ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত অগ্নিকান্ডের ৮৭টি ঘটনা ঘটেছে ভূগর্ভস্থ জলাধার নেই

বহুতল ভবনের ঘিঞ্জি নগরী বগুড়া অগ্নিঝুঁকির মধ্যে

প্রকাশিত: ২০:০১, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

বহুতল ভবনের ঘিঞ্জি নগরী বগুড়া অগ্নিঝুঁকির মধ্যে

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ বহুতল ভবনের ঘিঞ্জি নগরী বগুড়ায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা বাড়ছে। বেশিরভাগ ঘটনার অন্যতম কারণ বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট। বৈদ্যুতিক পোলগুলোতে সংযোগের তার দেখে মনে হবে ওপরে কোন ক্যাবল ফ্যাক্টরির তার মাকড়সার জারের মতো বিছিয়ে আছে। নগরীর প্রধান সড়ক ছাড়া সবই অপ্রশস্ত ও সরু। পানির আধার পুকুরগুলো ভরাট করে স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী খালের মতো হওয়ায় বড় অগ্নিকান্ডে ফায়ার সার্ভিস পানির উৎস পায় না। দ্রুত অগ্নিনির্বাপণ করতে না পাড়ায় ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের এক হিসাবে বলা হয়েছে, চলতি জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত অগ্নিকান্ডের ৮৭টি ঘটনা ঘটেছে। যার ৪৫টি বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে। বাকি কারণগুলোর মধ্যে আছে চুলা, সিগারেটের ও মশার কয়েল, যন্ত্রাংশের ঘর্ষণ, বাজি পোড়ানো খেলা ও আগুন নিয়ে শিশুদের খেলা। গ্যাসের চুলা ও বার্নার থেকেও আগুন লাগছে। শহরতলী এলাকায় খোলা বাড়ির আঙিনায় চুলার উত্তপ্ত ছাই উড়ে গিয়ে অগ্নিকান্ড ঘটিয়ে দিচ্ছে। বগুড়া ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার বজলুর রশিদ জানান, বগুড়া নগরীর অধিকাংশ মার্কেট অগ্নিঝুঁকিতে আছে। ফিডার সড়কের ধারে ঘিঞ্জির মতো গড়ে ওঠা বহুতল ভবনগুলোর আশপাশে কোন জায়গা ছাড়া হয়নি। এসব সড়কের ধারের বাড়িগুলোতে আগুন লাগলে অগ্নিনির্বাপক কর্মী সহজে প্রবেশ করতে পারে না। ফায়ার সার্ভিসের পানির চওড়া গাড়ি ভেতরে ঢুকতে পারে না। বহুতল ভবনে আগুন লাগলে কর্মীদের মই বেয়ে উঠতে হয়। তারপরও ফায়ার সার্ভিসের ট্যাঙ্কের পানি ফুড়িয়ে গেলে নিকটে পানির আধার পাওয়া যায় না। দূরে থেকে পাইপ টেনে পানি আনতে অনেক সময় লেগে যায়। শহরে কয়েকটি নির্দিষ্ট পয়েন্টে ফায়ার হাইড্রেন্ট (ভূগর্ভস্থ জলাধার) থাকলে আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। শহরে কোন ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই। যারা বহুতল বাড়ি নির্মাণ করছেন তাদের মাত্র পাঁচ শতাংশ ভূগর্ভের পানি রিজার্ভার নির্মাণ করছে। বাকিরা ওয়াটার রিজার্ভারের পরিবর্তে বাণিজ্যিক ভাবনায় মাটির নিচে গাড়ি গ্যারেজ ও পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখছে। বগুড়ায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে নিউ মার্কেট, মোকাররম হোসেন খান মার্কেট ও বাবু মিয়া মার্কেট। মার্কেটগুলোর ক্রেতার হাঁটা-চলার জায়গা এত সরু যে, তিনজন লোক পাশাপশি হাঁটতে পারে না। দোতলা তিন তলায় ওঠার সিঁড়ি সরু। এই মার্কেটগুলোর মধ্যে আবার ঘিঞ্জি আবাসিক এলাকাও আছে। বেশিরভাগ দোকান ও বাসা-বাড়িতে অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থা নেই। ফায়ার এক্সটিংগুইসার নেই বেশিরভাগ দোকানে। বাসা-বাড়িতে তো নেইই। মার্কেটের বৈদ্যুতিক সংযোগের তারগুলো একই পোল থেকে এত বেশি টানা হয়েছে ওপরে তাকালেই মনে হবে এই বুঝি শর্টসার্কিট হয়। বগুড়া নিউ মার্কেটের একাধিক বার রাতে আগুনের ঘটনায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এসব অগ্নিকান্ডের কারণ ছিল শর্টসার্কিট। এমনও হয়েছে দোকান বন্ধ করার সময় মেন সুইচ অফ না করেই মালিক কর্মচারী বাড়িতে গেছেন। রাতেই খবর পান তাদের দোকানেই আগুন লেগেছে। বর্তমানে ৬৯ দশমিক ৫৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বগুড়া পৌর এলাকায় প্রায় ৭ লাখ মানুষের বাস। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করছে প্রায় ৮ হাজার মানুষ। জন ঘনত্বের হার সবচেয়ে বেশি। বাসা-বাড়ির সংখ্যা অন্তত ৬৭ হাজার। ৮০ শতাংশই বহুতল ভবন। অনেক বাসা-বাড়িতে বৈদ্যুতিক তার সার্ভিসিং করা হয় না। বৈদ্যুতিক পোলে যেমন ত্রুটিপূর্ণ তার ঝুলে থাকে অনেক বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ত্রুটিপূর্ণ তারেই সংযোগ থাকছে বছরের পর বছর। জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস অধিক ঝুঁকি নিউ মার্কেট ও বড় মার্কেটের মালিকদের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নিতে বলেছে। কোন কাজ হয়নি। মার্কেটের ভেতরে ভূগর্ভস্থ জলাধার নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। মার্কেট কর্তৃপক্ষ জলাধার নির্মাণ করেনি। কয়েকজন মালিক বললেন, তারা কেন আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভার নির্মাণ করবে। এটা করবে সরকার। জেলা প্রশাসন অনুরোধ জানিয়েছে, নিরাপত্তার স্বার্থে অগ্নিঝুঁকি এড়াতে মালিক পক্ষেরও এগিয়ে আসা দরকার। বৃহত্তর নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম বলেন, নিউ মার্কেট সংলগ্ন এলাকায় কাঁঠালতলা, চাঁদনীবাজার, গলাপট্টিসহ আশপাশে প্রায় ৪০টি মার্কেট আছে। তিনি মনে করেন সেখানে অন্তত দুটি ওয়াটার রিজার্ভার নির্মাণ করা দরকার। বছর কয়েক আগে পৌরসভা শহরের কয়েকটি পয়েন্টে ওয়াটার হাইড্রেন্ট নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল। বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে শুকনো মৌসুমে অগ্নিকান্ডের ঘটনা বেশি। সামনেই শুকনো মৌসুম।
×