ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কেঁচো সার তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরা

প্রকাশিত: ১০:১৩, ১৬ নভেম্বর ২০১৯

কেঁচো সার তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরা

ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে কেঁচো সার তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরা। সাড়ে তিন বছর আগে ইউনিয়নের শোনপচা গ্রামে প্রথমে কেঁচো সার তৈরি করা শুরু করেন নারীরা। ওই সময় থেকে ওই গ্রামের পাঁচ নারী এ সার তৈরি ও বিপণন করছেন। এতে স্বাবলম্বী হচ্ছেন তারা। শোনপচা গ্রামে নারীদের এ সাফল্য দেখে একে একে ওই ইউনিয়নর শোলাকুন্ড, মৃগী, সাইবেরিয়া, বসু নরসিংহদিয়াসহ বিভিন্ন গ্রামের নারীরা একে একে কাজে এগিয়ে আসেন। কেঁচো সার বা ভর্মি কম্পোস্ট হচ্ছে এক ধরনের জৈব সার। রাসায়নিক সারের মতো এ সার জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট করে না। বরং জমির উর্বরা শক্তি বাড়ায়। রাসায়নিক সার দিয়ে উৎপাদিত সবজি বা ফসলে রাসায়নিক সারের উপাদান থেকে যায়। যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিষতুল্য। পক্ষান্তরে জৈব সার দিয়ে উৎপাদিত সবজি বা ফসলে কোন বিষাক্ত উপাদান থাকে না। এক কথায় জৈব সার দিয়ে উৎপন্ন পণ্য বিষমুক্ত। এ সারে উৎপাদিত গাছ সতেজ হয় সবজির মানও হয় খুব ভাল। সার তৈরিতে জড়িত নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এ সারের নির্মাণ প্রক্রিয়া। এ সারের নির্মাণ কৌশলেও রয়েছে মুন্সিয়ানা। প্রথমে গোবর সংগ্রহ করে ২৫ থেকে ৩০ দিন এক জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয়। এরপর গোবরের মধ্যে কেঁচো ছেড়ে দেয়া হয়। কেঁচো ছেড়ে দেয়ার ২৫ দিনের মধ্যে সার তৈরি হয়ে যায়। তবে প্রথমবার কেঁচো ছেড়ে দেয়ার পর সার হতে ২৫ দিন সময় লাগলেও পরবর্তীতে সে সময় কমে ১৫/১৬ দিনে নেমে আসে। এ সার উৎপাদনে খরচ খুব কম। যাদের গরু আছে তাদের খরচ আরও কম। চার/পাঁচটা রিং স্লাব সংগ্রহ করতে হয় যার প্রতিটির মূল্য দুই শ’ টাকা করে। আর প্রথম দফায় এক হাজার থেকে এক হাজার পাঁচ শ’ টাকার কেঁচো কিনতে পারলেই হলো। কেঁচোর খরচ ওই একবারই। এরপর বছরের পর বছর চালিয়ে গেলেও কেঁচো কিনতে হয় না। কেঁচো ডিম পেড়ে প্রতিনিয়ত বাচ্চা দেয়, পরে সারের পাশাপাশি কেঁচোও বিক্রি করা হয়। আর একটি রিং স্লাব না ভেঙ্গে যাওয়া পর্যন্ত সেটি দিয়ে কাজ করা যায়। ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের শোনপচা গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে ওই গ্রামের অন্তত পাঁচজন নারী জৈব সার উৎপাদন ও বিপণন করছেন। ওই গ্রামের খোয়াজ শেখের স্ত্রী আম্বিয়া বেগম (৪২) জানান, চার বছর আগে একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে গিয়ে তিনি রাসায়নিক সারের অপকারিতা ও জৈব সারের উপকারিতা সম্পর্কে জানতে পারেন। ওই প্রশিক্ষণ নেয়ার পর তার বোধোদয় হয়, ‘তাহলে আমরা বিষযুক্ত খাবার খাচ্ছি’। এ বোধ থেকে তিনি জৈব সার তৈরিতে হাত দেন। গত তিন বছর ধরে তিনি এ সার উৎপাদন করছেন। তিনি জানান, সার উৎপাদন করে বুঝেছি এ সার উৎপাদন করা লাভজনক। ঘরে বসে নিজেদের একটু পরিশ্রমে এ সার উৎপাদন করা যায়। ক্রেতারা বাড়িতে এসে সার কিনে নিয়ে যায় প্রতি কেজি ১০ টাকা দিয়ে। দুই ছেলের মা আম্বিয়া বেগম। বড় ছেলে শফিকুল শেখ ফরিদপুরের সরকারী রাজেন্দ্র কলেজের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে সাগর শেখ কানাইপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। স্বামী ছোট একটি ব্যবসা করেন। আম্বিয়া বেগম জানান, স্বামীর একক আয়ে সংসার চালানো কষ্ট। তবে কেঁচোর সার বিক্রি করে তিনি লাভবান হচ্ছেন। ছেলেদের হাত খরচের জোগান তিনিই দিতে পারেন। কেঁচো সার উৎপাদন ও বিপণন করে লাভবান হয়েছেন ওই গ্রামের কৃষক ছকেন ফকিরের স্ত্রী জামেলা বেগম (৩৯)। দুই মেয়ে ও এক ছেলের মা জামেলা ইতোমধ্যে তার এক ছেলে ও এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে শিউলি নবম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। জামেলা জানান, প্রতি সপ্তাহে তিনি প্রায় ১০০ কেজি পরিমাণ সার বিক্রি করেন। তিনি বলেন, প্রতিকেজি সার ১০ টাকা দরে বিক্রি হয়। সার বিক্রি করে মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। মূলত শাকসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি, কাঁচা মরিচ ক্ষেতে এ জৈব সার বেশি ব্যবহার হয়। তবে বর্তমানে জৈব সার ব্যবহারের ব্যাপ্তি বেড়েছে। ধান, পাটসহ বিভিন্ন ফসলে এবং নার্সারিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ছে। শুধু আম্বিয়া বা জামেলা বেগমই নন। শোনপচা গ্রামে কেঁচো সার উৎপাদন ও বিপণন করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন সালাম শেখের স্ত্রী ছবুরা বেগম, সাহেব আলীর স্ত্রী মমতাজ বেগম এবং আইউব আলীর স্ত্রী জয়গুন বেগম। ফরিদপুর সদরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, শোনপচা গ্রাম থেকে জৈব সার তৈরি শুরু হলেও এখন কানাইপুরের শোলাকু-সহ বিভিন্ন গ্রামে ব্যাপক হারে এ সার উৎপন্ন হচ্ছে। তিনি বলেন, এসারের জন্য আফ্রিকা থেকে আনা এপিজিক ও এন্ডোজিক প্রজাতির কেঁচো ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, ফরিদপুরে প্রথমে একটি বেসরকারী সংস্থা এ কেঁচো আনে। বর্তমানে কৃষকরাই কেঁচো বিক্রি করতে পারছেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, কেঁচো সার বা ভর্মি কম্পোস্ট ফরিদপুরে দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফরিদপুরের প্রতিটি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামে এ সার তৈরি হচ্ছে। খরচ কম এবং লাভজনক বলে এ সার উৎপাদনে মানুষের উৎসাহ বাড়ছে দিন দিন। -অভিজিৎ রায়, ফরিদপুর থেকে
×