ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষকের বন্ধু ‘মাটির ডাক্তার’

প্রকাশিত: ০৮:৫০, ১০ আগস্ট ২০১৯

 কৃষকের বন্ধু ‘মাটির ডাক্তার’

বড় বড় হরফে লেখা সাইনবোর্ড। বাইরে থেকে তাকালে সহজেই চোখে পড়বে ডাক্তারের চেম্বার। তবে ডাক্তার ও তার চেম্বার একেবারে ভিন্ন ধরনের। লোকজনের ভিড়ও বেশ। ডাক্তারের গলায় ঝোলানো নেই কোন স্টেথিস্কোপ। রোগীর নাড়ির স্পন্দন দেখার ব্যস্ততা নেই। রোগী কিন্তু আসেন না ডাক্তারের চেম্বারে। তবে রোগী ছাড়াই ব্যবস্থাপত্র দেয়া চলছে মৌখিকভাবে, আবার কখনও বা চিরকুটের মতো ছোট কাগজে। বই পুস্তকে এরকম আজব ডাক্তারের কথা না থাকলেও বগুড়ার ফাঁপোর ইউনিয়েনে এই ডাক্তার জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী উপকার পেয়ে আবার কোন সমস্যায় পড়লেই ডাক্তারের চেম্বারে আসছেন লোকজন। নিচ্ছেন ব্যবস্থাপত্র ও পরামর্শ। সে অনুযায়ি ওষুধ প্রয়োগ করে সুফলও পাচ্ছেন তারা। ডাক্তারেরও সহজ কথা- ডাক্তারী বিদ্যা নিয়ে কোন শিক্ষালয়ের ডিগ্রী নেই তার। পেশায় তিনি একজন কৃষক। এখন ‘ডাক্তার’ হিসাবেই অনেকের কাছে তার পরিচিতি। আর নতুন ধরনের এই ডাক্তারের নাম- ‘মাটির ডাক্তার’। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, সুফলা মাটিসহ মাটি দূষণ রোধের ব্রত নিয়েই কৃষকদের সহায়তাকারী হিসেবে চলছে মাটির ডাক্তারের কার্যক্রম। এই ডাক্তারের রোগী হচ্ছেন-আবাদী মাটি। আর রোগীর স্বজন হচ্ছেন-সাধারণ কৃষকসহ গাছ গাছালি ও বাগান আবাদিরা (যারা রোগীর জন্য ডাক্তারের নিকট চিকিৎসা নিতে আসেন)। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) বগুড়া শাখা, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে ‘মাটির ডাক্তার’ বা কৃষকদের সহায়তাকারী উদ্যোক্তা প্রতিনিধি কার্যক্রম বগুড়ায় শুরু করেছে। দেশের মধ্যে ‘মাটির ডাক্তার’ কার্যক্রম এটিই প্রথম। পরীক্ষামূলক ‘মাটির ডাক্তার’ উদ্যোগের প্রায়োগিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে বগুড়া শহরের সবেচেয়ে নিকটবর্তী ইউনিয়ন ফাঁপোরে। এসআরডিআই উদ্ভাবিত এই উদ্যোগ অভাবিত ইতিবাচক সাড়া ফেলায় মাটির ডাক্তার কার্যক্রম হয়ে উঠেছে কৃষকদের বন্ধু। এসআরডিআইসহ সেবা গ্রহণকারী কৃষকরা বলছেন, এ ধরনের সেবা পেয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে আবাদের খরচও কমছে। উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট বগুড়া শাখা বলছে, মাটির ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক পদ্ধতিতে মাটির পরিচর্যা ও প্রয়োজনীয় মাত্রায় সার ব্যবহার করায় কৃষকদের উৎপাদন খরচ ১০ ভাগ কমছে এবং ফলন বাড়ছে ২০ ভাগ পর্যন্ত। বগুড়ায়‘ মাটির ডাক্তার’ ধারণার উদ্ভাবনকারী হচ্ছেন- এসআরডিআই বগুড়া জেলা কার্যালয়ের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শাহ মোঃ গোলাম মওলা। পরীক্ষামূলক এই উদ্যোগে কৃষকদের মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। আর তা কৃষকদের আবাদ নিয়ে নানা দুঃশ্চিন্তা দূর করে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছেন। বগুঁড়া বাইপাস সড়কে তিনমাথা এলাকা থেকে ৫ কিলোমিটার এগোলেই ফাঁপোর ইউনিয়নের কৈচড় বাজার। সেখানে গ্রামীণ রাস্তার পাশেই ‘মাটির ডাক্তার’ গোলাম রব্বানী মানিকের চেম্বার। তিনি নিজেও একজন কৃষক। পাশাপাশি সারের ব্যবসাও করেন। এখন এলাকায় তার পরিচিতি ‘মাটির ডাক্তার’। তিনি শুধু চেম্বারেই পরামর্শ দেন না, মাঠ পরিদর্শন করেও রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দেন। কোন পারিশ্রমিক ছাড়াই সেবামূলক একাজে জড়িয়েছেন তিনি মাটি ও কৃষির প্রতি ভালবাসার টানে। ডাক্তারের চেম্বারে রয়েছে বেঞ্চে বসার ব্যবস্থা। সেখানে গিয়ে দেখা গেল জমি ও আবাদের নানা সমস্যা নিয়ে আসা রোগী (কৃষকদের) ভিড়। এদেরই একজন রোকসানা। বাড়ি স্থানীয় কৈচড় গ্রামের ডাক্তারপাড়ায়। পৈত্রিক সূত্রে ভাই বোনের জমি প্রায় ১০ বিঘা। ছোট ভাই রাশেদ খান হিরা চাকরি সূত্রে অন্য জেলায়। পুরো জমির আবাদ তাই রোকসানাকেই দেখতে হয়। আমন মৌসুমের জন্য লাগানো বীজতলায় পানি জমে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই ছুটে এসেছেন মাটির ডাক্তারের চেম্বারে। কৈচড় উত্তরপাড়ার কৃষক আব্দুল কুদ্দুস ৬ বিঘা জমিতে আমন আবাদের জন্য বীজতলা করেছেন। কিন্তু তা নষ্ট হওয়ার পথে। অগাত্য মাটির ডাক্তার। একই ইউনিয়নের কানাল এলাকার রনজিত সরকারের জমি ৪বিঘা। বস্তায় বস্তায় ইউরিয়া ছিটিয়েও জমিতে আশানুরূপ ফলন না পেয়ে গত বছর মাটির ডাক্তারের পরামর্শ নেন। পারমর্শ অনুযায়ী জমির বিভিন্ন স্থান থেকে মাটি নিয়ে জেলা মৃত্তিকা অফিসে (এসআরডিআই) জমির মাটি পরীক্ষা করান। তিনি জানতে পারেন, কেন তার জমিতে ফলন কম হচ্ছে। মাটি পরীক্ষা করে জানতে পারেন, এমওপি এবং জৈব সারের অভাব রয়েছে তার জমিতে। সে অনুয়ায়ী সার প্রযোগ করে সে বছর ফলনও ভাল পান। এখন বাড়ির কাছে ৫ শতক জমিতে কুমড়োর আবাদ করবেন বলে ঠিক করেছেন। এ জন্য পরামর্শ নিতে এসেছেন মাটির ডাক্তারের নিকট। ‘মাটির ডাক্তার’ কার্যক্রম ফাঁপোর ইউনিয়নে শুরু হয় গত বছরের শেষের দিকে। এখন এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত দু’শতাধিক কৃষক। তারা এখন বুঝতে পারছেন ভাল ফলনের জন্য প্রয়োজন মাটির উর্বরতা। আর এর স্বাস্থ্য সেবার দিকে নজর তথা মাটির উর্বরতা যেন নষ্ট না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। এসব কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাটির ডাক্তার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর সুষম সারের ব্যবহারের কারণে জমিতে সার কম লাগছে। জৈব সারের দিকেও তারা মনোযোগী হযেছেন। আগে যে জমিতে ২০ কেজি ইউরিয়া ৪ দফায় ব্যবহার করা হতো এখন তা ১২/১৪ কেজিতেই সম্পন্ন করছেন। টিএসপিসহ অন্য সারের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এ কারণে তাদের জমিতে সারের খরচ কমার সঙ্গে উৎপাদন বেড়েছে। কৈচর এলাকার মাহফুজ ও রণজিত জানালেন, আগের তুলনায় বিঘাপ্রতি তারা ৩/৪ মণ ফলন বেশি পাচ্ছেন। সঙ্গে সার ব্যবহারও কম লাগছে। আরও কয়েক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল- যে কোন আবাদের সমস্যায় তারা মাটির ডাক্তারের মাধ্যমে আসছেন, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে। আর মাটির ডাক্তার কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করছেন এর উদ্ভাবক বগুঁড়া এসআরডিআইর উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা গোলাম মওলা। তিনি জানালেন, মাটির সঠিক যতেœর অভাবে ভারসাম্য হারাচ্ছে, স্বাস্থ্যেরও অবনতি হচ্ছে, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতন হওয়ার সময় এখনই। আমরা এখন খোরপোষের কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষির দিকে এগুঁচ্ছি। এই ধারা অব্যাহত রাখতে কৃষি উন্নয়নের বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজন সুফলা ও স্বাস্থ্যকর মাটি। মাত্রারিক্ত ভূগর্ভস্থ সেচ পানির ব্যবহার, রাসায়নিক, কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার, মাত্রাতিরিক্ত দুষক পদার্থের উপস্থিতি মাটির দূষণ ঘটাচ্ছ্।ে মৃত্তিকা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে সেচনির্ভর ফসলের বেশি আবাদের কারণে মাটির ভৌত ও রাসায়নিক গুঁণাবলীর পরিবর্তনসহ দস্তা ও সালফারের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের প্রায় ১ দশমিক ৭মিলয়ন হেক্টর জমিতে দস্তার অভার রয়েছে। এছাড়া অম্লধর্মী ইউরিয়া, এ্যামোনিয়া সালফেটসহ অন্যান্য নাইট্রোজেন সার মাত্রারিক্ত ব্যবহারেও মাটির অম্লত্ব বাড়ছে। দেশে ৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার অম্লত্বের শিকার। মৃত্তিকা গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা কৃষিবিদ গোলাম মওলা জানালেন মাটি সুফলা রাখতে মাটির স্বাস্থ্যর দিকে নজর দেয়া জরুরী। বিভিন্ন এলাকার মাটির অবস্থা ও সারের মাত্রা নির্ধারণ ও ফসল বিন্যাসসহ মাটি ও ফসল সংক্রান্ত্র নানা তথ্য নির্ধারণ করে এসআরডিআইর প্রকাশনা ‘উপজেলা নির্দেশিকায়’ তুলে ধরা হয়েছে। মাটির ডাক্তার কার্যক্রমে মৃত্তিকা বিভাগের এই উপজেলা নির্দেশিকাই কৃষকদের পরামর্শ ও সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছে। মাটির ডাক্তার কার্যক্রমের উদ্ভাবক আরও জানালেন, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধিতে এসব তথ্য কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্যই মাটির ডাক্তার কার্যক্রম বগুড়ায় শুরু করা হয়েছে। -মাহমুদুল আলম নয়ন, বগুড়া থেকে
×