ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আয় বৈষম্য কমিয়ে আনা প্রয়োজন

প্রকাশিত: ১২:৪১, ১২ জানুয়ারি ২০২০

আয় বৈষম্য কমিয়ে আনা প্রয়োজন

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান তুমি মোরে দিয়েছ খ্রিস্টের সম্মান। এ কবিতাটির মধ্য দিয়ে দারিদ্র্য কিভাবে মানুষকে বড় করে তোলার স্বপ্ন দেখায় তার একটি প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিশ্বে যারা বর্তমানে ধনীদের তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে রয়েছেন তারা সবাই প্রথম জীবনে গরিব ছিলেন। তাদের মেধা ও প্রজ্ঞার বদৌলতে আজ এ পর্যায়ে আসতে দীর্ঘ সময় পাড়ি দিতে হয়েছে। কিন্তু আজকালকার দিনে ধনী হতে আর দীর্ঘ সময় পাড়ি দিতে হয় না। সম্প্রতি দেশের একটি শীর্ষ দৈনিক পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে বিশ্বে অতি ধনীদের উত্থানে শীর্ষে বাংলাদেশ যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সংগঠন ওয়েল এক্স এ তথ্য দিয়েছে একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে। যার নাম ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৮ যা ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল। এ প্রতিবেদন অতি ধনী বলতে বোঝানো হয়েছে যাদের সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি মার্কিন ডলার কিংবা সমমানের যা বাংলাদেশী টাকায় ২৫০ কোটি টাকার বেশি। এ হিসাবে অতি ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বিশ্বের অর্থনীতির দেশেগুলোকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ এবং ২০১৩ সাল থেকে গত পাঁচ বছরে দেশে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে যা বিশ্বের বড় ৭৫টি অর্থনীতির দেশের চেয়ে বেশি। তবে বাংলাদেশে এ সংখ্যাটি কত তা জানা যায়নি। দেশে এ বিষয়টির রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে তেমন কোন প্রকার আলোচনা শোনা যাচ্ছে না। যা কোন নতুন ঘটনা নয়। কারণ বাংলাদেশে একাধারে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, অতি ধনীদের সংখ্যা বাড়ছে, ধনী-দারিদ্র্যের বৈষম্যের হার বাড়ছে, মানব উন্নয়ন সূচকে দৃপ্ত অর্জন সাধিত হয়েছে, একটি নব্য মধ্যবিত্ত ধনিক শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে ক্রমাগতভাবে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, প্রবৃদ্ধি যদি সংগঠিত হয় (যা বর্তমানে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ) তা হলেও মানুষেরও আয় বাড়বে (যা বর্তমানে ১৯০৯ মার্কিন ডলার), দারিদ্র্য কমবে (যা বর্তমানে ২১ শতাংশ) এবং মানুষ ধীরে ধীরে ধনী হতে থাকবে। এখন প্রশ্ন আসে ধনীর সংজ্ঞা কি এবং তা কিভাবে নির্ণয় হয়। দারিদ্র্যের সংজ্ঞা ও তা নির্ণয়ের পদ্ধতি নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে কিন্তু ধনীর সংজ্ঞা ও তার পরিমাণের জন্য তেমন কোন গবেষণা হয়নি। কিন্তু ওয়েল এক্স প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদনে ধনীর যে সংজ্ঞা দিয়েছে তার ভিত্তি কি? সেই সংজ্ঞা ধরেই বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে তা নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতূহলের শেষ নেই। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে এ বিস্ফোরণ, যেখানে দেশটি মাত্র স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দিকে চলতে শুরু করছে। এই বিষয়টি দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদরা ইতিবাচকভাবে দেখছেন না। এ ব্যাপারে সানেমের নির্বাহী পরিচালক বলেছেন অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন আসে। কিন্তু একটি শ্রেণীর হাতে বড় অংশের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে যা বৈষম্য বাড়াচ্ছে। দেশে স্বজনতোষী পুঁজিবাদের কারণে অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুত কেন্দ্র, ব্যাংকের মতো ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পাচ্ছে সরকারের লোকেরা যার কারণে সম্পদ একশ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে যা স্বল্প সময়ে অতি ধনী হওয়ার কারণ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের প্রধান নির্বাহী বলেছেন বেশ কয়েক বছর ধরে একটি গোষ্ঠীর হাতে সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে তা দৃশ্যত বোঝা যায় যা অল্প সময়ে তৈরি হয়নি, যাদের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয় তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের একটা বড় ভূমিকা থাকে। এ বক্তব্যকে যদি আমরা বাস্তব হিসেবে ধরি তাহলে দেখা যাবে যে, বর্তমানে বাংলাদেশে বেশ কিছু অবকাঠামোগত বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। যেমন পদ্মা সেতু, পাতাল রেল প্রকল্প, চার লেনের রাস্তা উন্নয়ন প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প ইত্যাদি। সে সব প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে অথচ কাজের অগ্রগতি সময় মোতাবেক অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প ২০১৮ সালে সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও তার কাজ এখনও শেষ হয়নি বিধায় খরচ প্রাক্কলিত পর্যায়ের চেয়ে অনেক বেড়ে চলেছে, যা সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত। এ নিয়ে দেশের ভেতরে তেমন কোন গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে তা বলা যাবে না। তা না হয়ে আয় বৈষম্য এতই বেড়ে গেছে যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপের তথ্যে এ সহগের মান ২০১৬ সালে ছিল ০ দশমিক ৪৮৩। এখন সহগ ০ দশমিক ৫০ পেরিয়ে গেলে বিশ্বের উচ্চ আয় বৈষম্য দেশের তালিকায় বাংলাদেশ চিহ্নিত হবে যা দেশের জন্য কোনভাবেই সম্মানজনক নয়। বাজার অর্থনীতির যুগে আমরা যে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছি এবং বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গৃহীত হচ্ছে তারই ফসল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়। যার ফলে প্রবৃদ্ধি ফসল সবার ঘরে সমভাবে পৌঁছাচ্ছে না যার পরিণাম বৈষম্য। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত অনেক দেশেই অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির স্বল্পতার কারণে এক ধরনের পরিপোষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হয় যারা রাজনীতির বলয়ে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়। বাংলাদেশসহ চীন, ভিয়েতনাম, কেনিয়া, হংকং ও ভারতে এ রূপান্তরটি হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। আমরা যদি বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র দাবি করি তা হলে এটি কতটুকু সঠিক হবে। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের সাধারণত তিন ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন উপার্জন সহায়তা, সামাজিক সেবা ও আইনী নিরাপত্তা। প্রথমটি ক্রমাগতভাবে বিকশিত হলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি এখনও অনুন্নত ও সঙ্কীর্ণ। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী কাল মার্কস শ্রেণীভিত্তিক সমাজের যেসব ত্রুটিবিচ্যুতি নির্ণয় করে শোষণহীন অর্থনীতির যে রূপরেখা দিয়েছিলেন সেই অবয়বে বাংলাদেশ এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে? তার মতে মূল কাঠামোর অর্থনীতির প্রভাব পড়বে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় চেতনা, রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নের ওপরে। আমরা কি উন্নয়নশীল কিংবা মধ্য আয়ের দেশের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ক্রান্তিকাল পাড়ি দিচ্ছি না? অবশ্যই দিচ্ছি যার জন্য বৈষম্য এবং আমাদের বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কাঠামোতে অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা কিভাবে সফল করা যায় যার বিপক্ষ-পক্ষ অবশ্য আছে। বাংলাদেশের সংবিধানে শোষণহীন সমাজের কথা বলা আছে এবং এ লক্ষ্যে রেখেই সরকার কাজ করছে কিন্তু নব্য অতি ধনিক শ্রেণী যারা রাজনৈতিক বলয় দ্বারা আশীর্বাদপুষ্ট তারা কি তা করতে দেবে? এই প্রশ্ন দেশের সমাজবিজ্ঞানী, সুশীল সমাজ ও রাজনীতিবিদদের কাছে রইল।
×