ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষতস্থান জুড়ে দেবে ‘মেট্রো’

প্রকাশিত: ১২:২১, ৪ জানুয়ারি ২০২০

ক্ষতস্থান জুড়ে দেবে ‘মেট্রো’

১ আইটি ডটকম ডেস্ক প্রতিনিয়ত মানুষ নতুন কিছু তৈরির চেষ্টা করে চলেছে। কী করে জীবনকে আরও একটু সহজ করে তোলা যায় তা নিয়ে কাজ করছে পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার উর্বর মস্তিষ্ক। আর এর ফল হিসেবে নিত্যনতুন আবিষ্কারের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছি আমরা। তেমনই এক নতুন আবিষ্কারের নাম ‘মেট্রো’। চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন সব দিক উন্মোচনের মাধ্যমে একে একে একসময়ের মহামারী এবং অবশ্যম্ভাবী অসুখের প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে মানুষ। এতে করে পৃথিবীজুড়ে রোগের কারণে হওয়া মানুষের মৃত্যুহার কিছু কমানো সম্ভব হয়েছে। ‘মেট্রো’ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে মানুষের অবদান রাখা এমনই এক আবিষ্কার।আমাদের শরীরের কোথাও কেটে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হলে সেখানে সেলাই করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। প্রাচীনকালে এবং আমাদের নিকট অতীতেও শরীরের এই কাটা স্থান সেলাই করতে বিশেষ ধরনের পিঁপড়ার দাঁত ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীতে সুই দিয়ে সেলাই করার প্রচলন শুরু হয়। তবে শরীরের ভেতরে এমন অনেক স্থান রয়েছে যেখানে সেলাই করাটা সম্ভব নয় এবং করলেও সেটার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। অনেক সময় অস্ত্রোপচারের পর সেলাই করলেও সেই সেলাইয়ের ক্ষতস্থান শুকাতে চলে যায় অনেক বেশি সময়। যাতে করে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কোন ক্ষতস্থান সেলাই করতে গেলে বেশ খানিকটা সময়েরও দরকার পড়ে। এর মধ্যে রোগীর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যায়, কিংবা নানারকম শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়। এই সমস্যার সমাধান হিসেবেই এবার আবিষ্কৃত হয়েছে ‘মেট্রো’। এটি এমন এক ধরনের আঠা যেটি খুব সহজেই কাটা স্থানকে জোড়া দিতে সক্ষম। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সিডনি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা একত্রে গবেষণা করে তৈরি করেছেন এই আঠা। মানব শরীরে মাত্র ৬০ সেকেন্ডের মধ্যেই কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব এই সার্জিকাল গ্লু ‘মেট্রো’। ফুসফুস, হৃদপিণ্ড এবং ধমনীর মতো একবার সংকুচিত হয়ে আবার প্রসারিত হওয়া মানব অঙ্গগুলোকে জোড়া লাগানোর ক্ষেত্রে মেট্রো বেশ কার্যকর। আর তার কারণ, এর উচ্চ প্রসারণ ক্ষমতা। মেট্রো প্রয়োজন অনুসারে সংকুচিত এবং প্রসারিত হতে পারে। যেটা কিনা আমাদের মানব অঙ্গের বেশকিছু অংশ, এই যেমন ফুসফুসের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। এছাড়াও, আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ যে স্থানগুলোতে তরল পদার্থের কারণে পৌঁছানো এবং সেলাই করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না, সেখানে মেট্রো খুব ভাল কাজ করতে পারে। কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই এটি আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ ক্ষতস্থানে গিয়ে দ্রুত কার্যকরী আঠার ভূমিকা পালন করে। ইউভি লাইট বা আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির সাহায্যে একবার মেট্রো ব্যবহার করার পর এটি খুব দ্রুত আমাদের শরীরের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাই কোনরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা মেট্রোর ক্ষেত্রে থাকে না বললেই চলে। এতে ব্যবহৃত এনজাইমের মাধ্যমে খুব সহজেই মেট্রোর মেয়াদ নির্ধারণ করা সম্ভব। আর সেই অনুসারে, কোন্ জোড়া সপ্তাহব্যাপী থাকবে নাকি পুরো একটা মাস সেটাও ঠিক করে দেয়া যায়। চিকিৎসক যদি ভেবে থাকেন যে আপনার ক্ষতস্থান শুকিয়ে যেতে সপ্তাহখানেক সময় লাগবে, মেট্রো ঠিক ততদিন পর্যন্তই কাজ করবে। এরপর যদি ক্ষতস্থান না শুকিয়ে থাকে, কিংবা আরও কিছুদিন মেট্রোর মেয়াদ বাড়ানোর দরকার পড়ে, তাহলে সেই অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ারও সুযোগ থাকবে। এখন অবধি ইঁদুর এবং শূকরের ওপর মেট্রোর মাধ্যমে পরীক্ষা চালানো হয়েছে। আর তাতে ফলটাও এসেছে চমৎকার! দেখতে না দেখতেই কোন বাড়তি সমস্যা ছাড়াই কাটা স্থানকে সেলাই করে দিয়েছে এই আঠা। বিশেষ করে রক্ত পরিবাহী ধমনীগুলোকে সারিয়ে তুলতে বেশ ভাল কাজ করেছে মেট্রো। সবচাইতে ভাল ব্যাপারটি হলো এই যে, মেট্রো এই সবটা কাজই করে মানব অঙ্গগুলোর প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক কোন কার্যক্রমকে বাধা না দিয়েই। ভাবছেন, এত উপকারী জিনিসটি তৈরির মূল উপাদান কোনটি? তেমন কিছুই নয়। মেট্রো তৈরি হয় ‘ট্রোফেলস্টিন’ নামক একটি প্রাকৃতিক প্রোটিনের মাধ্যমে। সিরিঞ্জের মাধ্যমে এই আঠা শরীরের প্রবেশ করানো হয়। শরীরের ভেতরে বা বাইরে যেখানে কেটে গিয়েছে ঠিক সেখানে সিরিঞ্জ দিয়ে আঠা ছড়িয়ে দিলে, পরবর্তীতে ইউভি লাইটের মাধ্যমে সেই আঠার কার্যকারিতা চালু করা হয়। সহজেই জোড়া লেগে যায় কেটে যাওয়া স্থান। ইউনিভার্সিটি অব সিডনির অধ্যাপক এ্যান্থনি ওয়েসের মতে, যুদ্ধক্ষেত্রে এবং গাড়ি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মেট্রো বেশ উপকারী হয়ে উঠতে পারে। মেট্রোর সবচাইতে মজার ব্যাপারটি হলো, এটি শরীরের ভেতরে গিয়ে তরলের মতো কাজ করে। তবে তরলের সঙ্গে মিশে যায় না কিংবা কাটা স্থানের কাছ থেকে দূরে সরে যায় না। তবে তাই বলে এখনই মানুষের উপরে আঠাটি ব্যবহার করার পক্ষপাতী নন কেউ। এটি আর দশটা সাধারণ আঠার মতো নয়। আর মানব শরীরও হেলাফেলার ব্যাপার না। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর, ধীরেসুস্থে মেট্রোকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে এমনটাই আশা করছেন সবাই। আরও প্রায় তিন বছর দরকার পড়বে সেজন্য, এমনটাই ভাবছেন গবেষকরা। বাইরের কোন উপাদান ব্যবহার না করে শরীর নিজের মতো করে কীভাবে প্রাকৃতিকভাবে এর ক্ষতকে জোড়া লাগিয়ে ফেলতে পারে সেটা নিয়ে বহু বছর কাজ করেছেন বিজ্ঞানীরা। মেট্রোকে সেই নিরলস পরিশ্রমের খানিকটা সাফল্য হিসেবেও দেখা যায়। তবে মানুষ এক্ষেত্রে ঠিক কতটা সফল হয়েছে সেটা জানা যাবে আরও কিছুদিন পর।
×