ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালে প্রশাসনের ফেসবুকে ঈদ উদ্যাপন

প্রকাশিত: ১৯:৫৬, ৩০ মে ২০২০

বরিশালে প্রশাসনের ফেসবুকে ঈদ উদ্যাপন

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারী নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে দিনরাত কাজ করছেন জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে করোনাভাইরাস বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেও তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বরিশালে টানা দুমাসের অধিক সময় ধরে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসারবৃন্দ ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কোন ধরনের ছুটিছাটা ভোগ করেননি। কেউ স্বজনদের দূরে রেখে নিজ নিজ কর্মস্থলে সরকারের নির্দেশ শতভাগ পালন করতে কাজ করে যাচ্ছেন। আবার কারো পরিবার কাছে থাকলেও কর্মব্যস্ততার কারণে পারছেন না তাদের আগের মতো সময় দিতে। আর এসবের মধ্যেই এবারের ঈদ-উল ফিতর পার করে দিয়েছেন সরকারের এসব কর্মকর্তা। যাদের অনেকেরই ঈদে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র ভরসা ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও মোবাইল ফোন। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ নাজমুল হুদা ফেসবুকের মাধ্যমে সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে হয়েছে। গত ২৫ মে রাতে ভবিষ্যত সুন্দর পৃথিবীর কামনায় ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে দেয়া তার আবেগঘন স্ট্যটাসটি তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য। ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না’ ভূপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গান। আহা! কি আবেদন সে গানের। যে গানে আর্তি ফুটে উঠেছে মানবতার। যুগ যুগ ধরে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সকল হিসাব-নিকাশ, জাত-ভেদ, বিভেদ ভুলে। আমিও মানুষ। আমারও মন কেঁদে ওঠে, বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে অসহায়ের আর্তনাদে। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অদম্য স্পৃহা আর মানব সেবার মহান ব্রত নিয়ে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে যুক্ত হই পাবলিক সার্ভিসে। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথমদিন থেকেই চেষ্টা করেছি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব শতভাগ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে। করোনায় যখন সারাবিশ্ববাসী অস্থির, আতঙ্কগ্রস্ত। যখন ঘরে থাকাই নিরাপদ থাকার প্রধান নিয়ামক তখনও নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে নিয়মিত মাঠে থেকেছি, দায়িত্ব পালন করেছি দিনের পর দিন। আমি চেয়েছি যে জনগণের টাকায় আমার বেতন হয়, সে জনগণ যেন ভাল থাকে, নিরাপদে থাকে। মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। নিয়ম ভাঙ্গা মানুষকে যথাসাধ্য বুঝিয়ে শোধরাবার চেষ্টা করেছি। উদ্দেশ্য একটাই ভাল থাকুক বরিশালবাসী, ভাল থাকুক বাংলাদেশ। আমার নব পরিণীতা স্ত্রী, আমার বাবা, নাড়িছেঁড়া ধনকে ভেবে ভেবে অশ্রু বিসর্জন দেয়া আমার বৃদ্ধা মা, আমার ভালতে যাদের আনন্দ। যারা আমাকে নিরাপদে দেখতে চায়, কাছে পেতে চায়। তাদের সকল আবেগ উপেক্ষা করে শতমাইল দূরে নিরলস কাজ করে যাচ্ছি শুধু দায়িত্ববোধ আর কর্তব্যনিষ্ঠা থেকে। দেশপ্রেমের মহানব্রত নিয়ে যে পথচলা শুরু করেছি। মানবতার কল্যাণে সে সংগ্রাম চলবে আমৃত্যু। বিশ্বাস রাখি, করোনার এ দুর্যোগ কাটিয়ে পৃথিবী আবারও ফিরে পাবে তার চিরচেনা রূপ। আবারও আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে হাসবো, প্রাণোচ্ছল পৃথিবীতে আবারও গায়ে মাখাব সুস্থ পৃথিবীর মিষ্টি রোদ। আবারও শান্ত-শীতল হাওয়ায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নেব আপনি, আমি, আমরা মিলে। সে কাক্সিক্ষত সময়টা পর্যন্ত প্লিজ ঘরে থাকুন। আর আপনাদের নিরাপদ পথচলা, আপনাদের অধিকার নিশ্চিতকল্পে আমরা মাঠেই আছি। করোনা যুদ্ধে ঝুঁকি নিয়ে নারী কর্মকর্তার লড়াই ॥ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ শতভাগ সফল করার জন্য বৈশ্বিক মহামারী ‘করোনা’ মোকাবেলার সম্মুখ সমরের এক যোদ্ধা হিসেবে অবুঝ দুটি শিশু সন্তানকে মায়ের স্নেহ, মায়া-মমতা থেকে দূরে রেখে সূচনা লগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত নিরলসভাবে মাঠে লড়াই করে আসছেন বরিশাল জেলার প্রবেশদ্বার গৌরনদী উপজেলার নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান। তিনি ভিন্নরকম কৌশল অবলম্বন করে সরকারী নির্দেশনা সফল বাস্তবায়ন ও মানুষকে সেবা দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। তার (ইসরাত জাহান) মানবিক কর্মকান্ডে ইতোমধ্যে গোটা বরিশালজুড়ে তিনি ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন। সূত্রমতে, করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা, বাজার নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, বিনোদন দিয়ে ঘরে রাখতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা ও লকডাউনের ফলে কর্মহীন মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে প্রাণান্তর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন চৌকস উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান। জানা গেছে, ইসরাত জাহান ২৯তম বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহীতে সহকারী কমিশনার পদে প্রথম যোগদান করেন। পরবর্তীতে পটুয়াখালীর কাউখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। কাউখালী থেকে গত বছরের ৬ আগস্ট তিনি গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। গৌরনদীতে যোগদানের পর থেকেই তার মেধা ও দক্ষতার মাধ্যমে অল্পদিনেই তিনি জনসাধারণ ও রাজনৈতিক মহল থেকে সর্বস্তরে চৌকস অফিসার হিসেবে আস্থা অর্জন করেছেন। স্থানীয় জনসাধারণ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী ও কর্মহীন মানুষের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক শুরু হওয়ার পর দলে দলে প্রবাসীরা দেশে ফিরতে শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় গৌরনদীর উপজেলায় প্রায় আটশ’ প্রবাসী আসেন। তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখতে নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান তার কোলের কোমলমতি দেড় বছরের শিশু তাসফিন ইবনে ও ছয় বছরের কন্যা রুবামা বিনতে হানিফকে বাসায় রেখে প্রশাসনের যৌথ একটি টিম নিয়ে দিন-রাত বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করেন। এ ব্যাপারে (কোয়ারেন্টাইন) গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে প্রচারপত্র বিলি ও মাইকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালান। স্থানীয়রা জানান, উপজেলার কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি করেছিলেন। বিষয়টি জানতে পেরে নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান নিজে উপস্থিত থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে অর্ধশত ব্যবসায়ীকে কয়েক লাখ টাকা জরিমানা করে বাজার স্থিতিশীল রাখেন। উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু বলেন, নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান মায়ের মমতা ও ভালবাসা দিয়ে সচেতন করে সাধারণ মানুষকে সরকারী নির্দেশনা মানতে রাজি করিয়েছেন। বিশেষ করে তিনি পরিবার ভিত্তিক কমিউনিটিকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখতে উৎসাহ দিতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিনোদন সামগ্রী হিসেবে লুডু, দাবা বিতরণ করেছে। নারী কর্মীদের দিয়ে মাস্ক তৈরি করে হতদরিদ্র মানুষকে দুই হাজার মাস্ক ও স্যানিটাইজার প্রদান করেছেন। সৈকত গুহ পিকলু আরও বলেন, লকডাউন শুরু হলে শ্রমিক, দিনমজুর, রিক্সা চালকসহ খেটে খাওয়া মানুষের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কর্মহীন মানুষের মধ্যে খাদ্যের অভাব দেখা দেয়। এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য মন্ত্রী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ’র নির্দেশে এবং জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমানের পরামর্শে নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দিন-রাত কয়েক হাজার কর্মহীন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নিজ হাতে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী তুলে দিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান বলেন, করোনা প্রতিরোধে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ও জেলা প্রশাসকের পরামর্শ শতভাগ সফল করার জন্য দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। তবে এসব কাজ করতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুকরণ করে আমাকে কিছুটা কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। সবক্ষেত্রে শাসন নয়; প্রধানমন্ত্রীর মতো ভালবাসা ও মমতা দিয়ে আমাকে কাজগুলো করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সকল প্রশাসনিক কর্মকর্তার সহযোগিতা নিয়ে করোনা যুদ্ধে আগামী কঠিন দিনগুলো মোকাবেলা করতে হবে। এজন্য আমি সকলের সহযোগিতা চাই।
×