ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চাঞ্চল্যকর সিনহা হত্যা প্রদীপ, লিয়াকতসহ ৭ পুলিশ ফের ৪ দিনের রিমান্ডে

এবার আসামিদের ক্রস এক্সামিন পর্ব শুরু

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ২৫ আগস্ট ২০২০

এবার আসামিদের ক্রস এক্সামিন পর্ব শুরু

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় এবার শুরু হচ্ছে আসামিদের বক্তব্য নিয়ে ‘ক্রস এক্সামিন’ পর্ব। অর্থাৎ তদন্ত শুরু হওয়ার পর উঠে আসা বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে আসামিদের মুখোমুখি করে বক্তব্য গ্রহণ, মামলার জব্দকৃত আলামতসহ আনুষঙ্গিক প্রমাণাদি নিয়ে যাচাই বাছাই করা। এ লক্ষ্যে মামলার প্রধান তিন আসামিসহ পুলিশের ৭ জনকে দ্বিতীয় দফায় ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এ সময় আদালতে মামলার প্রধান তিন আসামি প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী ও নন্দদুলাল রক্ষিত উপস্থিত ছিলেন। অপর ৪ পুলিশ আসামি রয়েছেন কারাগারে। এদিকে, এ হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। তদন্তে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে সোমবার এ ঘটনা নিয়ে মামলায় প্রধান তিন আসামিসহ ৭ পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মূলত দ্বিতীয় দফায় ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। অন্যতম আসামি ওসি প্রদীপ কুমার দাশ আদালতে তিনি অসুস্থ বলে জানান। কিন্তু তার এ দাবি প্রত্যাখ্যাত হয় সরকার পক্ষের দ্বারা। এ মামলা নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা সিনিয়র এএসপি খাইরুল ইসলাম ইতোমধ্যে বিভিন্ন আলামত নিজ হেফাজতে নেয়ার পাশাপাশি ঘটনাস্থলে সংঘটিত হত্যাকা-ের একটি প্রতীকী রিহার্সেলও সম্পন্ন করেছেন। মূল মামলার আসামিদের বাইরে গ্রেফতার করেছেন এপিবিএনের ৩ সদস্যসহ ৬ জনকে। এজাহারভুক্ত দুই আসামির এখনও কোন খোঁজ মেলেনি। এরা পুলিশের কোন সদস্য নয় বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়ার পর এ দু’জন কে তার কোন উত্তর মিলেনি। আবার এ ঘটনা নাম বিভ্রাটের কারণে হয়েছে কিনা সে প্রশ্নেরও সমাধান মিলেনি। সূত্র মতে, এ মামলার তদন্ত শেষে রিপোর্টে এ দু’জনের ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্য মিলবে। সোমবার বিকেলে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পুলিশের যে ৭ জনকে সোপর্দ করে দ্বিতীয় দফায় ৭ দিন করে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা খাইরুল ইসলাম। আসামি পক্ষের আইনজীবীরা পুনঃরিমান্ডের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। শুধু তাই নয়, আসামিদের রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়। বিশেষ করে অন্যতম আসামি সাবেক ওসি প্রদীপ কুমারের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখানো হয়। তদন্ত সংস্থার পক্ষে এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করা হয়। উল্লেখ্য, রিমান্ডে নেয়ার আগে র‌্যাবের পক্ষে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে সব আসামির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। এতে তারা সুস্থ ছিলেন এবং সোমবার আদালতে সোপর্দ করার সময়ও সুস্থ রয়েছেন বলে সংস্থার পক্ষে দাবি করা হয়। সোমবার যে ৭ পুলিশকে পুনরায় রিমান্ডে নেয়ার আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে তারা হলেনÑ সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, কিলার ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়া। গত ১৮ আগস্ট কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে এদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাব হেফাজতে নেয়া হয়। সাতদিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর সোমবার আদালতে সোপর্দ করে পুনঃআবেদন জানানোর পর ফের ৪ দিন রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। এদিকে তদন্ত সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সিনহার হত্যাকারী হলেন বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক ইনচাজ লিয়াকত আলী। ঘটনার পর তিনি নিজেই যে একজনকে ডাউন করেছেন বলে পুলিশ সুপারকে জানিয়েছেন। তিনি হলেন সিনহা। এ ব্যাপারে পুলিশ সুপারের সঙ্গে লিয়াকত আলীর টেলিফোনের কথপোকথনের ভিডিও কল আলামত হিসেবে সংগ্রহ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি এ ঘটনা নিয়ে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ ও পুলিশ সুপারের কথোপকথনের রেকর্ড সংগ্রহ করা হয়েছে। এ কথোপকথনে প্রদীপ এসপিকে জানিয়েছেন, শামলাপুর চেকপোস্টে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীকে গুলি করার চেষ্টা চলেছে। প্রদীপ তাকে পাল্টা গুলি করার অনুমতি দিয়েছেন বলে পুলিশ সুপারকে জানান দেন। কিন্তু তদন্তে এ পর্যন্ত সিনহার পক্ষ থেকে লিয়াকতকে গুলি করার কোন প্রয়াসই চালানো হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শী এবং সিনহার সঙ্গে থাকা সিফাত যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতেও এ ধরনের কোন প্রমাণ মিলেনি। ফলে বার বার যে বিষয়টি উঠে আসছে সেটি হচ্ছে গাড়ি আটকিয়ে সিনহাকে হাত তুলে নামতে বলার পরক্ষণেই লিয়াকত গুলি করেন সিনহাকে। যা দেড় থেকে দুই মিনিটের মধ্যে সংঘটিত হয় বলে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার ইতোমধ্যে জানান দিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দী এবং অন্য সাক্ষীদের বক্তব্য নিয়েই র‌্যাবের তদন্ত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। এ পর্যন্ত গ্রেফতারকৃত ৭ পুলিশ, ৩ এপিবিএন সদস্য, এ ঘটনা নিয়ে পুলিশের পক্ষে দায়ের করা মামলার ৩ আসামি মিলে গ্রেফতারকৃত মোট ১৩ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পাশাপাশি ঘটনাস্থল পরিদর্শন, থানার রেকর্ড যাচাই বাছাই, মামলায় রেকর্ডকারী কর্মকর্তার জবানবন্দী এবং পাশাপাশি সাক্ষী এবং ঘটনা দেখেছেন এবং পরবর্র্র্তীতে শুনেছেন এমন বক্তব্য রেকর্ড করেছে র‌্যাব। প্রথম দফা এ কার্যক্রম শেষে তদন্ত কর্মকর্তা একটি ধারণা নিয়েছেন কিভাবে সিনহাকে হত্যা করা হয়েছে। এখন তিনি জিজ্ঞাসাবাদে ‘ক্রস এক্সামিন’ করতে উদ্যোগী হয়েছেন। এর প্রথম ধাপ হিসেবে প্রধান তিন আসামিসহ ৭ পুলিশকে পরস্পর মুখোমুখি করে পুনঃজিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চেয়েছেন, আদালত তা মঞ্জুর করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদের দ্বিতীয় পর্বে আসামি এপিবিএনের ৩ সদস্য ও পুলিশী মামলার ৩ সাক্ষীকে পুনঃরিমান্ড চাওয়া হবে কিনা তা এখনও জানানো হয়নি। ঘটনার সময় শামলাপুর তল্লাশি চোকিতে এপিবিএনের যে ৩ সদস্য দায়িত্বরত ছিলেন এবং এ ঘটনায় আসামি হয়ে গ্রেফতার হয়েছেন তারা হলেন এসআই শাহজাহান, কনস্টেবল মোঃ রাজিব ও মোঃ আবদুল্লাহ। এছাড়া পুলিশী মামলায় সাক্ষী হওয়ার পর গ্রেফতার হয়েছেন মারিসবুনিয়ার অধিবাসী নুরুল আমিন, নাজিম উদ্দিন ও মোঃ আয়াছ। র‌্যাব এদের গ্রেফতার করে গত ১১ আগস্ট। প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই রাত সোয়া ৯টার পর শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনার পর পুলিশ এ সংক্রান্তে ৩টি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ৪ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শাহরিয়ার শারমিন ফেরদৌস নিজে বাদী হয়ে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়ার পুলিশ ফাঁড়ির তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর লিয়াকতসহ ৭ জনকে আসামি করে মামলার আবেদন করলে আদালত তা গ্রহণ করার জন্য থানাকে নির্দেশ দেন। মামলার পর প্রথমে ৭ পুলিশ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাদের জেলহাজতে পাঠান। পরবর্তীতে র‌্যাবের আবেদনের প্রেক্ষিতে এদের প্রত্যেককে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। আরও পরে গ্রেফতার করা হয় পুলিশী মামলার ৩ সাক্ষীকে এবং সর্বশেষ গ্রেফতার করা হয় তল্লাশি চৌকির এপিবিএনের ৩ সদস্যকে। মোট ১৫ জনের মধ্যে এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে ১৩ জন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিনহাকে সরাসরি গুলি করে হত্যার নায়ক ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী। হত্যার অনুমতি দিয়েছেন সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। এছাড়া এ ঘটনার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীর সঙ্গী হয়ে ওই সময় ঘটনাস্থলে যান এবং তিনি লিয়াকতের সঙ্গে মিলে গুলিবিদ্ধ সিনহাকে হাত-পা চেপে ধরার কাজে যুক্ত হন। ফলে নন্দদুলাল রক্ষিতও এ মামলার আসামি হয়ে জেলে রয়েছেন। তদন্ত সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, হত্যাকা-ের বিষয়টি উদঘাটিত। আসামিও চিহ্নিত। এখন শুধু বের করার চেষ্টা চলছে কেন অবসরপ্রাপ্ত এ সেনা কর্মকর্তাকে আকস্মিকভাবে এক পুলিশ অফিসার প্রথমে একটি ও পরে চারটি গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করলেন। এ ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি খাইরুল ইসলাম সোমবার জানিয়েছেন, তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ বহু তথ্য মিলেছে। যেগুলোর সত্যতা এখন যাচাই করা হচ্ছে। এ কারণে ৭ পুলিশ আসামিকে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডের আবেদনের পর আদালত তা মঞ্জুর করেছেন। মেজর সিনহা সড়ক নামকরণের দাবি ॥ কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক বাদ দিয়ে শহীদ মেজর সিনহা সড়ক নামকরণের দাবি উঠেছে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে। এ মেরিন ড্রাইভে বন্দুকযুদ্ধে অপরাধী নিরপরাধী অনেকের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ প্রাণ হারিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ পর্যন্ত তদন্তে তিনি সম্পূর্ণ নিরপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। পক্ষান্তরে, ঘটনার সময় পর্যন্ত টেকনাফ থানার ওসিসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্যুকর্মের এন্তার অভিযোগ মিলছে। কেউ কেউ ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এবং অনেকে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
×