’-এ উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশের চালকদের পয়েন্ট যুক্ত করা হয়েছে। প্রতি চালকের জন্য বরাদ্দ ১২ পয়েন্ট। অপরাধ করলে পয়েন্ট কাটা যাবে। অপরাধ যত বাড়বে তত পয়েন্ট কাটার কথা। এভাবে অপরাধের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পয়েন্ট কাটতে কাটতে এক সময় শূন্য হলে লাইসেন্স বাতিল হবে। কিন্তু নানা জটিলতায় আইনের এই ধারাসহ অন্তত ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ধারা কার্যকর সম্ভব হচ্ছে না। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সারাদেশে তীব্র গণ আন্দোলনের মুখে নতুন আইন করে সরকার। অথচ দুই বছরের বেশি সময় পরও আইনটি পুরোপুরি কার্যকর সম্ভব হচ্ছে না। বিআরটিএ পক্ষ থেকে বিধিমালা তৈরির প্রস্তাব সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তা এখনও আইন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে চূড়ান্ত হয়নি। তেমনি আইনের অন্তত ১০টি ধারা পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছিল মালিক-শ্রমিকরা। ফলে আইনের এসব ধারা স্থগিত রেখে বাদবাকি কার্যকর করার কথা ছিল। বাস্তবতা হলো, গুরুত্বপূর্ণ সব ধারা স্থগিত থাকায় পুরো আইনটির কার্যকর প্রক্রিয়া ঝুলে গেছেÑ বলছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে বিআরটিএ কর্মকর্তারা। অথচ কয়েক দফা সময় নেয়ার পরও আপত্তি জানানো ধারাগুলো নিয়ে এখনও সরকারের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। এজন্য আবারও চলতি বছরের ৩১ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্বরাষ্ট্র-আইন ও রেল মন্ত্রণালয় জড়িত। তিন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে যৌক্তিক শাস্তি বিবেচনার জন্য সচিব পর্যায়েও একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যদিও আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দাবি জানানো ধারাগুলোর বিষয়ে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত জানানোর কথা রয়েছে। সড়ক আইনের বিধিমালা ও মালিক শ্রমিকের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা ধারাগুলোর সংস্কার নিয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ পরিচালক (অপারেশন) সীতাংশু শেখর বিশ্বাস জানান, এখনও সড়ক আইনের বিধিমালা চূড়ান্ত হয়নি। খসড়া বিধিমালা তৈরি করে বিআরটিএ থেকে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনেক আগেই পাঠানো হয়েছে। এখন বিধিমালা নিয়ে মন্ত্রণালয় যদি প্রয়োজন মনে করে সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বসা প্রয়োজন তবে হয়ত বসবে। তারপর আইন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বিধিমালা চূড়ান্ত হবে বলে জানান তিনি। মালিক শ্রমিকের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো ধারাগুলো নিয়ে সর্বশেষ কি হলো এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এসব ধারা বিচার-বিশ্লেষণের জন্য তিন মন্ত্রণালয় নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির বৈঠক হয়েছে শুনেছি। কিন্তু চূড়ান্ত কিছু আমরা এখনও হাতে পাইনি। থাকছে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ॥ সড়ক আইনের যেসব ধারা নিয়ে মালিক শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়েছিল সেসব যথাযথ কিনা তা বিচার-বিশ্লেষণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে সম্প্রতি দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আইন ও রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তি ও পরিবহন নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সূত্রে জানা গেছে, আপত্তি তোলা ধারাগুলো নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে অসঙ্গতি চিহ্নিত করে কিছু কিছু ধারায় প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা হচ্ছে বলে জানা গেছে। যেমন রাস্তা পারাপারে পথচারীকে ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছিল নতুন সড়ক আইনে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। এই ধারায় জরিমানা অনেকাংশে কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে আইনে যে পরিমাণ জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা যৌক্তিক পর্যায়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রাখার পক্ষে একমত হয়েছে সব পক্ষই। তবে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার পরিবর্তে তিন লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করার পর বাস্তবতার আলোকে আমরা কিছু ধারায় অসঙ্গতি লক্ষ্য করে সংস্কারের দাবি জানিয়েছিলাম। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। তিনি জানান, আপত্তি জানানো ধারাগুলোর বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে ইতোমধ্যে তিন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কিছু ধারা অপরিবর্তিত থাকছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত সংস্কারের প্রস্তাব আনা হয়েছে বলে জানান তিনি। আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান শেষ পর্যন্ত রাখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আইনটি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। সেখান থেকে সংসদে পাঠানো হবে। সেখানে আলোচনা শেষে চূড়ান্ত হওয়ার কথা জানান তিনি। শুরু থেকেই আইন নিয়ে জটিলতা ॥ প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় পর গত বছরের ১ নবেম্বর নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করে সরকার। কিন্তু সচেতনতার কথা বলে সরকার আইনের প্রয়োগ দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেয়। নতুন আইনে ৪১টি ধারায় বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ও ৫ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪টি ধারায় সর্বোচ্চ সাজা ২ বছর। বাকি ৭টি ধারায় সাজা ৩ বছর বা এরও বেশি। এই ৭টি ধারা ভ্রাম্যমাণ আদালতের এখতিয়ারের বাইরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, ২ বছরের কম কারাদণ্ড রয়েছে এমন ধারাই প্রয়োগ করতে পারবে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-বিল’টি সংসদে তোলা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর তা সংসদে পাস হয়। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর ৮ অক্টোবর আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এর আগে একই বছরের ৬ আগস্ট মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়া হয় ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’। তবে আইনটির ১-এর (২) ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির গেজেটের পর আইনটি কার্যকর করতে সরকারের পক্ষ থেকেও গেজেট প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু মালিক শ্রমিকের আপত্তির কারণেই এতদিন সরকার সেই গেজেট প্রকাশ করেনি। গুরুত্বপূর্ণ ১০ ধারা নিয়ে মালিক-শ্রমিকের আপত্তি ॥ আইনটি কার্যকর করার পর থেকে মালিক-শ্রমিকরা তীব্র আপত্তি জানায়। সারাদেশে বন্ধ হয়ে যায় সড়ক যোগাযোগ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসে সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নতুন সড়ক আইনের ৯টি ধারা পরিবর্তনের দাবি জানায়। এগুলো হচ্ছে: ৭৪, ৭৫, ৭৬, ৭৭, ৮৪, ৮৬, ৯০, ৯৮ ও ১০৫। এর মধ্যে ৮৪, ৯৮ ও ১০৫ ধারা সবচেয়ে কঠোর এবং এর অপরাধে মামলা অজামিনযোগ্য। এর বাইরে চালকের লাইসেন্সসংক্রান্ত ৬৬ ধারারও প্রয়োগ না করার দাবি জানানো হয়। সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, ৮৪ ধারায় মোটরযানের কারিগরি পরিবর্তনের বিষয়টি রয়েছে। ৯৮ ও ১০৫ ধারায় সড়ক দুর্ঘটনার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এই তিনটি ধারা সংশোধন করে অপরাধ জামিনযোগ্য করার দাবি মালিক-শ্রমিকের। এ ছাড়া এসব ধারায় থাকা তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানাও কমানোর দাবিও বেশ জোড়ালো। বাকি ছয়টি ধারায় জরিমানার পরিমাণ কমানোর দাবি করেছে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। আইন অনুসারে, ৭৪ ধারায় মোটরযানের ফিটনেস সনদ থাকার বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে। এই ধারা অমান্যের দায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। ৭৬ ধারায় ট্যাক্স-টোকেন হালনাগাদ না থাকলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। ৭৭ ধারায়, রুট পারমিট ছাড়া যানবাহন চালালে সর্বোচ্চ শাস্তি তিন মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানা। ৮৬ ধারায় অতিরিক্ত মাল বহনের নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে। এই অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকার জরিমানা। ৯০ ধারা অনুসারে, নির্ধারিত স্থানের বাইরে যানবাহন পার্ক করা যাবে না। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা। আইন কার্যকর করার পর সমঝোতা বৈঠকে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, পরিবহন চালকের ৮০ শতাংশই হালকা ও মাঝারি যানের লাইসেন্স নিয়ে ভারি যান চালাচ্ছেন। এই অপরাধে নতুন আইনের ৬৬ ধারায় ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বৈঠকে এই ধারা প্রয়োগ না করার দাবি করেন মালিক-শ্রমিকরা। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, মালিক-শ্রমিকের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আগামী বছরের জুন (২০২০) পর্যন্ত লাইসেন্সসংক্রান্ত ৬৬ ধারায় মামলা হবে না। অর্থাৎ এখন যার যে লাইসেন্স আছে, তা দিয়েই ভারি যানবাহন চালাতে পারবেন। এ সময়ের মধ্যে বিআরটিএর সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত লাইসেন্স হালনাগাদ করে নেয়ার পরামর্শ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ ছাড়া ৮৪ ধারার অপরাধেও চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নতুন আইনে শাস্তি হবে না বলেও মালিক-শ্রমিক নেতাদের সরকারের পক্ষ থেকে আশ^স্ত করা হয়। পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, আইনের প্রয়োগ করতে যাওয়া, এরপর মালিক শ্রমিকের আন্দোলন, সরকারের সঙ্গে বৈঠক, আইন প্রয়োগে শিথিলতা এসব বিষয় পরিবহন খাতে নতুন নয়। আসলে পরিবহন খাত বিশৃঙ্খলায় ভরা, অনেক কিছুই আছে, যা পুরোপুরি অবৈধ। কিন্তু অর্থনীতিতে এমনভাবে মিশে গেছে যে, তা বাদ দেয়া যাচ্ছে না। এখন পুরো পরিবহন ব্যবস্থায় একটা বড় অস্ত্রোপচার দরকার। অন্যথায় আইন ভোঁতা বা ধারালো, পরিপক্ব বা অপরিপক্ব কোনটাই প্রয়োগ করা যাবে না। আইনের এই ধারাগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান বলেছেন, আইন তো মেনে চলতেই হবে। কিন্তু আমাদের ওপর যে আইন দেয়া হইছে, কিছু কিছু ধারায় এমন জরিমানা ধার্য করছে যে সেটা গাড়ি চালিয়ে পরিশোধ সম্ভব না। জায়গা (জমি) বিক্রি করে দেয়া লাগবে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে। তাই আমরা বিভিন্ন ধারা বাস্তবসম্মত করার জন্য দাবি জানিয়েছি। আগামী এক জানুয়ারি থেকে পুরোপুরি আইন বাস্তবায়নের দাবি ॥ বহুল প্রত্যাশিত সড়ক পরিবহন আইন এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় গত ১ নবেম্বর নিরাপদ সড়কের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনরত সংগঠন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনে সংগঠনটির চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, এবার যদি আমরা এই আইন বাস্তবায়ন করতে না পারি, এবার যদি আমরা হেরে যাই, তাহলে হেরে যাবে পুরো বাংলাদেশ। নিসচার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, বিভিন্ন রকম প্রস্তুতি, দাবি, আব্দার এবং করোনা সমস্ত কিছু মিলিয়ে গত বছরের ১ নবেম্বর থেকে এ বছরের ১ নবেম্বর পর্যন্ত ১২মাস পার হয়ে গেছে। আগামী এক জানুয়ারি পর্যন্ত আরও ২মাস অর্থাৎ ১৪ মাস চলে যাচ্ছে। এই আইনটি ছিল জনগণের প্রত্যাশিত আইন। জনগণের প্রত্যাশিত আইনের কোন রকম ব্যত্যয় ঘটুক তা ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন মেনে নেবে না। আমরা চাই আগামী এক জানুয়ারি ২০২১ সাল হতে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এর পূর্ণ বাস্তবায়ন। তিনি বলেন, আমাদের দেশে সর্বমোট যানবাহনের সংখ্যা ৪৫ লাখ ৬৪ হাজার ২৮৪টি। এর মধ্যে ভারি যানবাহনের সংখ্যা ৩ লাখ ১৯ হাজার ১৪৭টি। নতুন সড়ক পরিবহন ২০১৮ আইনে শাস্তির যে কথা বলা হয়েছে তা শুধু তাদের একার জন্য করা হয়নি। এটি সর্বমহলের জন্য করা হয়েছে। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সরকার নতুন সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ প্রয়োগে যখনই উদ্যোগ নেয় তখনই পরিবহন সেক্টরের চক্র বাধা সৃষ্টি করে। আমি বলব, নতুন আইনের বিষয়ে তারা কোন প্রস্তুতি ইচ্ছে করেই নেয়নি এবং নিচ্ছে না। তারা শুধু দোষারোপ করে গেছে তাদের দুর্বলতা ঢাকার জন্য। সময় থাকতে গাড়ির লাইসেন্স, ফিটনেস এবং গাড়ির আকৃতি পরিবর্তনজনিত অনিয়ম ও ত্রুটিগুলো সংশোধনে তারা মনোযোগ দেয়নি। এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি যদি তারা নতুন আইন প্রয়োগের আগেই সমাধান করতেন তা হলে নতুন করে আইনের কয়েকটি বিষয় ছাড়ের সময়সীমা আর বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। সে সঙ্গে বলব এই আইন বাস্তবায়নে সরকারের যেসব স্টেকহোল্ডার রয়েছে সেখানেও এক ধরনের শৈথিল্য লক্ষ্য করছি। এই আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব যেমন আছে তেমনি সরকারের সেসব মহলের প্রতি নানা পদক্ষেপ নেয়া খুবই জরুরী। প্রয়োজন প্রস্তুতি ॥ নিসচা এক গবেষণায় বলছে, আইনটি প্রয়োগে মাঠে সক্রিয় থাকবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের পূর্ণ প্রস্তুত করতে প্রথমেই আসে যে মেশিন দ্বারা তারা জরিমানা করে সেটার আপডেট করা (বর্তমান আইন অনুযায়ী)। এর বাইরে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ প্রদান, গাড়ির লাইসেন্স, ফিটনেস এবং গাড়ির আকৃতি পরিবর্তনজনিত অনিয়ম ও ত্রুটিগুলো সংশোধনে বিআরটিএকে সক্ষম ও আধুনিকায়ন করা, ড্রাইভিং লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটার সিস্টেম আপগ্রেড করা, জনগণকে এই আইন সম্পর্কে সচেতন করতে ব্যাপক প্রচার/ক্যাম্পেনের অভাব দূর করা। কারণ এই আইনে যাত্রী পথচারীদেরও আওতায় আনা হয়েছে। সর্বোপরি এই আইনের অস্পষ্টতা দূর করতে বিধিমালা প্রণয়ন জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, এই আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে এই বিষয়গুলোর দিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ দাবি করছি। ৩১ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বশেষ সময়সীমা ॥ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হয় ২০১৮ সালে। এর প্রায় ১৫ মাস পর ২০১৯ সালের ১ নবেম্বর থেকে আইনটি কার্যকর শুরু করে সরকার। প্রথম ১৪ দিন সহনীয় মাত্রায় এর প্রয়োগ ছিল। পরবর্তীতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকের দাবিতে আইনের কয়েকটি বিষয় পরবর্তী ছয় মাস পর্যন্ত কন্সিডারের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পরবর্তীতে করোনার কারণে এই আইন যথাযথ প্রয়োগের সময়সীমা চলতি বছরের জুন থেকে বৃদ্ধি করে এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। সুপারিশে আছে বাস্তবায়নের নির্দেশনা ॥ ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদার এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ প্রণয়নে গঠিত কমিটি যে ১১১টি সুপারিশ করেছে, তাতে নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের পথনির্দেশ রয়েছে। এতে পুরো সড়ক ব্যবস্থাপনা সিসি টিভি ক্যামেরার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কেউ আইন ভঙ্গ না করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার শঙ্কা অমূলক। যারা অন্যায় করবেন, তাদেরই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পরিবহন মালিক হোক বা শ্রমিকসহ কারও চাপের মুখে নতি স্বীকার করা যাবে না। আইনের বাস্তবায়ন আটকে রাখা যাবে না। মানুষকে জিম্মি করে, সরকারকে বিব্রত করে যদি কেউ এই আইনের বাস্তবায়ন ঠেকানোর চেষ্টা করেন, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। এটাই এখন আমাদের দাবি। হয়নি বিধিমালা ॥ আইন হয়েছে দুই বছরের বেশি। কিন্তু কার্যকর করার জন্য বিধিমালা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বিধিমালা চূড়ান্ত করতে চলছে ফাইল চালাচালি। জানা গেছে, চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আইন কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। আইন কার্যকর করতে একজন অতিরিক্ত সচিব বিধিমালা তৈরির জন্য গঠিত কমিটির প্রধান। কিন্তু প্রস্তাবিত বিধিমালার খসড়া পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। রাস্তায় তাৎক্ষণিক জরিমানা করার যে যন্ত্র, সেটাও তারা হালনাগাদ করা সম্ভব হয়নি। অথচ প্রায় ৩৬ লাখ মোটরযানের ফিটনেস বাবদ বিআরটিএ বছরে ৫০০ কোটি টাকা নেয়। আর মাত্র ১০ কোটি টাকা খরচ করে। ৩৬ হাজার গাড়িপ্রতি একজন পরিদর্শক কাজ করেন বলে জানা গেছে। বিধিমালা ছাড়া আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে কোন বাধা আছে কিনা জানতে চাইলে বিআরটিএ সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খান বলেন, অনেক আইন কার্যকর হওয়ার ৫/৭বছর পর বিধিমালা হয়েছে এমন নজির আছে। কিন্তু সড়ক আইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিধিমালা জরুরী উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিধিমালা ছাড়া আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না। তাই বিধি প্রণয়নে এত সময় নেয়া ঠিক হয়নি। তিনি বলেন, যেসব ধারা সংস্কারের দাবি ছিল সেগুলো যদি চূড়ান্ত পর্যায়ে সংস্কার আনা হয় তবে আবারও বিধিমালা পরিবর্তন করতে হবে। ২০১০ সালে সড়ক আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এক পর্যায়ে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে আট বছর পর আইনটি চূড়ান্ত হয়। তবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে বাদ দিয়ে আইনটি পুরোপুরি কার্যকর করাও দুষ্কর। সেই বিবেচনায় ঝুলে থাকা ধারাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ফিটনেসহীন গাড়ির সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। বিআরটিএ যেটা বলে, সেটা মূলত ফিটনেসের মেয়াদ উত্তীর্ণ বিবেচনায়। ফিটনেস নেই মানে ডেট ঠিক নেই। তারিখ পার হলে বলে, এতগুলো গাড়ির ফিটনেস নেই। বাস্তবে গাড়ির লাইট, ব্রেক, সাসপেনশন ইত্যাদি ঠিক আছে কি না, এসব দেখা হয় না। মানবদেহ দেখার মতো গাড়ির দেহ পরীক্ষায় কোনো সিস্টেম বলে কিছু নেই। ল্যাব বলতে চারটি বড় জেলায় ছিল। তা নষ্ট করে রেখে দিয়েছে। এখন ঢাকায় হয়তো একটি সচল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা রিচার্স ইনস্টিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো ও দুর্ঘটনা কমাতে আইনের সঠিক প্রয়োগ অনেক উপাদানের একটি। তিনি বলেন, সড়ক আইনের বেশকিছু ধারা নিয়ে মালিক শ্রমিকদের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়েছিল। কিন্তু সেসব ধারা কতোটুকু সংশোধন করা হবে, আদো হবে কিনা এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোন ফলোআপ নেই। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এজন্য বারবার সময় বাড়ানো হলে আইনের পুরোপুরি প্রয়োগ কবে হবে। তিনি বলেন, সড়ককে নিরাপদ করার জন্য আইন থাকার পাশাপাশি দুর্ঘটনা কমাতে সড়কের প্রকৌশলগত ডিজাইন সঠিক হতে হবে। এ্র বাইরে চালকের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা, আনফিট পরিবহন মনিটরিং করা, জনসচেতনতা তৈরীর সঙ্গে আইন যথাযথ প্রয়োগ হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশি ভূমিকা রাখবে।
×