ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমার জন্য অভিনয়ে আসাটা একটা বিপ্লব ॥ ফেরদৌসী মজুমদার

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ১৮ নভেম্বর ২০১৯

আমার জন্য অভিনয়ে আসাটা  একটা বিপ্লব ॥ ফেরদৌসী  মজুমদার

গৌতম পান্ডে ॥ ‘এত দর্শক-শ্রোতা দেখে আমার হৃদকম্পন বেড়ে গিয়েছে এবং আনন্দও হচ্ছে। তারপরও আপনাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি। আমরা যখন নাটকের কোন শো করি তখন কিন্তু এত লোক হয় না। আমার কথা শোনার জন্য এত লোক এসেছেন এজন্য আমি একটু আবেগে আপ্লুত। আমার মনে হয় এটা তো দাঁড়িয়ে কোন বক্তৃতা না। এটা বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা না, এটা মুনীর চৌধুরীর বক্তৃতা না, তার পরেও আপনারা এসেছেন আমার কথা শুনতে। তাহলে আমার কথাটা একটু বুঝে-শুনে বলতে হবে। আমি অনেক সময় উল্টো-পাল্টা বলি যদি সেইরকম হয়, আপনারা সেটা ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন’- রাজধানীর নাটক সরণি মহিলা সমিতির ড. নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে শুক্রবার সন্ধ্যায় ‘এক বক্তার বৈঠক’ অনুষ্ঠানে একথা বলছিলেন বহুমাত্রিক অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। ফেরদৌসী মজুমদার যে একজন অসাধারণ অভিনয়শিল্পী তার প্রমাণ মিলল আবদুল্লাহ আল মামুন থিয়েটার স্কুল আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে মিলনায়তন ভর্তি দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিতে। বয়সের ভার ও শারীরিক নানা কারণে অভিনয় এখন তেমন করেন না। কিন্তু এক সময়ে মঞ্চ কাঁপিয়ে-দাপিয়ে দেশে-বিদেশে আলোড়ন তুলেছিলেন। তার প্রতি মানুষের ভালবাসার নমুনা এই উপস্থিতিই প্রমাণ করে তিনি কত বড় মাপের শিল্পী। তার অভিনয় নয়, শুধু মুখের কথাই অমৃতসম মনে করে পুরো মিলনায়তন ভর্তি দর্শক হাজির হয়েছেন এ সময়ে। শিল্পী শোনালেন তার ছোটবেলার কথা, কিশোরী বেলার দুষ্টামি, কলেজ জীবনের ঘটে যাওয়া নানা কথা। বাবার স্নেহাতুর শাসন, মায়ের আদর, নাটকে আগমন, প্রেমের পরিণতি বিয়ে সব কিছুই একাই বললেন অবলীলায় একের পর এক। অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন ফেরদৌসী মজুমদার। চল্লিশটির অধিক মঞ্চ নাটকে তিনি অভিনয় করেন। ‘এখনই দুঃসময়’, ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘সেনাপতি’ এ রকম নাটকে তিনি এক সময়ে মঞ্চ কাঁপিয়েছেন। ‘কোকিলারা’র মতো নাটকে একক অভিনয় নিয়ে তিনি এক কাঠামোর বাইরে আরেক কাঠামোতে এসেছেন। সংলাপ ছাড়া নাটক ‘একা’ও করেছেন। অসংখ্য নাটক, একজন অভিনেত্রী এবং নিরন্তর সাধনা এই হচ্ছে ফেরদৌসী মজুমদার। শুরুতে স্বাগত ভাষণ দিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন থিয়েটার স্কুলের অধ্যক্ষ ও থিয়েটার পত্রিকার সম্পাদক রামেন্দু মজুমদার। তিনি বললেন, আমরা থিয়েটার পত্রিকা গত ৪৮ বছর ধরে প্রকাশ করছি। এটি আমাদের একটা গৌরবের জায়গা। কেবল নাটকের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে এই প্রথম একটি মাত্র পত্রিকা এতদিন ধরে টিকে আছে। আমার প্রায় তিন শতাধিক নাটক আমরা এই পত্রিকার মাধ্যমে তুলে ধরতে পেরেছি। আমাদের আবদুল্লাহ আল মামুন থিয়েটার স্কুল ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত। আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের দেশের নাট্য দলগুলোর জন্য প্রশিক্ষিত নাট্যকর্মী তৈরি করতে। এটি প্রথমে ছিল এক বছরের কোর্স এখন এটিকে ছয় মাসের কোর্স করা হয়েছে। ‘এক বক্তার বৈঠক’ শিরোনামে এটি তৃতীয় আসর। প্রথম আসরটি আইএফআইসি ব্যাংকের সৌজন্যে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর ছিলেন। দ্বিতীয় আসরে অভিনেতা, নির্দেশক ও নাট্যকার মামুনুর রশীদ ছিলেন। আজকের তৃতীয় আসরে কথা বলবেন অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। আলাপনের শুরুতে আপন আহসান প্রশ্ন রাখেন ফেরদৌসী মজুমদারের কাছে। তাকে প্রশ্ন করা হয় আপনি ছোট বেলাটা শুরু করেছেন মন্দির এবং মসজিদ দুটো দিয়ে। মন্দির ও মসজিদ জীবনাচরণ নিয়ে প্রথম প্রশ্ন। প্রয়াত খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরীর কন্যা। আপনার সিরিয়াল আপনি বলবেন। ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, আমি ছোট বেলায় ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি ‘নারী শিক্ষা মন্দিরে’। ওখান থেকে পাস করে মানে ফাইভ ছেড়ে দিয়ে আমি গেলাম ‘মুসলিম গার্লস স্কুলে’। কিন্তু আসলে কোনটার মধ্যেই মন্দির-মসজিদ তেমনভাবে প্রকট হয়নি। তবে মুসলিম গার্লস স্কুলে ভর্তি হতে আমার বেশি কষ্ট হয়েছিল। আমার বাবা গিয়েছিল ভর্তি করতে। তখন আমার সবচেয়ে বড় বোন নাদেরা বেগম তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন এবং তখন তিনি জেলে ছিলেন। তার বোন বলে আমাকে নিতে চাইছিল না। তারা বলেছিল ওই পরিবার খুবই খারাপ। এটা এসব করে। যার বোন জেলে তাকে নেয়া যাবে না। কিন্তু আমার বাবা অত্যন্ত জেদি একজন লোক ছিলেন। যেটা তিনি ভাবতেন সেটা তিনি করে ছাড়তেন। তিনি ভর্তি করেছিলেন আমাকে। ওখান থেকে আমি ম্যাট্রিক পাস করেছি। কথার এক ফাঁকে তিনি বললেন, একটা কথা আমি সবাইকে বলি আমার প্রতিটি কথায় আমার বাবা আসবে। কারণ আমাদের পরিবারটাই বাবার শাসন, আদর ও শিক্ষায় বড় হয়েছি। আপনি জন্ম থেকে শুনে এসেছেন যে, নর্তকি ও অভিনেত্রী এটা একটা গালি। সেই বিরুদ্ধ সময়েই আপনার বাড়ি থেকে কিভাবে আসলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, আমার জন্য অভিনয়ে আসাটা একটা বিপ্লব। আমার কোন মতেই এখানে আসার কথা না। আমাদের বাড়িতে নাচ, গান, থিয়েটার এগুলো শরিয়তবিরোধী বলা হতো। বাবা বলতেন অভিনয়, গান, নাচ আমার বাড়িত হইতোন ন। আমি কিন্তু অভিনয় শিখিনি কোথাও। কিন্তু আমি বাড়ির সবাইকে নকল করতাম। বাবাকে একদিন নকল করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। পরবর্তীতে বাবাই অনুমতি দিয়েছিলেন। এভাবে একের পর এক জীবনের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার বর্ণনা দেন ফেরদৌসী মজুমদার।
×