ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতির আখড়া ময়মনসিংহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিস

প্রকাশিত: ১২:০৮, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯

দুর্নীতির আখড়া ময়মনসিংহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিস

স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ ॥ নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক অফিস। অফিসের সেবা পেতে পদে পদে গুনতে হচ্ছে টাকা। টাকা ছাড়া কোন কথা চলে না এই অফিসে। অভিযোগ রয়েছে, মাদক নিরাময় কেন্দ্রের টাকায় চলে অফিসের মেইন্টেন্যান্স ও আপ্যয়ন খরচ। হাওয়া ভবন ঘনিষ্ঠ ছাত্রদলের সাবেক নেতা ক্ষমতাধর ও বিতর্কিত উপ পরিচালক জাহিদ হোসেন মোল্লা অফিস চালান রাজধানী ঢাকায় বসে। এমনকি ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়েও দায়িত্বভার কারও কাছে অর্পন করতে ভরসা পাননি! ফলে দেশের বাইরে থেকেও ময়মনসিংহ অফিসের দায়িত্ব পালন করেছেন মাদকের এই কর্মকর্তা। আলোচিত কর্মকর্তার এমন কর্মকা- নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। প্রচার রয়েছে, নানা কেলেঙ্কারির কারণে বিতর্কিত এই কর্মকর্তার চেয়ার হাত ছাড়া হওয়ার ভয়েই কাউকে দায়িত্ব দিতে সাহস পাননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সরকারী কর্মকর্তা জানান, ছুটিতে থাকাকালীন অবশ্যই দায়িত্বভার কাউকে দিতে হবে। আর দেশের বাইরে গেলে তো কথাই নেই। এটি না করলে সরকারী চাকরি বিধি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ময়মনসিংহের উপ-পরিচালক জাহিদ হোসেন মোল্লার দাবি, ছুটিতে থাকাকালীন কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই! এমনকি বিদেশ থাকাকালীন সময়েও। অফিসের ঘুষ দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের অভিযোগও স্বীকার করেননি তিনি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালকের নির্দেশনাতেই তিনি এ সময়ে অফিস পরিচালনা করছেন বলে জানান। তবে এ বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার অতিরিক্ত সচিব খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, সরকারের কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছুটিতে কিংবা দেশের বাইরে গেলে তার অবর্তমানে অফিসের রুটিন কাজ চালানোর জন্য কাউকে সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালনের অনুমতি দেবেন- এটা কমন প্রাকটিস। এটি মেনে চলা সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের চাকরি বিধির রেওয়াজ। কেউ এটি না করলে এই রেওয়াজের লঙ্ঘন হবে বলে মন্তব্য করেন সরকারের এই অতিরিক্ত সচিব। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমদ সোমবার জানান, ছুটিকালীন কিংবা দেশের বাইরে গেলে কর্মকর্তাকে অবশ্যই সহকর্মী কিংবা অধস্তন কাউকে সাময়িকভাবে লিখিত দায়িত্ব দেয়ার বিধান রয়েছে। এটি না করলে সরকারী বিধানের লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে বলে জানান এই মহাপরিচালক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ময়মনসিংহ অফিসের এসব অব্যবস্থাপনার ঘটনা খতিয়ে দেখতে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের তদন্তের দাবি উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ময়মনসিংহ আঞ্চলিক অফিসে লোক দেখানো হাতেগুনা অভিযান ছাড়া তেমন কোন কাজ নেই বললেই চলে। অফিসের কর্মকর্তা আর কর্মচারীরা বেতন গুনেন অলস বসে। ফলে মাদকবিরোধী অভিযানে যেখানে পুলিশ ও র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গলদগর্ম হচ্ছেন সেখানে ময়মনসিংহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আঞ্চলিক অফিসের দৃশ্যমান কোন অভিযানই নেই। নেই মাদকবিরোধী অভিযানে উল্লেখ করার মতো কোন উদ্ধার কিংবা গ্রেফতারের খবর। মামলা দায়ের করার সংখ্যাও হতাশাব্যঞ্জক বলে জানা গেছে। জনসচেতনতামূলক মতবিনিময়সহ সভা সমাবেশের মতো তৎপরতার ক্ষেত্রেও নেই সংস্থাটির ময়মনসিংহ অফিসের নাম পর্যন্ত। আর এই অফিসের আলোচিত কর্মকর্তা হচ্ছেন জাহিদ হোসেন মোল্লা। অভিযোগ উঠেছে, জাহিদ হোসেন মোল্লা যোগদানের পর থেকেই ঝিমিয়ে পড়েছে ময়মনসিংহ আঞ্চলিক অফিসের সব ধরনের কার্যক্রম। এর আগেও তিনি ছিলেন এই অফিসে টানা ২ বছর! ঘুরে ফিরে এই কর্মকর্তার বার বার ময়মনসিংহ অফিসে যোগদান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হল শাখার ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসেন মোল্লা বিএনপি জামায়াত জোট সরকার মেয়াদে যোগ দেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে। এ সময়ে তিনি হয়ে উঠেন হাওয়া ভবনের কর্ণধার তারেক জিয়ার ঘনিষ্ঠ। ফলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একছত্র অধিপতি হিসেবে নিয়োগ ও বদলিসহ বিভিন্ন বাণিজ্যে জড়িয়ে অগাধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেন। প্রচার রয়েছে, জাহিদ হোসেন মোল্লার ক্ষমতার দাপটের কাছে মন্ত্রণালয়ের আমলারা পর্যন্ত চুপসে যেতেন। ক্ষমতার পালা পদলে নিজের ভোল পাল্টে রাতারাতি লেবাস পাল্টে ফেলেন সুবিধাবাদী এই কর্মকর্তা। সূত্রমতে, গত ৩০ আগস্ট রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে জাহিদ হোসেন মোল্লা ভর্তি হন এ্যাপোলো হাসপাতালে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ১ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে ঢাকার বাসায় থেকেই পরিচালনা করেন ময়মনসিংহের অফিস! পরে ১ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত যান তিনি। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে ১৫ অক্টোবর ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে যোগদান করেন। এর পর থেকে ঢাকার বাসায় বসেই ময়মনসিংহের অফিস চালাচ্ছেন এই কর্মকর্তা। এমনকি বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার সময়ও কাউকে দায়িত্ব দেননি বলে জানায় অফিস সহকারী আমজাত আলী। আমজাত আলী আরও জানায়, ময়মনসিংহ থেকে প্রয়োজনীয় ফাইলপত্র ঢাকার বাসায় নিয়ে সই স্বাক্ষর করানো হচ্ছে। প্রচার রয়েছে, অসুস্থ হওয়ার পর ভারতে চিকিৎসার খরচ যোগাতে ময়মনসিংহ বিভাগের লাইসেন্সীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নেয়া হয়েছে। সর্বশেষ জেলা পরিষদ ক্যাম্পাস থেকে কংগ্রেস জুবলি রোডে অফিস স্থানান্তরের সময়েও লাইসেন্সীদের কাছ থেকে জাহিদ হোসেন মোল্লার নামে চাঁদা আদায় করেছেন অফিস সহকারী আমজাত আলী ও পরিদর্শক চন্দন গোপাল। অফিসের প্রত্যেক কর্মকর্তা কর্মচারী প্রতিদিন টাকার জন্য হা করে থাকেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
×