ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাত খাতে ৫৩ হাজার কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তায় ১৫ হাজার কোটি বরাদ্দ

আসন্ন বাজেটে রেকর্ড ভর্তুকি-প্রণোদনা

প্রকাশিত: ২২:৫১, ৪ জুন ২০২০

আসন্ন বাজেটে রেকর্ড ভর্তুকি-প্রণোদনা

এম শাহজাহান ॥ করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় নতুন বাজেটে এবার রেকর্ড ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এই ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা, যা এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। এতে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, রফতানি বাজার শক্তিশালী ও রেমিটেন্স আহরণ বাড়বে বলে মনে করছে সরকার। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংক ঋণ গ্রহীতাদের দুই মাসের সুদ মওকুফ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ২ হাজার কোটি টাকার নতুন আরেকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে দেশের বেসরকারী খাত চাঙ্গা হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতি উত্তরণে এবার সবচেয়ে বেশি প্রণোদনা দেয়া হয়েছে কৃষি খাতে। এ খাতের প্রণোদনার পরিমাণ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া চালসহ অন্যান্য খাদ্য পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ৫ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকার ভর্তুকি রাখা হয়েছে। অর্থাৎ শুধু খাদ্য নিরাপত্তায় ভর্তুকি ও প্রণোদনার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এতে নতুন অর্থবছরে বাজারে খাদ্য পণ্যের সরবরাহ বাড়বে এবং জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে বাণিজমন্ত্রী টিপু মুনশি সম্প্রতি জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন বাজেট ঘোষণার পর এবার খাদ্য পণ্যের দাম কমবে। ইতিপূর্বে কখনও খাদ্যে এত ভর্তুকি দেয়া হয়নি। এছাড়া কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বড় প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বাজার স্বাভাবিক রাখতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। এদিকে, এবারও বড় অঙ্কের ভর্তুকি রয়েছে বিদ্যুত খাতে। এ খাতের ভর্তুকির পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকা। এতে বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তারা লাভবান হবেন সবচেয়ে বেশি। উৎপাদন খরচের চেয়ে কমমূল্যে শিল্পমালিকেরা বিদ্যুত কিনতে পারছেন। এবার রফতানিতে নগদ প্রণোদনা দেয়া হয়েছে ৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। এছাড়া করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন ৫ হাজার কোটি টাকা বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে দেয়া হচ্ছে। এতে এ খাত বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। এ প্রসঙ্গে পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক জনকণ্ঠকে বলেন, রফতানিতে নগদ প্রণোদনায় পোশাক খাত আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। নতুন বাজারে প্রবেশ করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, করোনার কারণে পোশাকসহ সব ধরনের রফতানি খাতে চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি বাড়ছে। তবে সরকারের প্রণোদনায় এগিয়ে যাবে এ খাত। এছাড়া এবারের বাজেটে রেমিটেন্স আহরণে ৩ হাজার ৮০ কোটি টাকা, পাটজাত দ্রব্যাদিতে ৫০০ কোটি টাকা, অন্যান্য খাতে ৯ হাজার কোটি টাকা এবং নগদ ঋণের জন্য ৬ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, এবারের বাজেট হচ্ছে করোনা থেকে উত্তরণ ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বাজেট। এ কারণে বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাড়ানো একটি ভাল দিক। এতে করোনার অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলানো যাবে। এদিকে, চলতি অর্থবছরে বাজেটে ৪৩ হাজার ২৩০ কোটি টাকার যে ভর্তুকি রাখা রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে গ্যাসে। এ বছর আমদানিকৃত রূপান্তরিত ঘণীভূত গ্যাস (এলএনজি) খাতে ভর্তুকির জন্য রাখা আছে ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিসি) ভর্তুকি হিসেবে দেয়া হচ্ছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বিজিএমসিকে দেয়া হচ্ছে ৪ হাজার কোটি টাকা। গার্মেন্টস খাতে এক শতাংশ প্রণোদনায় ব্যয় হবে ২ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। রেমিটেন্স খাতে ২ শতাংশ প্রণোদনায় খরচ হবে আরও ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা। এদিকে, বাজেটে মোট ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতে বরাদ্দও বাড়াচ্ছে সরকার। এবারই প্রথমবার ৫২ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণে থমকে গেছে অর্থনৈতিক কর্মকা-। বাংলাদেশে করোনার যে আচমকা আঘাত সেটার রেশ টানতে হবে অনেক বছর। অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ভর্তুকি, প্রণোদনার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। সাধারণত, ভর্তুকি বেশি দেয়া হয় কৃষি ও খাদ্য খাতে। আর প্রণোদনা বেশি দেয়া হয় কৃষি ও পোশাক রফতানি এবং পাট খাতে। এছাড়া নগদ ঋণ দেয়া হয়ে থাকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি), বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডসহ অন্যান্য সংস্থাকে। তবে বিপিসি, পিডিবিকে যে নগদ ঋণ দেয়া হয় সেগুলোকে এক ধরনের ভর্তুকি হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। কারণ এসব ঋণ সাধারণত সরকার ফেরত পায় না। যে কারণে পরে পুরো ঋণই অনুদান ভর্তুকিতে রূপান্তরিত হয়। বেসরকারী খাত থেকে বেশি দামে বিদ্যুত কিনে কম দামে বিদ্যুত পেতে পিডিবিকে ঋণ দেয় সরকার। অন্যবারের মতো আগামী অর্থবছরেও ভর্তুকিতেই বেশি বরাদ্দের প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ২৩ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। যা চলতি বাজেটের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৭৬১ কোটি টাকা বেশি। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২৪ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয় ২৩ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে ভর্তুকির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দেয়া হবে বিদ্যুত খাতে। বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণ প্রাথমিকভাবে প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর থেকে আগামী অর্থবছর এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা কমছে। চলতি অর্থবছর এ খাতে ভর্তুকি রয়েছে ৯৫০০ কোটি টাকা, খাদ্যে ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হচ্ছে ৫ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা, খাদ্যে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী বাজেটে বরাদ্দ বাড়ছে ১ হাজার ৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৪ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে সেটা কমিয়ে ৪ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা করা হয়। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রাক্কলন করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে যা ছিল ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা তবে সংশোধিত বাজেটে সেটি কমিয়ে রাখা হয় ৯ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। প্রণোদনা ॥ আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রণোদনার টাকা চলতি সংশোধিত বাজেটের চেয়ে বাড়ছে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ হচ্ছে ২২ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। যা চলতি সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। অবশ্য চলতি মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১৯ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয় ১৮ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে কৃষি খাতের জন্য হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রণোদনার রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে। চলতি বাজেটে যা রাখা হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। তবে পরবর্তীতে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে রাখা হয় ৮ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া চলতি বাজেটের সমান পরিমাণ ৬ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে রফতানি নগদ প্রণোদনার জন্য। এছাড়া পাট খাতের জন্য রাখা হচ্ছে চলতি বাজেটের ন্যায় ৫০০ কোটি টাকা এবং রেমিটেন্সে প্রণোদনার জন্য রাখা হচ্ছে ৩ হাজার ৮০ কোটি টাকা। নগদ ঋণ ॥ আসছে বাজেটে নগদ ঋণ খাতে ৬ হাজার কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এই ছয় হাজার কোটি টাকার মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ও বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) জন্য কোন বরাদ্দ রাখা হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরেও এ দুই খাতে কোন বরাদ্দ রাখেনি সরকার। আগামী বাজেটেও অন্যান্য খাতে ছয় হাজার কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৪ হাজার কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে এটি বাড়িয়ে ৬ হাজার কোটি টাকা করা হয়।
×