ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চলন্ত বাসে নার্সকে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে মানববন্ধন

প্রকাশিত: ০৯:৪০, ১২ মে ২০১৯

 চলন্ত বাসে নার্সকে ধর্ষণ ও  হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে মানববন্ধন

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ কিশোরগঞ্জে চলন্ত বাসে ইবনে সিনা হাসপাতালের নার্স শাহীনূর আক্তার তানিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে শনিবার বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে বগুড়া, সিলেট, সাতক্ষীরা ও ময়মনসিংহ। খবর নিজস্ব সংবাদদাতা ও স্টাফ রিপোর্টারদের। পুলিশ বলছে, ঘটনার ক্লু পাওয়া গেছে। রিমান্ডে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদসহ পুরো বিষয়টি তদন্ত চলছে। আসামিরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পাশাপাশি এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের ধরতে বিভিন্নস্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে। আসামিদের দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে গাজীপুরের কাপাসিয়ার টোক নয়নবাজার বীর উজুলি গ্রামের ঈদগাহ মাঠে পরিত্যক্ত অবস্থায় তানিয়া ধর্ষণ ও হত্যাকা-ে ব্যবহৃত স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসটি উদ্ধার করেছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাজিতপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সারোয়ার জাহান শনিবার জানান, গ্রেফতারকৃতরা একেক সময় একেক ধরনের তথ্য দিচ্ছে। তবে তাদের দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। শুরুরদিকে তারা স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসটির নম্বর ঢাকা মেট্টো ব-১৪-৬২৮৫ জানিয়েছিল। পরে সেই বাসটি উদ্ধার করা হয়। কিন্তু বাসটিতে ঘটনার আলামত না পাওয়ায় পুলিশী জেরার মুখে আসামিরা জানায়, ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসটির নম্বর ছিল ঢাকা মেট্রো ব-১৫-৪২৭৪। পরে ওই বাসটিও উদ্ধার করে পুলিশ। জব্দ করা দু’টি বাসই বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে। অন্যদিকে নার্স তানিয়াকে ধর্ষণ শেষে হত্যাকান্ডে জড়িত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে জেলার বিভিন্নস্থানে প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। এসব কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ একাত্মতা প্রকাশসহ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এই হত্যা ও ধর্ষণ মামলার বিচারের দাবি জানিয়েছে। কিশোরগঞ্জ ॥ শনিবার দুপুরে শহরের আখড়াবাজার সেতু সংলগ্ন চত্বরে মানবাধিকার নাট্য পরিষদ আয়োজিত মানববন্ধনে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেন। এ সময় দ্রুত তানিয়ার হত্যাকারীদের শনাক্ত করে ফাঁসির দাবি এবং সামাজিক অবক্ষয় রোধে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা করেন জেলা বারের সিনিয়র আইনজীবী মোজাম্মেল হক খান রতন, এ্যাডভোকেট অশোক সরকার, মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান মুক্তু, মানবাধিকারকর্মী হারুন আল রশিদ, সাইদুর রহমান, আবৃত্তিকার ম.ম. জুয়েল প্রমুখ। বগুড়া ॥ কিশোরগঞ্জে চলন্ত বাসে নার্স শাহীনুরকে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে শনিবার বগুড়ায় বগুড়া নার্সিং কলেজ ও সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। এ সময় ধর্ষক-হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। সকালে বগুড়া নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভ মিছিল করে বাইপাস সড়কে মানববন্ধন করে। এতে বক্তব্য রাখেন,নার্সিং কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হেলাল উদ্দিন, প্রভাষক মঞ্জুর হোসেন, রশিদা বেগম আলো প্রদর্শক বাদশা মিয়া, রেহেনা পারভীন, নুরুন্নাহার খাতুন, ফরিদুল ইসলাম প্রমুখ। বক্তারা, ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনাসহ নার্সদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান। অপরদিকে একই দাবিতে দুপুরে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম বগুড়া জেলা শাখা শহরের সাতমাথায় মানববন্ধন করে। ময়মনসিংহ ॥ নার্স শাহীনুর আক্তার তানিয়াকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও বিচার দাবি করে ময়মনসিংহ মেডিক্যালের নার্সরা শনিবার মানববন্ধনসহ সমাবেশ করে। শনিবার সকালে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী ও বহির্বিভাগের সামনে আয়োজিত এই মানববন্ধন ও সমাবেশে বক্তারা স্পেশাল ট্রাইবুন্যাল করে ধর্ষকদের ফাঁসি দাবি করেন। কর্মসূচীতে বাংলাদেশ নার্সেস এ্যাসোসিয়েশন-ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল শাখা এবং স্টুডেন্টস ওয়েল ফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন-ময়মনসিংহ নার্সিং কলেজ শাখার নার্সরা যোগ দেন। সাতক্ষীরা ॥ শাহীনুর আক্তারকে ধর্ষণ ও হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন কর্মসূচী পালিত হয়েছে। সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আয়োজনে শনিবার বেলা ১২ টায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে এ মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে। এতে বক্তব্য রাখেন, সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নার্সিং সুপার ভাইজার অপর্ণা রানী পাল, নার্স অনন্যা ইসলাম, ফতেমা, রুনা লায়লা, শেফালী, রেবেকা সুলতানা প্রমুখ। সিলেট ॥ শাহীনুর আক্তারকে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ নার্সেস এ্যাসোসিয়েশন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ শাখা ও সিলেট নার্সিং কলেজ। শনিবার সকাল ১১টায় সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন মূল সড়কে এ মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তারা বলেন, নার্সিং পেশা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পেশা, এ পেশার বেশিরভাগই নারী। তাই এই পেশায় নিয়োজিত নার্সদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বক্তারা বলেন, এ্ই বর্বরতার সঙ্গে যুক্ত সকল অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সমাবেশ থেকে নারী নির্যাতক ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তানিয়ার ঘর বাধা হলো না ॥ মা হালিমা খাতুন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে তার চিকিৎসার সিংহভাগ টাকাই দেয়া হতো নিহত নার্স তানিয়ার বেতন থেকে। চিকিৎসায় পরিবারটি ৮/৯ লাখ টাকা ব্যয় করেও শেষ পর্যন্ত মাকে বাঁচাতে পারেনি। দীর্ঘদিন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে চার মাস আগে তার মা মারা যায়। এতে পরিবারটি ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তানিয়া ঢাকায় নার্সের চাকরি নিয়ে কল্যাণপুরে বড় ভাই কফিল উদ্দিন সুমনের সঙ্গে একই বাসায় থাকত। চার ভাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের রোজগার ও তানিয়ার বেতনের টাকা জমিয়ে বাড়িতে একটি আধাপাকা ঘর নির্মাণ করবে। পরে এক-দুই মাসের মধ্যেই তানিয়াকে জাঁকজমক করে বিয়ে দেবে। কিন্তু সে আশা ও স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে ঘাতকরা। শেষ পর্যন্ত কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী বাহেরচর গ্রামে মায়ের কবরের পাশে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করতে হয়েছে। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তানিয়া ছিল সবার ছোট। দুই বছর আগে ডিপ্লোমা নার্সিং শেষে ঢাকায় একটি হাসপাতালে নার্সের চাকরি নিয়েছিল। মায়ের শোক কাটতে না কাটতেই পুরো পরিবারকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে বর্বর ও নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হয়ে চিরবিদায় নিতে হয়েছে তানিয়াকে। এ শোক বইবার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছেন পিতা গিয়াস উদ্দিন এবং তানিয়ার ভাইবোনরা। নিহত তানিয়ার বাবা গিয়াস উদ্দিন বলেন, সংসারে তানিয়াই বিয়ে দেবার বাকি ছিল। তানিয়ার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। বাড়িতে একটি ঘর নির্মাণ করে তাকে শেষ বিয়েটি জাঁকজমক করে দেবে এটাই ছিল তানিয়ার ভাইবোনের স্বপ্ন। কিন্তু আমার সংসারের শেষ বিয়েটি দেখতে পারলাম না। এদিকে তানিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় বাজিতপুরের পিরিজপুর বাজারের ইজারাদার ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আসামি করায় সমালোচনা হচ্ছে। এলাকাবাসী বলছে, এটি নিছক ষড়যন্ত্র। মাদরাসা কমিটির নির্বাচন ও বাজারের ইজারাদারি পাওয়া নিয়ে বিরোধের সূত্র ধরেই চাঞ্চল্যকর মামলাটি রাজনীতিকরণ করা হয়েছে এবং মামুনকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। এতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সমালোচনা চলছে। ৬ মে রাতে ঢাকা থেকে স্বর্ণলতা পরিবহনের একটি বাসে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন উপজেলার লোহাজুড়ি বাহেরচর গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের মেয়ে ও ঢাকাস্থ ইবনে সিনা হাসপাতালের সিনিয়র নার্স শাহীনুর আক্তার তানিয়া (২৪)। বাসটি কটিয়াদী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার পর বাসের অন্য যাত্রীরা নেমে যান। পরে কটিয়াদী থেকে পিরিজপুর বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার পথে গজারিয়া বিলপাড় এলাকায় বাসের চালক ও সহকারীরা তানিয়ার ওপর পাশবিক নির্যাতন করে হত্যার পর মরদেহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমেপ্লক্সে রেখে পালিয়ে যায় তারা। এ ঘটনায় নিহতের বাবা বাদী হয়ে ওইদিন রাতেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বাজিতপুর থানায় মামলা করেন।
×