স্টাফ রিপোর্টার ॥ জীবনের রং আর স্বাদ খুঁজে খুঁজে তিনি সিনেমা বানাতেন। সাদর আগ্রহ নিয়ে সেই ছবি মানুষকে দেখাতেন। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে, কখনও বা সীমানা ছাড়িয়ে। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক সার্থক ফেরিওয়ালা। তার ভাবনা, সৃষ্টি ও মনন প্রগতিশীল ধারার সকল মানুষকে প্রাণিত করছে তার মৃত্যুর পরও। বাংলাদেশের বিকল্পধারার এই কীর্তিমান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশী স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক ও গীতিকার। অন্যদিকে সাংবাদিকতার রূপকার মিশুক মুনীর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভিডিওগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘রানওয়ে’ ছবির প্রধান চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া তিনি বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্রতেও কাজ করেছেন।
চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও চলচ্চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরের নবম প্রয়াণ দিবস আজ বৃহস্পতিবার। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ‘কাগজের ফুল’ চলচ্চিত্রের শূটিং স্পট নির্বাচন করে ফেরার পথে মানিকগঞ্জের জোকায় এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় এই দুই গুণী ব্যক্তির সঙ্গে আরও তিনজন চলচ্চিত্রকর্মী নিহত হন।
চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও চলচ্চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরের নবম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে অনলাইনে এক স্মরণসভা হয় বুধবার রাতে। যৌথভাবে এ স্মরণসভার আয়োজন করে মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি ও তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশের ফেসবুক পেজে রাতে সরাসরি অনুষ্ঠিত হয় স্মৃতিতর্পণ। এতে অংশ নেন চলচ্চিত্রকার ক্যাথরিন মাসুদ, চলচ্চিত্র গবেষক অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, সাংবাদিক আসিফ মুনীর, মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক বেলায়েত হোসেন মামুন, শব্দগ্রাহক নাহিদ মাসুদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রসূন রহমান প্রমুখ।
বেলায়েত হোসেন মামুন বলেন, তারেক মাসুদকে আজকে বিশেষভাবে আমাদের দরকার ছিল। কারণ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জায়গাটা এখন এত বাজে যে অভিভাবকত্ব করার মতো কোন মানুষ এখন নাই। তারেক ভাইয়ের মতো এমন একজন মানুষ যদি থাকতেন তাহলে এই পরিস্থিতিতে পুরো বিষয়ের ওপর এক ধরনের নেতৃত্ব দেয়ার মতো বিষয় থাকতো। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের যে দুরবস্থা আমার মনে হয় তারেক মাসুদের শূন্যতা একটা বড় কারণ। বাংলাদেশের শিল্পধর্মী চলচ্চিত্রের যে যাত্রা সেটা তার মৃত্যুতে একটা বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। শত শত তরুণ চলচ্চিত্রকার যারা তারেক ভাইকে আইডল মনে করে, তাকে এক ধরনের পথপ্রদর্শক মনে করে যে আশান্বিত হয়ে উঠেছিলেন তাদের এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে সরকারী বা বেসরকারী পর্যায়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের যে নীতি নির্ধারণী কর্মকা- সেখানের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করার যে জায়গাটি সেটি কিন্তু অনেকখানি বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। চলচ্চিত্রের সংস্কৃতির জায়গা থেকে তার যে সামগ্রিক ভিশন ছিল, তার শূন্যতা আমরা অনুভব করছি। আমরা এ বিষয়ে প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছি জহির রায়হানের মৃত্যুতে, দ্বিতীয়টি আলমগীর কবিরের মৃত্যুতে, শেষ পর্যন্ত আমরা এই ধাক্কাটা খেয়েছি তারেক ভাইয়ের মৃত্যুতে। আমার মনে হয় তারেক ভাইয়ের মৃত্যু শুধু একজন ব্যক্তি চলচ্চিত্রকারের জায়গা থেকে নয়, আমাদের জাতিগতভাবে বাংলাদেশের মানুষ চলচ্চিত্রের শিল্পের যে উত্থান আমাদের হতে যাচ্ছিল বিশ্বব্যাপী সেই জায়গাটা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের চলচ্চিত্রের যে বাস্তবতা এখন তা দেখে মনে হয় যে, এই নয় বছর তারেক ভাই আমাদের মাঝে নেই, এই নয় বছরে আমরা খুব সামান্যও এগুতে পারিনি। আমরা যে জায়গাতে ছিলাম সেখান থেকে বরং অনেকখানি পিছিয়ে গেছি। তার অসমাপ্ত অনেকগুলো কাজ আছে সেগুলো সমাপ্ত বা কাজগুলো গুছিয়ে রাখার জন্য ক্যাথরিন যদি ওই দুর্ঘটনায় চলে যেতেন, তাহলে যে কাজগুলো পাচ্ছি সেভাবে পেতাম কিনা সন্দেহ হয়। ক্যাথরিন যদি অসমাপ্ত চলচ্চিত্র ‘কাগজের ফুল’ শেষ করেন তাহলে তারেক ভাইয়ের যে স্বপ্ন সেটি অনেকখানি বাস্তবায়িত হবে এবং একটা দুর্দান্ত ছবি আমরা পেতে পারি।
স্মৃতিচারণে অন্যরা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজনির্ভর প্রামাণ্যচিত্র মুক্তির গানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার হিসেবে তারেক মাসুদ বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। মূলত, এটাই তাকে দেশে চলচ্চিত্রকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একজন স্বাতন্ত্রিক চলচ্চিত্রকার। স্বাধীনধারার চলচ্চিত্রের এক জাত কারিগর তিনি। তার নির্মাণ ও ভাবনায় ভিন্নতর এক শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য প্রতীয়মান হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন সড়কদ্বীপে সংরক্ষিত তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর স্মরণে সড়ক দুর্ঘটনা স্মৃতি স্থাপনায় মঙ্গল প্রদীপ প্রজ¦ালন করা হবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সড়ক ও মহাসড়কে নিহত সকল মানুষকে স্মরণ করা হবে।
ফরিদপুর ॥ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তারেক মাসুদের জন্মভিটা ভাঙ্গা পৌরসভার নূরপুর মহল্লায় আজ তারেক মাসুদের গ্রামের বাড়িতে সীমিত আকারে বিভিন্ন কর্মসূচীর আয়োজন করেছে ‘তারেক মাসুদ ফাউন্ডেশন’।
ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও তারেক মাসুদের ছোট ভাই সাঈদ মাসুদ জানান, বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী মহামারী হয়ে ওঠা করোনার কারণে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন থাকায় সামজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তারেক মাসুদের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। এরপর সমাধি চত্ব¡রে তারেক মাসুদের ‘জীবন ও কর্মের ওপর’ সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: