ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ কোভিডের কাল বুঝিবা শেষ হলো। ভাবা হচ্ছে বটে শেষ হলো, আসলে আর শেষ হচ্ছে কই? প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে এই সমাজের জন্য রাষ্ট্রের জন্য যাদের বেঁচে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সারাজীবন নানাভাবে কাজ করে গেছেন তাদের চলে যাওয়া অসীম বেদনার জন্ম দিয়েছে। এরই মাঝে প্রগতিবাদী চিন্তার মানবিক আদর্শের কয়েকজন মানুষ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হলো জিয়াউদ্দিন তারিক আলী নামটি। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত সোমবার মৃত্যু হয় তার। নিভৃতচারী মহাপ্রাণ। এই নিভৃতচারী এত প্রচারবিমুখ ছিলেন যে, অনেকেই তাকে চিনতেন না! সাধারণের কথা বাদই দিলাম, যাদের চেনা আবশ্যক ছিল তাদেরও কেউ কেউ লজ্জার মাথা খেয়ে এখন জিজ্ঞেস করছেন, আচ্ছা, জিয়াউদ্দিন তারিক আলী কে? বস্তুত এই মহান ব্যক্তির মৃত্যু আমাদের জানাশোনা ও জ্ঞানের পরিধিকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করল। নিজেরাই ছোট হলাম আমরা। ফেসবুকে ইউটিউবে কত বিচিত্র ব্যক্তির চর্চায় সময় নষ্ট করছি, অথচ তারিক আলীর মতো ব্যক্তিত্বদের বেলায় উদাসীন! জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর প্রধান পরিচয় তিনি একজন দেশপ্রেমিক। সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশপ্রেমটাকেই সবচেয়ে বড় তপস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে যে গানের দলটি মুক্তাঞ্চল ঘুরে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করেছিল, সে দলের উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন তিনি। বেণু, লুবনা মারিয়াম, বিপুল ভট্টাচার্য, দেবব্রত চৌধুরী, স্বপন চৌধুরী, শারমিন মুর্শিদ, নায়লা খান, লতা চৌধুরী, দুলাল, চন্দ্র শীলদের সঙ্গে সমানভাবে সক্রিয় ছিলেন। সে সময়ের দুর্লভ ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে ‘মুক্তির গান’ নামে অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন খ্যাতিমান পরিচালক তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ। চলচ্চিত্রটি দর্শকদের বিপুলভাবে আলোড়িত করেছিল। একইভাবে দৃষ্টি কেড়েছিলেন যুবক বয়সী জিয়াউদ্দিন তারিক আলী। হালকা পাতলা গড়ন। চশমা পরা চোখ। ছবিতে গল্প কথকের ভূমিকা নিভিয়েছিলেন তিনি। বুলবুল ললিতকলা একাডেমির শিক্ষার্থী ছিলেন। গাইতে পারতেন ভাল। কোরাসে কণ্ঠও দিয়েছেন। সাধারণ দর্শক নিশ্চয়ই এখন মিলিয়ে নিতে পারছেন। স্মার্ট সেই যুবকের বয়স ক্রমে বেড়েছে। প্রবীণ হয়েছেন। কিন্তু দেশবোধ তার এতটুকু কমেনি। বরং বেড়েছে। স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ জাগিয়ে রাখতে, ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে কাজ করেছেন তিনি। অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল সমাজ গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের আরেক কীর্তিমান পুরুষ ওয়াহিদুল হকের সঙ্গী হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন তৃণমূলে। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন নামের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ২০০১ ও ২০০২ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় অসহায়দের উদ্ধার ও তাদের সহায়তায় কাজ করেন। পাশে দাঁড়ান। আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায়ও সোচ্চার ছিলেন। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে মানবিক রাষ্ট্র ও প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল বাঙালী, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে স্বেচ্ছা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার আরেক পরিচয় তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি। আরও পরিষ্কার করে বললে, জাদুঘরটির স্বপ্নদ্রষ্টাদের তিনি অন্যতম। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে দেশটির জন্ম হলো সে দেশে একাত্তরের রণাঙ্গনের ইতিহাস সংরক্ষণ ও আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার বড় কোন উদ্যোগ বহুকাল চোখে পড়েনি। মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন সংগ্রহ সংরক্ষণ ও ইতিহাস তুলে ধরার জন্য সরকারীভাবে দশটি বড় জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হলেও, একে বেশি বলার সুযোগ ছিল না। অথচ হয়নি একটিও। অতঃপর ব্যক্তি উদ্যোগে সচেতন নাগরিকদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। বলার অপেক্ষা রাখে না এ ধরনের প্রথম এবং একমাত্র জাদুঘর এটি। সমমনা আটজন একত্রিত হয়ে সেগুনবাগিচায় ভাড়া বাড়িতে শুরু করেছিলেন। এখন আগারগাঁওয়ে বিশাল ভবন। ভবনটিকে বাংলাদেশের জনগণ তাদের একান্ত নিজের বলে মনে করে। সরকারও সর্বোত্রভাবে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওই যে শুরুটা হয়েছিল, তারিক আলীর মতো মানুষেরা না হলে কি হতো? জিয়াউদ্দিন তারিক আলী এখানেই স্পেশাল। এখানেই অনন্য। তিনি আজ নেই। অথচ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে যাবে। এর চেয়ে স্বার্থক বেঁচে থাকা আর কাকে বলে? জাদুঘরটিকে কী যে আপন ভেবে আঁকড়ে ধরেছিলেন তিনি! অসংখ্য দিন জাদুঘরে গিয়ে দেখেছি স্কুলের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে মেতে আছেন তিনি। তাদেরকে তাদের মতো করেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনাচ্ছেন। ছোটদের গলায়। ছোটদের অভিব্যক্তি দিয়ে। মাঝে মাঝে দেখেছি মিলনায়তনে শত শত ছেলে-মেয়ে। সেইসব ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কোন একটি আসনে চুপটি করে বসে আছেন তিনি। জাদুঘরের যে কোন অনুষ্ঠানের শুরু বা শেষে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হতো। সবার মতো তারিক আলীও গাইতেন এবং প্রায় সবাই কোন না কোনদিন লক্ষ্য করেছেন যে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত একজন মানুষের, তিনি তারিক আলী! একাত্তরে মুক্তাঞ্চল ঘুরে গাইতেন, সেই স্মৃতি হয়ত মনে পড়ে যেত। অনুভব করতে পারতেন কত দামী এই স্বাধীনতা। কত ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া হয়েছে এই বাংলাদেশ। আমরা যারা বুঝতে চাই না, যারা অনুভব করি না মুক্তিযুদ্ধকে, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে নীরবে কাজ করে চলা মানুষগুলোকে নিজ উদ্যোগে খুঁজে নিতে অক্ষম, যারা টকশোতে ঘন ঘন দেখা মুখগুলো নিয়েই মেতে থাকি শুধু তাদের কি এবার চিনতে পারছি জিয়াউদ্দিন তারিক আলীকে?
×