ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

ইলিশ উৎপাদন তিনগুণ বেড়েছে

প্রকাশিত: ১২:৪১, ১২ জানুয়ারি ২০২০

ইলিশ উৎপাদন তিনগুণ বেড়েছে

বছরের একটা দীর্ঘ সময়ে জাটকাসহ ইলিশ আহরণে থাকছে নিষেধাজ্ঞা। তার পরেও সাগরপাড়ের জেলা পটুয়াখালীতে ইলিশের উৎপাদন ব্যাপক হারে বেড়েছে। গত ১০ বছরে উৎপাদনের এ হার তিনগুণেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিশ উৎপাদন বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে সরকারের কঠোর নজরদারি, তদারকি ও নানামুখী বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তার সফল বাস্তবায়ন। বেসরকারী যথাযথ উদ্যোগও এক্ষেত্রে সফল ভূমিকা রেখেছে। ইলিশ উৎপাদন বাড়ার কারণে জেলার মৎস্যজীবীদের মুখে যেমন হাসি ফুটেছে। তেমনি জেলার অর্থনীতিতেও ইলিশের অবদান ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ বরাবরই ইলিশ উৎপাদনে শীর্ষে অবস্থান করছে। বিশ্বের মোট ১১টি দেশে বাণিজ্যিকভাবে ইলিশ মাছ ধরা হয়ে থাকে। যার সব ক’টি দেশই এশিয়ায়। দেশগুলো হলো ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাহরাইন এবং কুয়েত। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ওয়ার্লড ফিশ’-এর পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বাদে বাকি সব ক’টি দেশেই ইলিশের উৎপাদন কমছে। কেবল বাংলাদেশেই ফি বছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে। বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের ৬৫ শতাংশ বাংলাদেশের। তার পরেই ভারত ১৫ শতাংশ। মিয়ানমার ১০ শতাংশ এবং বাকিটা ইলিশ উৎপাদক অন্যান্য দেশ। বাংলাদেশের ধারে কাছে কেউ নেই। পৃথিবীজুড়ে বাঙালী রসনার বিপুল চাহিদা মেটানোর পরেও বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন কেন এবং কীভাবে বাড়ছে তা নিয়ে কৌতূহলী হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক নয়। আসলে বাংলাদেশ বিভিন্ন নদীতে ইলিশের ডিম পাড়ার জায়গা এবং বিচরণক্ষেত্র চিহ্নিত করে উপযুক্ত সময়ে তার সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে পেরেছে। এসব জায়গায় বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ইলিশ ধরা নিষেধ। এ ছাড়া বছরে আট মাস ছোট ইলিশ বা জাটকা ধরা নিষেধ। এ কেবল সরকারী কাগুজে ঘোষণা নয়, বাংলাদেশে ছোট ইলিশ ধরা আইন করে নিষেধ করা হয়েছে। এ আট মাস জাটকা ধরার ওপর নজরদারি চালাতে সরকার কোস্টগার্ডকে নিয়োজিত করেছে। নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরলে বিপুল জরিমানা, এমন কী কারাবাসও হতে হয় মৎস্যজীবীদের। এই কয়েক মাসের জন্য মৎস্যজীবীদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে সরকার দেশের ২ লাখ ২৪ হাজার মৎস্যজীবীকে পরিচয়পত্র তৈরি করে দিয়েছে। কর্মহীন মৎস্যজীবীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় ত্রাণ দেয়া হয়। এমন বেশ কিছু উদ্যোগের কারণেই দেশে ইলিশের উৎপাদন ঈর্ষণীয় অবস্থানে পৌঁছেছে। এ সংক্রান্ত সরকারী পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত ৯ বছরে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ। গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল দুই লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিক টন। যা পরবর্তী ৯ বছরে বেড়ে ৫ লাখ ১৯ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সারাদেশের পাশাপাশি ইলিশের উৎপাদন বরিশাল বিভাগে বেড়েছে ব্যাপক হারে। সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী বরিশাল বিভাগে গত ৯ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১১০ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এ বিভাগে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫১০ মেট্রিক টন আহরণ বা ধরা হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৬১ হাজার ৩৮২ মেট্রিক টনে। ২০১০-১১ অর্থবছরে ১ লাখ ৭০ হাজার ৭৬২ মেট্রিক টন এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯৭৭ মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আহরণ কিছুটা কমলেও তার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ৯৭৬ মেট্রিক টন। কিন্তু ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা আবার বেড়ে হয় ২ লাখ ২১ হাজার ৫৯৮ মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২ লাখ ৫৩ হাজার ১৮১ মেট্রিক টন এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা অনেক বেড়ে আহরণ হয় ৩ লাখ ২৪ হাজার ২৯৭ মেট্রিক টন। একই ভাবে পটুয়াখালী জেলাতেও ইলিশ আহরণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানান হয়েছে, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এ জেলায় ইলিশ আহরণ করা হয় ১৪ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে যা কিছুটা বেড়ে ১৪ হাজার ৩০০ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়। ২০১০-২০১১ অর্থবছরে ইলিশ আহরিত হয় ১৪ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। ২০১১-২০১২ অর্থবছরে আহরণ হয় ১৪ হাজার ৯৭০ মেট্রিক টন। পরবর্তী ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে উক্ত জেলায় ইলিশের উৎপাদন দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ১৫ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে হয় ৩৭ হাজার ২৭৭ মেট্রিক টন। ২০১৫-২০১৬ অর্র্থবছরে হয় ৩৭ হাজার ৮৫৩ মেট্রিক টন। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয় ৩৬ হাজার ২১৬ মেট্রিক টন। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে ৪৩ হাজার ২৮৯ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ হাজার ৫৪০ মেট্রিক টনে। অর্থাৎ গত ১০ বছরে পটুয়াখালী জেলায় ইলিশের উৎপাদন তিনগুণ বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে অন্তত ৩২৮ দিন ইলিশ ও জাটকা ধরা সরকারী নির্দেশনায় বন্ধ ছিল। এর মধ্যে জাটকা ধরায় নিষেধাজ্ঞা ছিল আট মাস। এ সময়ে বঙ্গোপসাগরসহ সাগর মোহনার নদ-নদীগুলোতে জাটকা ধরায় বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ইলিশের প্রজননকালীন সময়েও ২২ দিন ইলিশ আহরণ বন্ধ ছিল। দীর্ঘ সময়ে ইলিশ ধরা বন্ধের পরে এর উৎপাদন বৃদ্ধি সংশ্লিষ্ট মহলগুলোকে আশাবাদী করে তুলেছে। এ বিষয়ে পটুয়াখালী সরকারী কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক পীযূষ কান্তি হরি বলেন, সরকারের নজরদারির কারণে ইলিশের উৎপাদন যেমন বাড়ছে। তেমনি আকারেও বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের মৌসুম কিছু পরিবর্তন হয়েছে। নদীতে ইলিশ আসতে একটু দেরি হয়েছে। পটুয়াখালী অঞ্চলের মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতার নিরিখে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিশ, একোয়াকালচার এ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের প্রভাষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, বেহুন্দির মতো ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে মাছ ধরা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা গেলে পটুয়াখালী অঞ্চল ইলিশে নিঃসন্দেহে আরও সমৃদ্ধ হবে। পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্যাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, নবেম্বর থেকে জুন এ আট মাস জাটকা ধরা, সংরক্ষণ বন্ধ করা। অক্টোবরের ভরা পূর্ণিমায় ২২ দিন ইলিশের নির্বিঘœ প্রজনন নিশ্চিত করা। অভয়াশ্রম জেলার তেঁতুলিয়া নদীতে ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসসহ তিন দফায় বছরের ৩২৮ দিন নদ-নদীর পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে ইলিশ মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার যথাযথ বাস্তবায়নে পটুয়াখালী জেলায় ইলিশের উৎপাদন ক্রমে বাড়ছে।
×