ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেশজুড়ে যানবাহন বাড়ছে, বাড়ছে জীবনের ঝুঁকি

প্রকাশিত: ১১:২০, ৭ মে ২০১৯

 দেশজুড়ে যানবাহন বাড়ছে, বাড়ছে জীবনের ঝুঁকি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাষ্ট্রীয় যানবাহন নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী ১০ বছরে রাজধানী ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ। নয় বছরে সারাদেশে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে আড়াইগুণের কিছু বেশি। এই সময়ে দেশে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মোটরবাইক। ঢাকার মোট যানবাহনের প্রায় অর্ধেকই ‘রাস্তার লাটভাই’ হিসেবে পরিচিত এসব বাইক। দেশজুড়ে মোট যানবাহনের চার ভাগের প্রায় তিন ভাগের কাছাকাছি মোটরবাইক চলছে। গত ৮ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মোট নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৩৯ লাখ ২৭ হাজার ৭০২। একই সময়ে রাজধানীতে নিবন্ধিত পরিবহনের সংখ্যা ১৪ লাখ ১০ হাজার ৫৬৭। সব মিলিয়ে পরিবহন যত বাড়ছে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝুঁকির মাত্রাও। বিআরটিএ কর্মকর্তাসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে রাস্তা অনুযায়ী সর্বোচ্চ তিন লাখ যান চলাচল করতে পারে। অপরিকল্পিত যানবাহনের নিবন্ধন দেয়ায় রাজধানীসহ সারাদেশে সড়ক-মহাসড়কে যানজট নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। তেমনি নানা উদ্যোগের পরও সড়ক দুর্ঘটনার রাশ টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত শহরে রাস্তা অনুযায়ী কত যানবাহন চলতে পারবে, সেই হিসাব করে নিবন্ধন দেয়া হয়। একটি গাড়ি নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত অন্যজন নতুন গাড়ি নামানোর অনুমতি পান না। কিন্তু আমাদের দেশে এ রকম কোন কিছুই দেখা যায় না। যে কেউ ইচ্ছা করলেই গাড়ি নামানোর সুযোগ পাচ্ছেন। দিব্যি পাচ্ছেন বিআরটিএর নিবন্ধনও। এই বাস্তবতা সামনে রেখে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘বিশ^ নিরাপদ সড়ক সপ্তাহ’ শুরু হয়েছে। বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। সোমবার সকালে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। কর্মসূচী ॥ জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব নিরাপদ সড়ক সপ্তাহ উপলক্ষে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীতে মানববন্ধন হয়েছে। ‘জীবন বাঁচান-আওয়াজ তুলুন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে সকালে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে এ মানববন্ধন আয়োজন করে সড়ক বিভাগ ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন। এ সময় সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। আমরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট, এককভাবে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে নয়। এজন্য মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, বিআরটিসি, পুলিশসহ সবার অংশগ্রহণ জরুরী। এছাড়া যার যেটা দায়িত্ব তা যদি সঠিকভাবে পালন করা হয় তাহলে দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব । তিনি বলেন, রাজধানীর সড়কগুলোতে শৃঙ্খলা ফেরাতে রুট ফ্রাঞ্চাইজির কাজ এগিয়ে চলছে। আমরা চাই না সারাদিন কোন দুর্ঘটনার খবর আসুক। কিন্তু বাস্তবতার হলো আমারা প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় হতাহতের খবরে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একই অনুষ্ঠানে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক নিরাপদ করতে সরকার, জনগণ সবাইকে সচেতন হতে হবে। ১০ বছরে তিনগুণ মোটরযান রাজধানীতে ॥ বিআরটিএ তথ্য অনুসারে ১০ বছরে রাজধানীতে মোটরযান বেড়েছে তিনগুণ। ২০০৯ পর্যন্ত রাজধানীতে মোটরযানের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখের বেশি। বিআরটিএ সূত্র জানায়, নিবন্ধিত যানবাহনের বাইরে আরও কয়েক লাখ যানবাহন ঢাকায় চলাচল করছে। এর বেশিরভাগই মোটরসাইকেল ও স্থানীয়ভাবে নির্মিত হিউম্যান হলার বা লেগুনাসহ ইজিবাইক। বিআরটিএ ২০ ধরনের যানবাহনের হিসাব সংরক্ষণ করে। এর মধ্যে কার, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল-এসইউভি (জিপ নামে পরিচিত) ও মাইক্রোবাসকে ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাস-ট্রাকসহ অন্য সব যানবাহন বাণিজ্যিক যানের আওতাভুক্ত। বিআরটিএ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীতে শুধু তিন লাখ গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক গাড়ি পার্কিং ও চলাচলের পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় ঢাকার যানজট দিন দিন বাড়ছে। জানা গেছে, ২০০৯ সাল পর্যন্ত নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ১৬ হাজার ৯১২। ২০১০ সালে ৭৬ হাজার ১৬৫ গাড়ি নিবন্ধিত হয়েছে। ২০১১ সালে নিবন্ধিত হয় ৭২ হাজার ৯৪৭, ২০১২ সালে ৫৯ হাজার ৫৭৩, ২০১৩ সালে ৫৪ হাজার ৪৯২, ২০১৪ সালে ৭৩ হাজার ৫১ নিবন্ধিত হয়েছে। ২০১৫ সালে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা হয় ৯ লাখ ৫ হাজার ৭৪২, ২০১৬ সালে ১ লাখ ১০ হাজার ৫২০, ২০১৭ সালে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৪৮, ২০১৮ সালে ১ লাখ ৭১ হাজার ৩৪৯ ও চলতি বছরের আট এপ্রিল পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছে ৪ হাজার ৬৭ যানবাহন। সব মিলিয়ে এখন ঢাকায় নিবন্ধিত পরিবহন ১৪ লাখ ১০ হাজার ৫৬৭। শহরের যানজট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক বলেন, রাজধানীতে বিআরটিএ যেভাবে গাড়ির নিবন্ধন দিয়েই যাচ্ছে তা অবৈজ্ঞানিক। ঢাকায় যত গাড়ি চলছে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এর মাধ্যমে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে কোন সমন্বয় থাকছে না, তাই যানজট বাড়ছেই। লোকজন ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে তখনই ছুটছেন যখন তারা গণপরিবহনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। গণপরিবহন উন্নত হলে ব্যক্তিগত গাড়ির এত চাহিদা থাকত না। এতে যানজট কিছুটা হলেও কমত। এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, এমন পরিস্থিতি থেকে একদিনে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। এর জন্য কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। বছরে কি পরিমাণ যোগান আছে সে অনুসারে গাড়ির নিবন্ধন করাতে হবে। যানবাহনের ঢালাও নিবন্ধন করতে দেয়া যাবে না। গণপরিবহনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সড়কে চলতে লোকজন যখন বিকল্প গণপরিবহন বা অন্যান্য যানবাহন পাবেন তখন গাড়ি কিনতে নিরুৎসাহিত হবেন। এ সম্পর্কে বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলেন, একটি শহরে যেখানে যানবাহনের চলাচল ও ব্যবস্থাপনার জন্য ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সড়ক দরকার সেখানে ঢাকায় আছে মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ। ফলে যানজট হবে এটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া বিভিন্নস্থানে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় লোকজন সড়কের ওপরই গাড়ি রাখছেন, যা যানজট বেড়ে যাওয়ার বড় একটি কারণ। নয় বছরে দেশজুড়ে পরিবহন বেড়েছে আড়াইগুণের বেশি ॥ গত নয় বছরের হিসাবে দেখো গেছে সারাদেশে পরিবহনের সংখ্যা বেড়ে আড়াইগুণের বেশি দাঁড়িয়েছে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ১৪ লাখ ৯৮ হাজার ২৪৪, ২০১১ সালে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে এক লাখ ৮৫ হাজার ৩৮৬টি। ২০১২ সালে নিবন্ধন দেয়া হয় এক লাখ ৬০ হাজার ৭০৫, ২০১৩ সালে ১ লাখ ৩৭ হাজার ১০৯, ২০১৪ সালে ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৩৯, ২০১৫ সালে ৩ লাখ ২১ হাজার ২১৫, ২০১৬ সালে ৪ লাখ ১৬ হাজার ৪১০, ২০১৭ সালে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৯৮, ২০১৮ সালে ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৩৭৪ গাড়ির নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। আর চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত নিবন্ধন হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি পরিবহন। সব মিলিয়ে মোট যানবাহন দাঁড়িয়েছে ৩৯ লাখ ২৭ হাজার ৭০২। সারাদেশে মোটরবাইকের সংখ্যা বেশি ॥ বিআরটিএর নিবন্ধিত যানবাহনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারাদেশে মোট যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ২৫ লাখ ৫৩ হাজার ৫০৯। এরপর অটোরিক্সা দুই লাখ ৭৪ হাজার ৮১২, বাস ৪৭ হাজারের কিছু বেশি। ঢাকায় নিবন্ধিত মোট যানবাহনের মধ্যে ছয় লাখ ৪০ হাজার ৩৯৬ মোটরসাইকেলের নিবন্ধন রয়েছে। প্রাইভেটকারের সংখ্যা ২ লাখ ৮০ হাজার ৭৬৮। বাস ও মিনিবাস মিলিয়ে নিবন্ধন রয়েছে প্রায় ৪৪ হাজার। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়কে জীবন বাঁচাতে আমি সচেতন, আপনি সচেতন হোন। জীবন একটাই। এ জীবনকে নিরাপদ রাখতে আপনার ভূমিকা থাকতে হবে। অন্যের কি দায় পড়েছে আপনার জীবন দেখে রাখার। আপনি যদি নিজে আপনার জীবনের প্রতি মায়া না করেন। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচতে হলে প্রথমে আপনাকে সাবধানে পথ চলতে হবে। আপনি সাবধান না হলে যে কোন মুহূর্তে বিপদে পড়তে পারেন। ইলিয়াস কাঞ্চন আরও বলেন, আমরা শুধু একে অন্যের দোষ খুঁজে বের করি। নিজেদের কি দোষ তা দেখি না। আসুন, নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো নিজেরা আগে সংশোধন করি। তাহলে অন্যরাও আপনার দেখাদেখি নিজেদের সংশোধন করে নেবে। দুর্ঘটনা রোধে জনমত গড়ে তুলতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
×