ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রযুক্তিনির্ভর ক্যাম্পাস

প্রকাশিত: ০৮:৪৮, ১৯ মে ২০১৯

প্রযুক্তিনির্ভর ক্যাম্পাস

স্কুল-কলেজে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন দুই বন্ধু দৃশ্য ও সাম্য। উচ্চশিক্ষার জন্য দু’জন ভর্তি হলেন দুই শহরের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে। মোবাইল হারিয়ে যাওয়ার কারণে সেই থেকে যোগাযোগ নেই। একদিন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে সার্চ দিয়ে দৃশ্যের খোঁজ পেলেন সাম্য। এরপর থেকে সাম্যের সে কি উত্তেজনা! নিজের ফ্রেন্ডলিস্টে বন্ধুকে যুক্ত করে চুটিয়ে আলাপ জমিয়ে আবার একত্রিত হলেন দুই বন্ধু। ফেসবুকের যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশ্বখ্যাত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে। সারা বিশ্বের হাজার হাজার স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এর বিস্তৃতি। বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকবে। বাংলাদেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতেও ফেসবুকের ব্যবহার এখন ব্যাপক। বিভিন্ন ক্যাম্পাসের ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও আনাগোনা আছে ফেসবুকে। ক্যাম্পাসের সড়ক, চত্বর, গাছতলা, টেন্ট, ক্যান্টিন, কাফেটারিয়া, মাঠ কিংবা খোদ ডিপার্টমেন্টের বারান্দার আড্ডা, আলোচনা-বিতর্ক স্থান পরিবর্তন করে ফেসবুকের ওয়ালে জায়গা করে নিয়েছে। ফেসবুকের আড্ডার সবচেয়ে বড় সুবিধা আড্ডাটি হয় লিখিত আকারে। দুই মাস আগে শুরু হওয়া কোন বিষয়ের ওপর আলোচনায় যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে, ফলে জমে ওঠে ভার্চুয়াল আড্ডা। দেশের প্রতিটি সরকারী-বেসরকারী ও অধিকাংশ শহুরে কলেজের নামে ফেসবুকে একাধিক গ্রুপ এবং পেজ সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো সৃষ্টি করেছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই। এসব গ্রুপে গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনা হয় প্রতিদিনই। গ্রুপগুলোতে বর্তমান শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও অংশগ্রহণ করে। এমনকি এক ক্যাম্পাসের আলোচনা আর আড্ডায় অন্য ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণও লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দুয়েকজন শিক্ষকও আলোচনায় দুয়েকটা লাইন বসিয়ে দেন। এসব গ্রুপ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ক্যাম্পাসগুলোর এ্যালামনাই শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনীর আয়োজন। এসব আয়োজনের দাওয়াত দেয়া, বাজেট প্রণয়ন, চাঁদা সংগ্রহ, সবই ফেসবুকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। শুধু অনুষ্ঠানের দিন নির্দিষ্ট স্পটে খাওয়া-দাওয়া আর ফটোসেশনের কাজটা হয়। কারণ ফেসবুকে অনেক কিছু করা গেলেও খাওয়ার কাজটা করা যায় না। আবার একসঙ্গে অনেকে আড্ডা দেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও গ্রুপ ছবি তোলার ব্যবস্থা নেই। তবে তোলা ছবি দেখার চমৎকার সব ব্যবস্থা আছে। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোর ক্যাম্পাসের নামের পাশাপাশি অনুষদ, ডিপার্টমেন্ট, আবাসিক হল এমনকি কোন বছরের ব্যাচের নামেও ফেসবুকের গ্রুপ এবং পেজের সন্ধান পাওয়া যায়। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপ বা পেজের ছবি, ভিডিওচিত্র আর লেখনী এতটাই তথ্যবহুল যে তা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের চেয়েও সমৃদ্ধশালী। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি তথ্য, পরীক্ষার রুটিন, সর্বশেষ সংবাদ, সুবিধা-অসুবিধা, সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া যায় এসব গ্রুপ থেকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট নিয়মিত আপডেট না হওয়ায় ফেসবুক থেকে তথ্য পাওয়া যায়। তথ্য জানার পাশাপাশি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি লিখিত আলাপও করা যায় সংক্ষিপ্ত সময়ে। এ প্রতিবেদনটি তৈরিতে ফেসবুকের মাধ্যমেই কয়েক শিক্ষার্থীর সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন তাঁদের মতামত। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিক্স ফিজিক্স এ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী নুসরাত জাহান লিজা বলেন, আমার বাসা কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাস এলাকায় হওয়ায় যেদিন ক্লাস থাকে না সেদিন বাসায় চলে যাই। দিনরাত সব সময়ই ফেসবুকে ক্যাম্পাসের কাউকে না কাউকে পাই। মনেই হয় না ক্যাম্পাসের বাইরে আছি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্রী কারিশমা বলেন, ফেসবুকে আমার সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হলো এই ফেসবুকের মাধ্যমেই আমার সাবেক স্কুলজীবনের বন্ধু বর্তমানে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আর্কিটেকচার বিভাগের ছাত্র রিয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র আল-আমিন বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে ক্যাম্পাসেরই এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। পরিচয়ের সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তিনি আমাকে সাভারে দুটো টিউশনী যোগাড় করে দিয়েছেন। তাই বলতে হয় জয়তু ফেসবুক। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ১ম সেমিস্টারের ছাত্রী সনিকা খান সিথি, লোপা বালা, সামিয়া আক্তার শান্তা, বৃন্তি মল, ফাহমিদা জাহান মিতু, মৃন্ময়ী রায় কথা, ফাতেমা ইসলাম লিজা ও মৈত্রী দেবনাথ বলেন, একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রোফাইল দেখে তাঁর পরিচয়, ঠিকানার পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিত্ব, রুচি, বন্ধুমহল, এমনকি মেধা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। ফেসবুকের এত সুবিধার মাঝে কিছু কিছু ভয়াবহ খারাপ দিকও যে আছে সে সম্পর্কে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী এনামুল, সোহেল, শম্পা খাতুন ও রত্না বলেন, তাদের ক্যাম্পাসে হলে তারা এখনও ইন্টারনেট সুবিধা পাননি। তাদের অনেকেই এই বন্ধুত্বের সুন্দর মাধ্যম থেকে বঞ্চিত। তারপরও অনেকে ইন্টারনেট মডেম কিনে অথবা মোবাইলের মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহার করেন। তারা তাদের ক্যাম্পাস কর্তৃপক্ষকে হলে ওয়াইফাই দেয়ার দাবি জানান। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের কানিজ ফাতেমা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মিচিংনু মারমা এবং পবিপ্রবির কৃষি অনুষদের ৪র্থ সেমিস্টারের নুসরাত জাহান স্বর্ণা, ইসরাত জাহান শুভ্রা ও সানজিদা কুনতুলি বলেন, ফেসবুক থেকে খুব সহজে একজনের ছবি অন্যজন ডাউনলোড করতে পারে। ডাউনলোড করা ছবি অনেক সময় বিকৃত করে আবার ফেসবুকের ওয়ালেই ছেড়ে দেয়ার নজির আছে। বিশেষ করে আমাদের মেয়েদের তথ্য ও ছবি চুরি করে ব্ল্যাকমেল করার ঘটনা বর্তমান সময়ে অহরহ ঘটছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র আমানুল্লাহ ফয়সাল ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এরশাদুল বারী কর্নেল বলেন, ফেসবুকে যেহেতু দেশ-বিদেশের অনেক বন্ধুবান্ধব একসঙ্গে মিলিত হয়। তারা আড্ডায় আড্ডায় অনেক সময় নষ্ট করে। এই সামাজিক ওয়েবসাইটটি একটি নেশার মতো বিষয়। এ নেশায় শরীর ও অর্থ নষ্ট না হলেও সময় নষ্ট হয় অনেক। শিক্ষার্থীদের জন্য এমন সময় অপচয় তাদের পরীক্ষার ফলাফলে খারাপ প্রভাব ফেলে।
×