ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যাসিনো পণ্য আমদানিতে বড় শুল্ক ফাঁকি

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১৩ অক্টোবর ২০১৯

ক্যাসিনো পণ্য আমদানিতে বড় শুল্ক ফাঁকি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ক্যাসিনো পণ্য আমদানির অধিকাংশ চালানেই বড় অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়েছে। আর এসব পণ্য আমদানি করেছে চার নেপালী। চীন থেকে এসব পণ্য আমদানি করে তারাই সরবরাহ করেছে বিভিন্ন ক্লাবে। রাজধানীতে অবৈধ ক্যাসিনোর জমকালো ব্যবসার চিত্র উন্মোচনের পর সামনে আসে কীভাবে এলো এসব ক্যাসিনো সরঞ্জাম। শুল্ক গোয়েন্দার তদন্তে বেরিয়ে আসে আমদানি নীতি আদেশে, নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় না থাকার সুযোগ নিয়ে খেলার সামগ্রীর আড়ালে এসেছে রকমারি ক্যাসিনো যন্ত্রপাতি। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দীনেশ, রাজকুমার, ভাংজু ও বুম নামে চার নেপালীর এ যন্ত্রপাতি আমদানিতে সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। কয়েক হাত ঘুরে যা গেছে বিভিন্ন ক্লাবে ও ক্যাসিনোতে। এর মধ্যে কমলাপুর আইসিডি দিয়ে আমদানি হয়েছে ৪০টি ক্যাসিনো লে আউটসহ বড় চালান। এছাড়া শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে এসেছে সাড়ে তিন হাজার পিস ক্যাসিনো কয়েন। জুতার সরঞ্জামের আড়ালেও মিথ্যা ঘোষণায় এসেছে এসব যন্ত্রপাতি। শুল্ক গোয়েন্দার প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশী আমদানিকারকদের ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে চারজন নেপালী ক্যাসিনো যন্ত্রপাতি এনে বিভিন্ন ক্লাবে সরবরাহ করেছে। অধিকাংশ চালানে বড় অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, অনুসন্ধানে দেখেছি নেপালীরা বাংলাদেশের লোকদের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আমদানি করেছে। এ প্রেক্ষাপটে ক্যাসিনো সামগ্রী আমদানি নিষিদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। আমদানি নীতি আদেশ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত জুয়ার আসরে ব্যবহৃত ক্যাসিনো সামগ্রী খালাস বন্ধে ব্যবস্থা নিতে সব কাস্টম হাউসকে চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। সেই সঙ্গে ক্যাসিনো সামগ্রী আমদানি নিষিদ্ধ করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আর ক্যাসিনো যন্ত্রপাতি খালাস বন্ধে নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করছে কাস্টম হাউসগুলো। অতিরিক্ত কমিশনার, ঢাকা কাস্টম হাউসের তাসনিমুর রহমান বলেন, আমদানি নিষিদ্ধ তালিকায় ক্যাসিনোর সরঞ্জাম ছিল না। যারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্বে আছেন তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হওয়া ২৯টি চালানে ক্যাসিনো সামগ্রী আমদানিকারী ২০টি প্রতিষ্ঠানকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। এর মধ্যে চাইনিজ মালিকানাধীন ৩টি শিল্প কারখানা, দুটি রেস্টুরেন্ট ও গেস্ট হাউস থেকে উদ্ধার করা হয়েছে জুয়া খেলার ইলেক্ট্রিক মাহাজং বোর্ড। তদন্ত চলছে ক্যাসিনোয় জড়িতদের ব্যাংক হিসাবের ॥ ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত মূলহোতা ও তাদের স্বজনদের ব্যাংক হিসাব তদন্ত করছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, বিএফআইইউ। তবে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য প্রতিবেদন প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান কর্মকর্তা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অভিযুক্তের নাম প্রকাশ না করে লেনদেনের তথ্য প্রকাশ করতে পারে কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কাজে যেন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না হয়, সেদিকে নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. ফরাস উদ্দিন। নামে যেমন সম্র্রাট, তেমনি অবৈধ হলেও ক্যাসিনো জগতেও ছিলেন ক্যাসিনো সিন্ডিকেটের মহারাজা। বিভিন্ন মহলে জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অভিযানের ১৭ দিন পর সম্রাটকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এর আগে সম্রাটের সেকেন্ড কমান্ড যুবলীগ নেতা জিকে শামীম ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকেও গ্রেফতার করা হয়। বন্দী রয়েছেন ক্রীড়াঙ্গনের শীর্ষ ব্যক্তি বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ও কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল আলম। গ্রেফতারের পরই অভিযুক্তসহ তাদের স্ত্রী, মা-বাবা ও সন্তানদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, বিএফআইইউ। নতুন করে ব্যাংক হিসাব তলবের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যুবলীগ চেয়ারম্যানেরও। এ তালিকায় অর্ধশত সংখ্যক ব্যক্তির নাম শোনা গেছে। এখন পর্যন্ত আটকরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ৩৫ জনের নাম স্বীকার করলেও ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে গ্রেফতার ৭ জনসহ কয়েকজনের স্বজনের ব্যাংক হিসাব। আর্থিক লেনদেনের তদন্ত প্রতিবেদন কবে দেয়া হবে সে বিষয়ে বিএফআইইউ প্রধান জানান, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থেই প্রতিবেদন প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রধান কর্মকর্তা আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান বলেন, আমরা ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করছি। এগুলো খুব গোপনীয় বিষয়। এগুলো নিয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। এগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যায়। তারা পরবর্তীতে এটা নিয়ে ব্যবস্থা নেয়। একই কথা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তার মতে, অভিযান পরিচালনা ও তদন্ত কার্যক্রম ফলপ্রসূ করতে ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য প্রকাশ করা ঠিক হবে না। তবে তদন্ত কার্যক্রম প্রভাবমুক্ত রাখার পরামর্শ তার। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে অনেকের বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে কিন্তু ধরা সম্ভব হচ্ছে না। এই রিপোর্টগুলো বের হয়ে গেলে এই প্রক্রিয়া আরও কঠিন হয়ে যাবে। নাম প্রকাশ না করা কিছু তথ্য প্রকাশ করা যেতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর। তিনি বলেন, সংসদ চাইলে কিছু সামারি তারা দিতে পারে। নাম প্রকাশ না করে কোন একটি ঘটনার পেছনে আমরা এই জিনিসগুলো পেয়েছি, এমনটা প্রকাশ করতে পারে। তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় পরিচালিত হতো ৬০টি ক্যাসিনো। এরসঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনতে অভিযান চালাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।
×