ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনৈতিক উত্তরণে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আগামী বছরের বাজেট তৈরি হচ্ছে;###; চলমান লকডাউনের কারণে বাজেট ঘোষণা দু’মাস পিছিয়ে যেতে পারে ;###; স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে সেবার মান বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে;###;কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়বে

প্রণোদনা সব খাতে ॥ করোনার বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ২০ এপ্রিল ২০২০

প্রণোদনা সব খাতে ॥ করোনার বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার উদ্যোগ

এম শাহজাহান ॥ করোনার প্রভাব মোকাবেলায় ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ’ এর নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। তবে করোনা পরিস্থিতিতে চলমান লকডাউনের কারণে বাজেট ঘোষণা দুমাস পেছানো হতে পারে। অর্থনীতি চাঙ্গা করতে দেশের সব খাত প্রণোদনার আওতায় আসছে। এ লক্ষ্যে টাকার সরবরাহ বাড়াতে নতুন নোট ছাপানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। করোনার প্রভাবে সামষ্টিক অর্থনীতি এখন চাপের মুখে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। রফতানিমুখী তৈরি পোশাকখাত রক্ষায় ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। এর বাইরে কৃষি খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকাসহ আরও ৩০ হাজার কোটি টাকার কয়েকটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এসব প্যাকেজ বাস্তবায়নে বাজেটে বিশেষ জোর দেয়া হবে। জানা গেছে, করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি কিভাবে চাঙ্গা করা যাবে সে লক্ষ্যে বাজেট পরিকল্পনা, প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কৌশলে পরিবর্তন আনতে কাজ করছে অর্থমন্ত্রণালয়। চলমান প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বিনিয়োগ আরও উৎপাদনমুখী করতে সর্বোচ্চ জোর দেয়া হবে। করোনা থেকে রক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে বাজেটে। স্বাস্থ্যখাতের বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে সেবার মান বাড়াতে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এছাড়া কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাড়বে ভর্তুকির পরিমাণ। ইতোমধ্যে কৃষিখাত রক্ষায় আরও ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে। এতে আগামী বছরের মধ্যে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে বলে মনে করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরকার ঘোষিত এসব প্রণোদনায়ও অর্থনীতি কতটুকু ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। কারণ করোনাভাইরাসের প্রভাবে ইতোমধ্যে অর্থনীতির সবখাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ রেমিটেন্স এবং তৈরি পোশাক রফতানি খাত নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মুখে রয়েছে। এছাড়া করোনার কারণে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিন আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি করোনায় মৃত্যুও বেড়ে চলছে। মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। জীবন বাঁচাতে এখন নগরবাসী হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় আগামী দিনের অর্থনীতির ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, আগে মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা চাপ তৈরি হয়েছে এটা ঠিক, তবে এই অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভাল হবে। ইতোমধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি এ বিষয়ে তাদের পূর্বাভাস প্রকাশ করেছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, করোনার মহামারী এখন সারাবিশ্বে চলছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তবে দাতাসংস্থাগুলো এ সঙ্কট উত্তরণে অর্থায়ন করার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ আনার প্রচেষ্টা চলছে। আশা করছি, পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। জানা গেছে, চলমান পরিস্থিতিতে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা পেছানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দুমাস পিছিয়ে গেলে আগামী আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে এ বিষয়ে এখন কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। এখন পর্যন্ত বাজেটের আকার ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো হচ্ছে। কিন্তু করোনার প্রভাবে রাজস্ব আয় কমার পাশাপাশি অর্থনীতির সব খাতে এখন নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছে। এ অবস্থায় বাজেটের আকার কমানোও হতে পারে। তবে করোনার প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করাই হচ্ছে আগামী বাজেটের মূল্য চ্যালেঞ্জ। এ কারণে নতুন কোন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে না। বরং চলমান প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন ও বিনিয়োগ সর্বোচ্চ উৎপাদনমুখী করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এদিকে, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে অর্থনীতির দুটি প্রধান খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে করোনায়। এ ক্ষতি হবে রফতানি ও উৎপাদন হ্রাসে আর সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ লেনদেন ও চাহিদা কমে যাওয়ায়। এছাড়া এডিবি তাদের প্রাথমিক পর্যালোচনায় বলেছে, চূড়ান্ত পর্যায়ে এ ক্ষতি ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। করোনার আপদ বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে এমন একসময় এসে হাজির হয়েছে, যখন ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের হিসাবের আলোচনার মধ্যেও অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে মন্দা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। অর্থ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় বাজেটের দুটি প্রধান দিক হলো আয় ও ব্যয়। আয় না করে ব্যয় হলে ধারদেনায় জড়াতে হয় সরকারকে। এজন্য সরকারের আয় বা রাজস্ব আহরণ বাজেট বা অর্থনীতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু করোনাসহ নানা কারণে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য সরকারের রাজস্ব আয়ের যে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল, তা প্রায় অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে বাজেট বাস্তবায়ন অনেকাংশে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডি সম্প্রতি করোনাভাইরাসকে মানব ইতিহাসের ভয়াবহ সঙ্কট হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, উৎপাদন, আমদানি-রফতানি, স্বাস্থ্য খাত, পর্যটন, প্রবাসী আয়, রাজস্ব, অনানুষ্ঠানিক খাত, খাদ্য নিরাপত্তা এবং সব শেষে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সম্প্রসারণমুখী মুদ্রানীতি, অগ্রাধিকার পুনর্বিবেচনা সাপেক্ষে রাজস্ব ও সরকারী ব্যয় ও খাতভিত্তিক বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কোভিড-১৯ এর ফলে যেসব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে এমনিতেই, চলতি অর্থবছরে মোট রাজস্ব ঘাটতি প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা হবে বলে অনুমিত হয়, আর এর সঙ্গে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কারণে অতিরিক্ত অর্থের যোগ করলে এই ঘাটতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে, করোনা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি, সরকারী ব্যয় বৃদ্ধি করা ও মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি-এ চারটি কার্যক্রম নিয়ে অর্থনৈতিক প্রভাব ও উত্তরণের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। কর্মপরিকল্পনার আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের আওতায় এ টাকা দেয়া হবে। এতে দেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব মোকাবেলায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক গতিশীলতা অব্যাহত থাকবে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন অর্থ বিশ্লেষকরা। জানা গেছে, করোনার কারণে বাজেট প্রণয়নের বিষয়টি ধীরগতিতে এগোচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনা স্থগিত করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনা শুরুর কথা ছিল গত ৩০ মার্চ থেকে। প্রথম আলোচনাটি নির্ধারণ করা হয়েছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং জাতীয় সংসদে ৪টি স্থায়ী কমিটির (অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এবং সরকারী প্রতিষ্ঠান কমিটি) সভাপতিদের সঙ্গে। এরপর গত ২ এপ্রিল দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও পেশাজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করার সব প্রস্তুতি নির্ধারিত ছিল। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের দৈনিক কর্মসূচীতেও তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করোনায় ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে কর্মসূচীগুলো বাতিল করতে হয়েছে। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনআির ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সব ধরনের বৈঠক স্থগিত রেখেছে। এসব কারণে বাজেট পেছানো হতে পারে।
×