ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কে বিশৃঙ্খলা ও যানজটে নাকাল নগরবাসী ॥ সঙ্কট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে প্রস্তাব

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ১৮ মে ২০১৯

 সড়কে বিশৃঙ্খলা ও যানজটে নাকাল নগরবাসী ॥ সঙ্কট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে প্রস্তাব

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বারবার ট্রাফিক সপ্তাহ, পক্ষ বা মাস পালন করেও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না। যানজটও আসছে না সহনীয় মাত্রায়। আসন্ন ঈদ কেন্দ্র করে নগরীতে এখন যানজটের মাত্রা বেড়েছে। রমজানে অফিসের সময় কমিয়ে আনা হলেও রাত অবধি গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে যানজটের কারণে দুর্ভোগ দেখা যায়। ঢাকার রাজপথে যে কোন কর্মদিবসে যানজটে নাকাল হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। অথচ প্রতিদিনই ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে মামলা ও জরিমানা অব্যাহত রয়েছে। বাস্তবতা হলো যানজটের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি চান নগরবাসী। তেমনি যানজটমুক্ত নগরী গড়ে তুলতে চায় ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশ। এরই অংশ হিসেবে এবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর ২৯ দফা প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এদিকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের পক্ষ থেকে গঠিত কমিটি ১১১ দফা সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছে। এসব সুপারিশ প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত করলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে আসার কথা রয়েছে। তারপর একাধিক টাস্কফোর্স গঠনের মধ্য দিয়ে সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে কমিটির পক্ষ থেকে। তবে ঢাকার যানজট নিরসন ও পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ ও সরকারের গঠিত কমিটির প্রস্তাব প্রায় কাছাকাছি। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়ার সই করা ২৯ দফা প্রস্তাব সম্প্রতি বিবরণী আকারে পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর স্বার্থে ডিএমপির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এতে ২৯টি দফা রয়েছে। এই সুপারিশ অনুযায়ী ডিএমপিকে কাজ করতে দেয়া হলে ঢাকা শহরের যেমন শৃঙ্খলা ফিরবে, তেমনি জনজীবনেও স্বস্তি ফিরে আসবে। পুলিশের শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা ॥ এদিকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে তৎপর পুলিশ। বৃহস্পতিবারও রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকায় বাস টার্মিনালের কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা আসন্ন ঈদ উপলক্ষে করণীয় সম্পর্কে শ্রমিকদের নির্দেশনা দেন। যত্রতত্র গাড়ি না থামানো, নির্দিষ্ট স্টপেজে যাত্রী তোলা, এলোপাথাড়ি গাড়ি না রাখা, যাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণ না করা, বাড়তি ভাড়া আদায় না করাসহ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে পরিবহন শ্রমিকদের নির্দেশনা দেয়া হয়। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে কর্মরত ট্রাফিক বিভাগের লোকজন জানিয়েছেন, বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ, আসন্ন ঈদ ও বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, বাড়তি গাড়ির চাপ সব মিলিয়ে যানজটের মাত্রা আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। ট্রাফিক কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বছরের রমজান মাস আসলেই ঢাকার বাইরের শৌখিন অনেকেই রাজধানীতে কেনাকাটা করতে আসেন। এতে গাড়ি চাপ বাড়ে। তাছাড়া বাড়তি আয়ের আশায় শ্রমজীবী মানুষের ভিড় বাড়ে এ মাসেই। সব মিলিয়ে চলমান সঙ্কটের সঙ্গে বাড়তি চাপ তৈরি হয়। এতে ট্রাফিক পুলিশকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মৌচাকে কর্মরত একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর জানান, যানজট নিরসন করতেই মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়ক প্রকল্প হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা কি? প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে রাত অন্তত ১০টা পর্যন্ত কাকরাইল থেকে মগবাজার পর্যন্ত যানজট লেগেই আছে। তিনি বলেন, গণপরিবহনগুলো যাত্রী ওঠানোর অশুভ প্রতিযোগিতার কারণে উড়াল সড়ক ব্যবহার খুব একটা করে না। তাই যানজটের ভোগান্তি কমছে না। তিনি বলেন, যদি এই প্রকপ্ল বাস্তবায়ন না হলো তাহলে কি হতো? বলেন, প্রাইভেটকার ও বাস চালকদের বারবার বলা হলেও তারা কারো কথার পাত্তা দেয় না। কারণ উভয় সেক্টরই প্রভারশালী। আমরা জোর করেও উড়াল সড়ক ব্যবহার করাতে পারছি না। উল্টোপথে গাড়ি চলছেই ॥ এত অভিযানের পরও উল্টোপথে গাড়ি চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। পুলিশের অভিযানে গত দুই দিনে উল্টোপথে গাড়ি চলাচলের কারণে দুই হাজার ৭০০ মামলা হয়েছে। এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ৬ হাজার ৭৯৫টি মামলা ও ৩০ লাখ ৯৭ হাজার ৭২০ টাকা জরিমানা করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। এছাড়াও অভিযানকালে ৪৮টি গাড়ি ডাম্পিং ও ৭৪৩টি গাড়ি রেকার করা হয়েছে। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উল্লেখযোগ্য মামলার মধ্যে রয়েছে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করার দায়ে ১১৯টি, হুটার ও বিকন লাইট ব্যবহার করায় ২টি, উল্টোপথে গাড়ি চালানোর কারণে ১ হাজার ৬১৩টি, মাইক্রোবাসে কালো প্লাস লাগানোর জন্য ১৫টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা, ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণে ২ হাজার ৬৭৬টি মোটর সাইকেলের বিরুদ্ধে মামলা ও ৬৯টি মোটরসাইকেল আটক করা হয়। সেই সঙ্গে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করার অপরাধে চালকের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা করা হয়। ১৫ মে দিনভর ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ কর্তৃক অভিযান পরিচালনা করে এসব মামলা ও জরিমানা করা হয়। এদিকে ১৪ মে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ৬ হাজার ২৫টি মামলা ও ২৮ লাখ ৫ হাজার ৮০ টাকা জরিমানা করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। এছাড়াও অভিযানকালে ৭৪টি গাড়ি ডাম্পিং ও ৭২৮টি গাড়ি রেকার করা হয়েছে। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উল্লেখযোগ্য মামলার মধ্যে রয়েছে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করার দায়ে ৭৯টি, উল্টোপথে গাড়ি চালানোর কারণে ১ হাজার ১৬৯টি, মাইক্রোবাসে কালো গ্লাস লাগানোর জন্য ৯টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা, ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণে ২ হাজার ৪২৭টি মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে মামলা ও ৭৩টি মোটরসাইকেল আটক করা হয়। সেই সঙ্গে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করার অপরাধে চালকের বিরুদ্ধে ২২টি মামলা করা হয়। ২৯ দফায় যা আছে ॥ ডিএমপির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় ১৩০টি বাস স্টপেজ উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে; এরই মধ্যে বেশকিছু স্থানে অনস্ট্রিট পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরও নতুন নতুন জায়গা চিহ্নিত করে প্রয়োজনে ইজারার মাধ্যমে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে; পথচারীদের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার বন্ধে রোড ডিভাইডার উঁচু করতে হবে; পরিবহনগুলো নির্দিষ্ট স্টপেজে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়াবে, যাত্রীরা টিকেট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে উঠবে এবং চলন্ত অবস্থায় বাসগুলো দরজা বন্ধ করে চলাচল করবে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, সড়কে রোড মার্কিং মুছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা স্পষ্ট করতে হবে; ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে; এরই মধ্যে সরকারের অনুমোদন পাওয়া ট্রাফিক কারিগরি ইউনিটের জন্য জনবল যত দ্রুত সম্ভব নিয়োগ করে ইউনিটের কার্যক্রম শুরু করতে হবে; দেশে যানবাহনের তুলনায় দক্ষ চালকের সংখ্যা মাত্র অর্ধেক হওয়ায় সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দক্ষ চালক তৈরি করতে হবে; সিটি কর্পোরেশনের ফ্র্যাঞ্চাইজি বাস রুট বাস্তবায়নে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে; রাস্তার পাশে ১০তলা বা তারও কম তলা ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ট্রাফিক ক্লিয়ারেন্স নিতে হবে। মানসম্মত বাস দিয়ে যাত্রী সেবার মান বাড়ানোর পাশাপাশি রাজধানীর মিরপুর-নীলক্ষেত সড়ক, উত্তরা-কুড়িল-বাড্ডা-মতিঝিল, বিমানবন্দর-বনানী-মহাখালী-ফার্মগেট-বাংলামোটর-শাহবাগ-মতিঝিল, কাকরাইল-মগবাজার-মহাখালী সড়ক থেকে রিকশা তুলে দিয়ে তা গলিতে চলার ব্যবস্থা করা। যানজট নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট রঙের স্কুল বাস ব্যবস্থা চালু করতে হবে (শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এ উদ্যোগ নিতে পারে), রাজধানীতে যাত্রী পরিবহনের জন্য উবার ও পাঠাওয়ের মতো রাইড শেয়ারিং সেবায় যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সিলিং নির্ধারণ করতে হবে ও সিএনজিকেও এ্যাপের আওতায় আনতে হবে; পুশ বাটন চালু করার মাধ্যমে যাত্রী পারাপারের জন্য ডিএমপির পক্ষ থেকে সিটি কর্পোরেশনকে চিহ্নিত করা এলাকাগুলো বাস্তবায়নে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে; এলিভেটেট পার্কিং ব্যবস্থাপনা চালু করা যেতে পারে। এছাড়াও বিআরটিএর মাধ্যমে ড্রাইভিং ও যানবাহনের লাইসেন্সের হালনাগাদ তথ্য সরবরাহ করতে হবে; বিআরটিসির মাধ্যমে নতুন বাস দিয়ে ঢাকা মহানগরীর গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে, যেখানে ধানমন্ডি-নিউমার্কেট-আজিমপুর, মালিবাগ-খিলগাঁও-মতিঝিল, উত্তরা-মতিঝিল, উত্তরা-সায়েদাবাদ, উত্তরা-গুলশান চক্রাকার রুট, মিরপুর-ভুলতা, গাবতলী-আসাদগেট-সাইন্সল্যাব-শাহবাগ-পল্টন-গুলিস্তান-সদরঘাট ও উত্তরা-মহাখালী-মগবাজার-কাকরাইল-পল্টন মোড়-দৈনিক বাংলা-মতিঝিল রুটে এসি বাস চালু থাকবে; ঢাকা-গাজীপুর ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ঘন ঘন কমিউটার ট্রেন চালু করতে হবে; নির্মাণ সামগ্রীর অপ্রয়োজনীয় অংশ রাস্তা থেকে দ্রুত অপসারণ করতে হবে। ডিএমপির প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, রাজধানীর এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট হয়ে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত উড়াল সড়ক নির্মাণ ও রোড মার্কিংসহ আধুনিক করিডোর হিসেবে উন্নত করতে হবে; ঢাকা শহরের অধিকাংশ রাস্তা উত্তর-দক্ষিণ বরাবর হওয়ায় পূর্ব-পশ্চিম বরাবর রাস্তা চালু করে মানসম্মত পরিবহন নামাতে হবে; রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের মধ্যে নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে নীতি নির্ধারণ করতে হবে; সিগন্যালে স্টপ লাইন বরাবর গাড়ি দাঁড় করানোর পাশাপাশি জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পথচারী পারাপারে জোর দিতে হবে ও বামের লেন সবসময় ফাঁকা রাখতে হবে; পথচারী পারাপারে আন্ডারপাস ও ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারে প্রয়োজনে পুলিশ, স্কাউট সদস্য ও আনসার মোতায়েন রাখতে হবে; হর্নের ব্যবহার সীমিত করতে প্রয়োজনে হাইড্রলিক হর্ন আমদানি বন্ধ করতে হবে; মেট্রোরেলের কাজ চলাকালীন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন অনুযায়ী সমন্বয়ের মাধ্যমে করতে হবে। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন প্রস্তাবিত ইউলুপগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তাব দিয়ে বলা হয়, পথচারীদের লিফলেট, পোস্টার ইত্যাদি বিলির মধ্য দিয়ে ট্রাফিক সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে এবং আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং ব্যবস্থাগুলো যথাযথভাবে ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে।
×