অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি-২০১৯ চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে জোর লবি শুরু করেছে সিগারেট কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)। গত ১৫ সেপ্টেম্বর অর্থ সচিব, স্বাস্থ্যসেবা সচিব এবং এনবিআর চেয়ারম্যানকে অনুলিপি দিয়ে অর্থমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি প্রেরণ করেছে সংগঠনটি।
চিঠিতে খসড়া জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি-২০১৯ এ অন্তর্ভুক্ত তামাক কোম্পানিতে সরকারী অংশীদারিত্ব বাতিল, তামাক খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং ইলেক্ট্রনিক সিগারেট নিষিদ্ধকরণ, প্লেইন প্যাকেজিং চালু ও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকৃতি/আয়তন বৃদ্ধি করা, সিগারেটের কর ও মূল্য বৃদ্ধি এবং সুনির্দিষ্ট করারোপের মতো তামাক নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষিত পদ্ধতিসমূহ অন্তর্ভুক্ত না করতে মনগড়া ব্যাখ্যা ও ভিত্তিহীন যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়কে রাজস্ব ভীতি দেখিয়ে নীতিমালা ক্ষতিগ্রস্ত করতেই বিসিএমএ এই কূটকৌশল অবলম্বন করেছে। এর আগে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়ন বিষয়ক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা বাধাগ্রস্ত করতে সংঘবদ্ধ মিডিয়া ক্যাম্পেন চালিয়েছিল তামাক কোম্পানিগুলো।
বিসিএমএ বাংলাদেশকে সিগারেটের ওপর উচ্চ কর আরোপ করা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে অভিহিত করলেও বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে সিগারেট অত্যন্ত সস্তা। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সবচেয়ে কম দামী সিগারেটের মূল্য বাংলাদেশের কম দামী সিগারেটের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের তথ্যমতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমার, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে কম দামে সস্তা ব্রান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কর আরোপের মাধ্যমে তামাক পণ্যের সর্বনিম্ন মূল্য বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। চিঠিতে সিগারেটের কর বাড়ানোর সঙ্গে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া সিগারেট প্রচলন ও রাজস্ব হারানোর যে কল্পনাপ্রসূত যুক্তি বিসিএমএ তুলে ধরেছে তা কোনভাবেই সত্য নয়। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক তামাক পণ্যের অবৈধ বাণিজ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশে সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্য ২৭ দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম মাত্র ১.৮ শতাংশ। তামাকের ওপর কর বাড়ানোর সঙ্গে অবৈধ বাণিজ্য বৃদ্ধির তেমন কোন সম্পর্কও নেই। তামাক পণ্যের ব্যবহার কমাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ প্লেইন প্যাকেজিং পদ্ধতির প্রচলনকে বিসিএমএ চিঠিতে অকার্যকর হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেছে। অথচ, এর গুরুত্ব অনুধাবন করে থাইল্যান্ড, তুরস্ক, সৌদিআরব, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ কমপক্ষে ১৬টি দেশের অনুমোদন দিয়েছে। এই পদ্ধতিতে তামাক পণ্যের প্যাকেট বা কৌটার গায়ে কোন প্রকার প্রচারমূলক ও বিভ্রান্তিকর শব্দ ব্যবহারের সুযোগ থাকে না, যা ছবিযুক্ত স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে বাংলাদেশে তামাক পণ্যের প্যাকেটে ৫০ শতাংশ স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণের বিধান রয়েছে। অথচ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপালে ৯০ শতাংশ, ভারতে ৮৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৮৫ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৮০ শতাংশ জায়গা জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর প্রচলন রয়েছে। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং রাজস্ব সংরক্ষণের জন্য তামাক কোম্পানিতে সরকারী অংশীদারিত্ব ধরে রাখা দরকার বলে বিসিএমএ চিঠিতে উল্লেখ করেছে।
বাস্তবতা হলো বহুজাতিক তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার এবং কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে একাধিক সরকারী কর্মকর্তা মনোনীত থাকায় সরকারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তামাক নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপসমূহে হস্তক্ষেপ করা তামাক কোম্পানির জন্য সহজ হয়েছে। তামাক খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ নিষিদ্ধ না করার জন্য বিসিএমএ একাধিক যুক্তি তুলে ধরেছে, যার মধ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি অন্যতম। এটি অত্যন্ত হাস্যকর যুক্তি। আসল সত্য, ৪৯ শতাংশ তরুণ জনগোষ্ঠীর এই দেশ এখন তামাক কোম্পানিগুলোর লোভনীয় বাজার। চিঠিতে ইলেক্ট্রনিক সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড (আইকিউওএস) টোব্যাকো প্রোডাক্ট ইত্যাদিকে প্রথাগত সিগারেটের ‘নিরাপদ বিকল্প’ হিসেবে উপস্থাপন করে এগুলো বন্ধ না করার কথা বলা হয়েছে। তামাক কোম্পানিগুলো মূলত তরুণ এবং শিশুদের টার্গেট করে এসব পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। উদ্ভাবনী কৌশল এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর ও তরুণদের মাঝে এসব তামাক পণ্য জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করেছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশে এসব পণ্য ব্যবহার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তবে বাংলাদেশে এখনও তা প্রকট আকার ধারণ করেনি। ইতোমধ্যে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ প্রায় ৪০টি দেশ এসব পণ্য নিষিদ্ধ করেছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: