ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিবন্ধন দেয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি

অযান্ত্রিক যানবাহন চলবে লাইসেন্সে

প্রকাশিত: ২০:০০, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

অযান্ত্রিক যানবাহন চলবে লাইসেন্সে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যানজটের কারণ হিসেবে রিক্সাভ্যানকে দায়ী করে দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীতে এই বাহনটির নতুন লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রেখেছে দুই সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি)। কিন্তু রাজস্ব বাড়ানোর কথা চিন্তা করে এবার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। চলতি অর্থবছর থেকে নতুন করে রিক্সাসহ অযান্ত্রিক সব যানবাহনের নিবন্ধন বা লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। একইসঙ্গে ডিএসসিসি এলাকায় মোটর, যন্ত্র, ইঞ্জিন বা ব্যাটারিচালিত রিক্সা ও ভ্যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় ধরা হয়েছে ২৪ কোটি টাকা। ডিএসসিসি বলছে, লাইসেন্স না থাকলেও অযান্ত্রিক অবৈধ এসব বাহন বন্ধ হচ্ছে না। তাই এগুলোকে নিবন্ধন দেয়ার পাশাপাশি শৃঙ্খলার মধ্যে এনে পরিচালনা করা হবে। তবে কী পরিমাণ নিবন্ধন দেয়া হবে তা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। দুই সিটি কর্পোরেশনের তথ্যমতে, রাজধানীতে লাইসেন্সধারী রিক্সা ও রিক্সাভ্যানের সংখ্যা মোট ৭৯ হাজার ৫৫৪টি। যদিও বাস্তবে এর সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। বলা হয়, ১৯৮৬ সাল থেকে গত ৩৪ বছরে এসব অযান্ত্রিক বাহনের (রিক্সা ও ভ্যান) নতুন লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রাখে সিটি কর্পোরেশন। যদিও এ সময়ে প্রতিদিনই রাস্তায় নেমেছে নতুন নতুন বাহন। এ অবস্থায় ‘অবৈধ’ এসব বাহনের নিবন্ধন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। অযান্ত্রিক বাহনকে নিবন্ধন দেয়ার জন্য একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে খসড়া তৈরি করেছে ডিএসসিসি। এতে বলা হয়েছে, ‘ডিএসসিসির আওতাধীন এলাকায় চলাচলরত অযান্ত্রিক যানবাহনকে নিবন্ধনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এমতাবস্থায় নিবন্ধন গ্রহণে আগ্রহী রিক্সা, ব্যক্তিগত রিক্সা, ভ্যানগাড়ি, ঠেলাগাড়ি, টালিগাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি তথা অযান্ত্রিক যানবাহন মালিকদের নিবন্ধন, নবায়ন ও মালিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত নিয়মাবলী অনুসরণ করতে অনুরোধ করা হলো।’ ‘নতুন নিয়ম অনুযায়ী নিবন্ধন, নবায়ন ও মালিকানা পরিবর্তনের জন্য নির্ধারিত আবেদনপত্রে আবেদন করতে হবে। প্রতিটি আবেদনপত্রের মূল্য ১০০ টাকা (অফেরতযোগ্য)। আবেদনপত্র আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর হতে ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখের মধ্যে ডিএসসিসির ভা-ার ও ক্রয় বিভাগ এবং আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো থেকে দফতর চলাকালীন নগদ ১০০ টাকায় ক্রয় করতে হবে। আবেদনপত্র যথাযথভাবে পূরণ করে নগর ভবনে স্থাপিত কেন্দ্রে আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর হতে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দফতর চলাকালীন জমা দেয়া যাবে। গৃহীত আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে যোগ্য বিবেচিত আবেদনগুলোর অনুকূলে প্রতিটি রিক্সা, ব্যক্তিগত রিক্সা, ভ্যানগাড়ি, ঠেলাগাড়ি, টালিগাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত ফি জমা নিয়ে নিবন্ধন প্রদান করা হবে। বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হওয়ার তারিখ থেকে ডিএসসিসি এলাকায় মোটরচালিত বা যন্ত্রচালিত বা ইঞ্জিনচালিত, ব্যাটারিচালিত রিক্সা, ভ্যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হলো।’ এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক (উপসচিব) বলেন, ‘আমরা অযান্ত্রিক যানবাহন নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এজন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। নগরীতে কী পরিমাণ নিবন্ধন দেয়া হবে সেটি কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে। আর নিবন্ধন বা লাইসেন্স ফি কত হবে তাও পরে জানানো হবে।’ চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) রিক্সা লাইসেন্স বাবদ ২৪ কোটি টাকা রাজস্ব ধরেছে ডিএসসিসি। এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘রিক্সা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। এই রিক্সা ঢাকা শহরের একটা বড় বৈশিষ্ট্য। এখানে রিক্সা থাকবে। আমরা এটাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার উদ্যোগ নিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের ৫০ হাজারের মতো রিক্সার নিবন্ধন রয়েছে। কিন্তু চলাচল করে আরও কয়েকগুণ বেশি। কতগুলো রিক্সা চলবে এবং কোন কোন সড়কে চলবে সেটা আমরা নির্ধারণ করে দেব। পাশাপাশি শহরের সড়কগুলোর কার্যকারিতা বাড়াতে কিছু রাস্তা থাকবে দ্রুতগতির যানবাহনের জন্য। কিছু থাকবে যেখানে রিক্সা চলবে। কিছু সড়ক থাকবে যেখানে শুধু হেঁটে চলাচল করা হবে। এই ধীরগতির যানবাহনে আমরা শহরকে উপভোগ করতে পারি। আমরা এর জন্য নিবন্ধন প্রক্রিয়াটাকে নতুন করে স্বচ্ছ করে দিচ্ছি।’ এ প্রসঙ্গে জাতীয় রিক্সা ভ্যান শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রিক্সা ভ্যান মালিক-শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব ইনসুর আলী বলেন, ‘২০০১ সালের ৬ নবেম্বর ৩৫ হাজার রিক্সা ও ৮ হাজার ভ্যানের লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে আমরা ৪৩ হাজার নামের তালিকা করে সিটি কর্পোরেশনে জমা দেই। তৎকালীন ডিসি ট্রাফিক (উত্তর ও দক্ষিণ) এর অফিসেও সেই ফাইল জমা দেই। এই লাইসেন্স পাওয়ার দাবিতে গত ১৮-২০ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু লাইসেন্সগুলো দেয়নি। সর্বশেষ গত পহেলা সেপ্টেম্বর মেয়র বরাবরে একটা স্মারকলিপি দেই। এর আলোকে অবৈধ রিক্সা উচ্ছেদ ও চুক্তি মোতাবেক লাইসেন্সগুলো গ্রহণ করে রাজস্ব গ্রহণের দাবি জানিয়েছি। পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত রিক্সা বন্ধ ও এর বাণিজ্যের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার দাবি জানিয়েছি। রিক্সার পাশাপাশি চালকদের লাইসেন্সও বাধ্যতামূলক দাবি করেছি। দীর্ঘদিন পরে হলেও কর্পোরেশন এই সিদ্ধান্ত নেয়ায় আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই। এটি আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল।’ তিনি জানান, দক্ষিণ সিটির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা বলেছেন ‘আমরা গণহারে লাইসেন্স দেব। আর ব্যাটারিচালিত রিক্সা বন্ধ করার জন্য একটা বিজ্ঞাপন করে দিয়েছি।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে লাইসেন্স দেয়া বন্ধ থাকলেও নগরীতে এসব বাহন বন্ধ হয়নি। এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে এক শ্রেণীর নামসর্বস্ব সমিতি ও সংগঠন। তারা রিক্সা বা ভ্যানের লাইসেন্সের নামে নম্বর প্লেট দিচ্ছে। একেকটি বাহনে এ ধরনের দুই থেকে পাঁচটি করে নম্বর প্লেট দেখা যায়। একেকটি নম্বর প্লেটের বিপরীতে বাহনপ্রতি তিন মাস অন্তর আদায় করা হচ্ছে ২০০-৪৫০ টাকা। আর লাইসেন্সের কথা বলে নেয়া হচ্ছে ১৫-২০ হাজার টাকা। ফলে লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রাখায় একদিকে যেমন রাজস্ব হারিয়েছে সিটি কর্পোরেশন, অন্যদিকে অতিরিক্ত বাহনের কারণে বাড়ছে যানজট। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে বৈধ রিক্সা ও ভ্যানের সংখ্যা সাড়ে ৭৯ হাজার। আর অবৈধ রিক্সার সংখ্যা ১০ লাখ। এই অবৈধ রিক্সার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে ২৮টি সংগঠন। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এসব সংগঠনের মধ্যে ঢাকা বিভাগ রিক্সা ও ভ্যান মালিক সমিতি, বাংলাদেশ রিক্সা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশন, মহানগর রিক্সা মালিক লীগ, রিক্সা ও ভ্যান মালিক-শ্রমিক লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ রিক্সা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশন, জাতীয় রিক্সা-ভ্যান শ্রমিক লীগ ও বাংলাদেশ রিক্সা মালিক লীগ, রিক্সা এবং শ্রমিক-মালিক লীগ, ঢাকা সিটি মুক্তিযোদ্ধা রিক্সা-ভ্যান মালিক কল্যাণ সোসাইটি অন্যতম। লাইসেন্সবিহীন এসব রিক্সা নিয়ন্ত্রণহীন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে সিটি কর্পোরেশন থেকে লাইসেন্স দেয়া রিক্সাগুলোর বিষয়েও এতদিন ছিল না কোন নিয়ন্ত্রণ বা বিধিমালা।
×