ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফরমালিন, কার্বাইডযুক্ত ফল ধরতে ঢাকার ৮ প্রবেশপথে চেকপোস্ট

প্রকাশিত: ১০:২৮, ২৬ মে ২০১৯

 ফরমালিন, কার্বাইডযুক্ত ফল ধরতে ঢাকার ৮ প্রবেশপথে চেকপোস্ট

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ভেজাল খাদ্যদ্রব্য আর খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। রাজধানীতে ক্ষতিকর ফরমালিন বা কার্বাইডের মতো রাসায়নিক পদার্থযুক্ত ফলমূল প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে। ফরমালিন বা কার্বাইডযুক্ত ফলমূলবাহী যানবাহন ধরতে ঢাকার ৮ প্রবেশপথে বসানো হচ্ছে চেকপোস্ট। চেকপোস্টে ধরাপড়া ফলমূল ধ্বংস করা হবে। সেই সঙ্গে ভেজাল ফলমূল বহন, বেচাকেনার সঙ্গে জড়িতদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক জেল-জরিমানা করা হবে। রমজান মাসের পরও অন্তত এক সপ্তাহ এমন অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ফলমূল ছাড়া ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে ধারাবাহিকভাবে। এমনকি বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ফলমূল বা খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন বা কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ আছে কিনা তা বিমানবন্দরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফরমালিন আমদানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করার পাশাপাশি আমদানিকৃত ফরমালিন সঠিকভাবে বিক্রি বা ব্যবহার হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে কঠোর মনিটরিং করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক খাদ্যদ্রব্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানো গণহত্যার শামিল। কারণ, এসব ভেজাল খাদ্যদ্রব্য ভবিষ্যত প্রজন্মকে দিন দিন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পুরো জাতিকে তিলে তিলে হত্যা করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে দীর্ঘদিন ধরেই খাদ্যে ভেজাল রোধে কাজ চলছে। তারপরও যেন এর কোন সুরাহা হচ্ছে না। প্রতিদিনই রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। অভিযানে ফলমূলসহ বিভিন্ন খাদ্যে ভেজাল পাওয়ার দায়ে তাদের জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। তারপরও যেন দেশ ভেজাল খাদ্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারছে না। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, রমজানের আগে এবং রমজানের মধ্যেই বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দফায় দফায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বৈঠক করেছে। বৈঠকে খাদ্যে ভেজাল রোধে ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও দেনদরবার হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন লাভ হয়নি। ব্যবসায়ীরা বৈঠকে বার বার বিষমুক্ত বা কেমিক্যালমুক্ত খাদ্য ও ফলমূল আমদানি বা বিক্রির প্রতিশ্রুতি দিলেও অধিকাংশ ব্যবসায়ী তা কার্যকর করেনি। বৈঠকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা খাদ্যে ভেজাল মেশান না। তবে খোদ উৎপাদনকারী ও খুচরা বিক্রেতারা খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল বা ফরমালিন মেশায়। এতে করে তাদের কিছুই করার থাকে না। যদিও খুচরা বিক্রেতারা বলেছেন এর ঠিক উল্টো। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছরই ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়। এবারও বসানো হয়েছে। নানা কারণেই ক্যাম্পগুলো বসানো হয়। ক্যাম্প বসানোর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তল্লাশি। ঢাকায় ক্ষতিকর যেমন মাদক, অস্ত্র, গোলাবারুদ, সন্ত্রাসী বা কেমিক্যাল বা বিষাক্ত কোন খাদ্যদ্রব্য ঢুকছে কিনা তা মনিটরিং করা হয়। পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুস্থ-স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে এবং অদূর ভবিষ্যতে জাতিকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে সরকার ফরমালিনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এজন্য বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ফলমূল বা খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন বা কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ আছে কিনা তা বিমানবন্দরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ফরমালিক আমদানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। এমনকি আমদানি করা ফরমালিন সঠিকভাবে বিক্রি বা ব্যবহার হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে কঠোর মনিটরিং শুরু হয়েছে। ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবারই ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের অভিযানকালে একে অন্যকে দোষারোপ করার ঘটনা ঘটে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল থেকেই যাচ্ছে। তাই এবার সাঁড়াশি অভিযানের পাশাপাশি ঢাকার প্রবেশপথগুলোতেও অস্থায়ী চেকপোস্ট বসানো হচ্ছে। যাতে ভেজাল খাদ্যদ্রব্য ঢুকতে না পারে। ঢাকার প্রবেশপথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হলে স্বাভাবিক কারণেই ঢাকার ভেতরে আর ভেজাল খাদ্য ঢুকতে পারবে না। এটি ভেজাল খাদ্যের আগ্রাসন ঠেকানোর ক্ষেত্রে তুলনামূলক সহজ হবে। যদিও ইতোমধ্যেই এমন পদ্ধতি কোন কোন চেকপোস্টে চালু করা হয়েছে। সাধারণত ঢাকার বেশিরভাগ বাজারের খাদ্যে ও ফলমূলেই ফরমালিন ও ক্যালসিয়াম কার্বাইড এবং কার্বাইড ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ঢাকার যেসব পথে চেকপোস্ট বসছে ॥ রাজধানীতে প্রবেশের ৮টি স্থানে চেকপোস্ট বসানো হচ্ছে। এসব পয়েন্ট হচ্ছে পোস্তগোলা ব্রিজ, যাত্রাবাড়ি থানাধীন সাইনবোর্ড, ডেমরা থানাধীন সুলতানা কামাল ব্রিজের পশ্চিম পাশে ডেমরা চৌরাস্তা, বাবুবাজার ব্রিজ, সদরঘাটের ওয়াইজঘাট, গাবতলী পর্বত সিনেমা হলের সামনে, আব্দুল্লাপুর ব্রিজ ও তুরাগ থানাধীন ঢাকা-আশুলিয়া সড়কের ধউর ব্রিজ। চেকপোস্টের কারণে যাতে যানজটের সৃষ্টি না হয় এজন্য ফল ও শাকসবজি বহনকারী যানবাহন আলাদা খোলা জায়গায় নিয়ে চেক করতে বলা হয়েছে। ক্যালসিয়াম কার্বাইড কি ॥ চিকিৎসকদের ভাষ্য মোতাবেক শিল্প কারখানায় পেট্রোলিয়ামের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহৃত হয়। এটি ফল পাঁকানোর কাজেও ব্যবহার করা হয়। যা মানবদেহের জন্য চরম ক্ষতিকর। ফরমালিন কি ॥ ফরমালিন হাসপাতাল ও ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহারের জন্য তৈরি বিশেষ এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ। এই পদার্থ দিয়ে প্রাণীদেহের বিভিন্ন অংশ বছরের পর বছর অক্ষত অবস্থায় ব্যাকটেরিয়ামুক্ত রাখা যায়। মূলত তা সংরক্ষণের কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে প্রাণীদেহের জটিল রোগ নির্ণয় করতে প্রাণীদেহের যে অংশ বা পদার্থ পরীক্ষা- নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজন হয়, সেই অংশকে ফরমালিনে ডুবিয়ে রেখে বছরের পর বছর অক্ষত রাখা হয়। প্রাণীদেহ ছাড়াও অন্যান্য পদার্থ ব্যাকটেরিয়ামুক্ত করতেও ফরমালিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মানবদেহে ফরমালিনের সহনীয় মাত্রা ॥ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দেয়া ধারণা অনুযায়ী একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন গড়ে ১ দশমিক ৫ থেকে ১৪ মিলিগ্রাম বা ০ দশমিক ০৩ থেকে ০ দশমিক ১৫ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) মাত্রার ফরমালিন গ্রহণ করতে পারেন। এর বেশি মানবদেহে প্রবেশ করলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছাড়াও নানা জটিল রোগ শরীরে আস্তে আস্তে বাসা বাঁধতে থাকে। ঢাকার ফলে যে পরিমাণ ফরমালিন মেশানো হয় ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশের চলমান অভিযানের তথ্য মোতাবেক, ঢাকায় ফলমূলে মাত্রাতিরিক্ত ফরমালিন মিশানো হয়। চলমান অভিযানে জব্দ করা যেসব ফল ধ্বংস করা হয়েছে তাতে ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪৬ দশমিক ০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) মাত্রায় ফরমালিন পাওয়া গেছে। মাত্রাতিরিক্ত ফরমালিনের ফলে যেসব ক্ষতি হয় ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শাহজাদা সেলিম বলছেন, ফরমালিনে ডুবিয়ে রাখা লাশ ৪০ বছর পর্যন্ত অনেকটাই অক্ষত থাকে। লাশে তেমন কোন পচন ধরে না। এমন ধারণা থেকেই ব্যবসায়ীরা ফল ও শাকসবজিতে ফরমালিন মিশিয়ে থাকে। ব্যবসায়ীদের মানবদেহে ফরমালিনের ধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফ থেকেও বাংলাদেশের মানুষের দেহ কি পরিমাণ ফরমালিন ধারণক্ষম তা সুনিশ্চিতভাবে নির্ণীত হয়নি। যদিও ডব্লিউএইচও বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশেরই মানুষের দেহে কি পরিমাণ প্রিজারভেটিভ ধারণক্ষম তা নির্ণয় করে দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে এখনও বাংলাদেশের মানুষের দেহ কি পরিমাণ ফরমালিনের ধারণক্ষমতা আছে তা নির্ণীত হয়নি। এজন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের তরফ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বাংলাদেশের মানুষের দেহ কি পরিমাণ ফরমালিন ধারণক্ষম তা নির্ণয় করে দিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ফল ও শাকসবজির ফরমালিনের বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ফরমালিনযুক্ত খাদ্যে যেসব রোগ হয় ॥ ডাঃ শাহজাদা সেলিম আরও জানান, অতিরিক্ত পরিমাণ ফরমালিন মানবদেহের প্রতিটি সিস্টেমকে ব্যাহত করে দেয়। মানবদেহের নড়াচড়া থাকায় ফরমালিন মানবদেহকে একেবারে বিকল করতে পারে না। আবার পায়ুপথ দিয়েও মানবদেহে প্রবেশ করা ফরমালিনের কিছু অংশ নির্গত হয়ে যায়। ফরমালিন দেহের সেলগুলো আস্তে আস্তে অকার্যকর করতে থাকে। মানবদেহ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। কিডনি বিকল হয়ে যায়। প্রাণীদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দেয়। চোখের কর্ণিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দিন দিন দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে। এমনকি ডায়বেটিসের মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টিতেও ফরমালিনের প্রভাব রয়েছে। ফরমালিনের বিকল্প ব্যবহার ॥ ফরমালিন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিধায় বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে ফরমালিনের বিকল্প হিসেবে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ব্যবহার করা হয়। এটি মানবদেহের জন্য অতটা ক্ষতিকর নয়। যেসব খাদ্যদ্রব্য অভিযানের আওতায় থাকবে ॥ ফরমালিনযুক্ত ফল, মাছ, তরকারি, অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে খাবার সংরক্ষণ, পচা ও বাসি খাবার বিক্রি, ভেজাল গুঁড়া মসলা তৈরি ও বিক্রি, নকল খাদ্যজাতীয় দ্রব্য তৈরি ও বিপণন। এছাড়া ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে জড়িতদের জেল-জরিমানা করা হবে। বিশুদ্ধ খাদ্য বিধিমালা মোতাবেক ভেজাল খাদ্য উৎপাদন, বিপণন, বাজারজাতকরণ, আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িতদের ৫শ’ টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং সর্বনিম্ন ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড প্রদানের বিধান আছে।
×