ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ময়মনসিংহের পাওয়ার গ্রিডে একাধিকবার অগ্নিকান্ডের নেপথ্যে-

প্রকাশিত: ২২:০৫, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০

ময়মনসিংহের পাওয়ার গ্রিডে একাধিকবার অগ্নিকান্ডের নেপথ্যে-

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ-পিজিসিবির ময়মনসিংহের কেওয়াটখালির পাওয়ার গ্রিডে একাধিকার ঘটেছে অগ্নিকান্ডের ঘটনা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারও এর মাত্র একদিন আগে গত মঙ্গলবারও শর্টসার্কিট থেকে ঘটেছে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা। এর আগেও বজ্রপাতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল। অথচ যে কোন বজ্রপাত ও শর্টসার্কিটের মতো মারাত্মক সব দুর্ঘটনা প্রতিরোধে গ্রিডের ভেতর রয়েছে লাইটিং এরেস্টার-এলএ, ব্রেকার, সিটি ও রিলে সিস্টেম। কিন্তু গ্রিডের এসব সুরক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকর প্রমাণ করে একের পর এক ঘটছে এসব দুর্ঘটনা। প্রতিটি বজ্রপাত কিংবা শর্টসার্কিটের সময় ‘ইক্যুইপমেন্ট ফেল’ করায় মূলত ঘটছে অগ্নিকান্ডের মতো দুর্ঘটনা। গ্রিডের পাওয়ার ট্রান্সফরমার ও প্যানেল কন্ট্রোলসহ বেশিরভাগ ইক্যুইপমেন্ট সরবরাহ দিয়েছে এনার্জিপ্যাক। এসব ইক্যুইপমেন্টের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটিকেও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন অনেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। এই সঙ্কটের সমাধানে পাওয়ার গ্রিডের আধুনিকায়ন ও মানসম্পন্ন ইক্যুইপমেন্ট স্থাপনসহ আপগ্রেডের কোন বিকল্প নেই বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। স্থানীয় সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ময়মনসিংহের কেওয়াটখালির পাওয়ার গ্রিডের ১ লাখ ৩৩ কেভির গ্রিড সাবস্টেশন থেকে ৩৩ কেভির সাবস্টেশনের সার্কিট ব্রেকার পর্যন্ত পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ-পিজিসিবি নিয়ন্ত্রণ ও দেখভাল করে থাকে। একই সীমানার ভেতর ৩৩ কেভির সাবস্টেশনের সার্কিট ব্রেকার ছাড়া বাকি অংশ নিয়ন্ত্রণ ও দেখভাল করে থাকে বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি। এখানকার কন্ট্রোলরুমের কন্ট্রোল প্যানেল থেকে পুরো সিস্টেমকে আবার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে পিজিসিবি। স্থানীয় নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল হক জানান, কেওয়াটখালি পাওয়ার গ্রিডের এই ১ লাখ ৩৩ কেভির গ্রিডসহ ৩৩ কেভির সাবস্টেশনকে বজ্রপাত থেকে রক্ষায় রেটিং ক্যাপাসিটি অনুযায়ী লাইটিং এরেস্টার-এলএ লাগানো রয়েছে। শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকান্ডের প্রটেকশনে কন্ট্রোল প্যানেলে রয়েছে রিলে সিস্টেম। এর বাইরে ব্রেকার ও সিটি সিস্টেম রয়েছে। যে কোন পর্যায়ে শর্টসার্কিট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সিস্টেম ট্রিপ করে ইক্যুইপমেন্টকে সুরক্ষা দেয়ার কথা। অথচ গ্রিডের ওপর প্রতিটি বজ্রপাত কিংবা শর্টসার্কিটের সময় এসব সুরক্ষা কোন কাজেই আসছে না দাবি করে ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় বিতরণ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, পিজিসিবির কাছে এসব দুর্ঘটনার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। শতভাগ সুরক্ষার কথা বলা হলেও কী কারণে বার বার এমন দুর্ঘটনা ঘটছে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে আলাপকালে তা জানতে চাওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের দুর্ঘটনা আর না ঘটে সেজন্য গ্রিডের শতভাগ সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে এ সময়। বার বার দুর্ঘটনা কারণ জানতে চাইলে বিদ্যুত বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ ময়মনসিংহ দক্ষিণের নির্বাহী প্রকৌশলী ইন্দ্রজিৎ দেবনাথ জানান। কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত কমিটিই সেটি বলতে পারবে। তদন্ত ছাড়া এ নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না বলেও জানান তিনি। তবে ইক্যুইপমেন্ট ফেল করায় মূলত এমনটি হচ্ছে বলে ধারণা এই প্রকৌশলীর। নাম প্রকাশ করা হবে না শর্তে গ্রিডের সাবেক এক প্রকৌশলী জানান, বজ্রপাত ঠেকাতে স্থাপন করা লাইটিং এরেস্টার উচ্চমাত্রার বজ্রপাত ঠেকাতে সক্ষম নয় বলেই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। এর আগে ২০০৯ সালে বজ্রপাতে ৩৩ কেভি সাবস্টেশনের ট্রান্সফরমার আগুন লেগে পুড়ে গিয়েছিল। একইভাবে কোথাও তার ছিঁড়ে গেলে পাওয়ার ট্রান্সফরমার কিংবা ব্রেকারে শর্টসার্কিট হতে পারে উল্লেখ করে এই প্রকৌশলী আরও জানান, এসময় উচ্চমাত্রার ভোল্টেজের কারণে কন্ট্রোল প্যানেলের রিলে সিস্টেম অকার্যকর হতে পারে। তবে বেশিরভাগ শর্টসার্কিটের ঘটনায় বার্ন হচ্ছে কন্ট্রোল প্যানেল। অথচ কন্ট্রোল প্যানেলকে রক্ষায় রয়েছে রিলে সিস্টেম। কিন্তু প্রতিটি দুর্ঘটনায় এই সিস্টেম অকার্যকর প্রমাণ হওয়ায় এনার্জি প্যাকের সরবরাহ করা ইক্যুইপমেন্টের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব ব্যাপারে পিজিসিবির কর্তৃপক্ষীয় সূত্র জানায়, প্রটেকশন টিম টেস্ট করার পরই বাজার থেকে বেস্ট কোয়ালিটির প্রতিটি ইক্যুইপমেন্ট নেয়া হচ্ছে। তারপরও ইক্যুইপমেন্ট ফেল করা অস্বাভাবিক কিছুই নয় দাবি করে নাম প্রকাশ করা হবে না শর্তে পিজিসিবির উর্ধতন প্রকৌশলীর এই সূত্র জানায়, বেস্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের পরও ইক্যুইপমেন্ট ফেল করায় বার বার এই দুর্ঘটনা ঘটছে। তদন্ত কমিটি এটি বের করতে কাজ করছে। এই ক্ষেত্রে প্যারালাল ইক্যুইপমেন্ট স্থাপনসহ গ্রিডের আপগ্রেড করার কথা ভাবা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। বার বার দুর্ঘটনার জন্য ঘুরেফিরে দুর্বল সুরক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি গ্রিডে সরবরাহ করা এনার্জি প্যাকের পাওয়ার ট্রান্সফরমার ও কন্ট্রোল প্যানেলের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এ নিয়ে খোদ পিডিবির ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলীও বিব্রত। বিষয়টি নিয়ে তিনিও নালিশ করেছেন পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে। তবে বিষয়টি পরিষ্কারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত। এদিকে দুর্ঘটনার জন্য বিতরণ ব্যবস্থাকেও দায়ী করেছেন অনেকে। বিতরণ ব্যবস্থায় সমস্যার কারণে গ্রিড সচল হলেও পুরোপুরি বিদ্যুত সরবরাহ দিতে পারেনি পিডিবি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সকালে গ্রিডের ৩৩ কেভির সাবস্টেশন থেকে মুক্তাগাছা পল্লী বিদ্যুত সমিতিকে বিদ্যুত সরবরাহ দেয়ার সময় ঘটে দুর্ঘটনাটি। অভিযোগ উঠেছে, মুক্তাগাছা পল্লী বিদ্যুত সমিতির বিতরণ ব্যবস্থায় ত্রুটি আছে কিনা তা নিশ্চিত না করেই সরবরাহ নিতে গেলে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময় ব্রেকারের আগুন থেকে কন্ট্রোল প্যানেল পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর একদিন আগে গত মঙ্গলবার দুপুরেও পাওয়ার গ্রিডে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। অগ্নিকান্ডের কারণ অনুসন্ধানে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন ও পিজিসিবি আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক জাহাঙ্গীর আলমকে প্রধান করে জেলা প্রশাসনের গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আবুল হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রশাসন শাহজাহান মিয়া, পিডিবির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ ও পিজিসিবির স্থানীয় নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান। পিজিসিবির ওএ্যান্ডএম পরিচালক মাসুম আলম বকশিকে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যের কমিটিতে রয়েছেন পিজিসিবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফয়জুল কবীর, মিজানুল হাসান ও ওবায়দুল ইসলাম। দুটি কমিটিকেই ৩ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
×