ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কিলিং মিশনে সরাসরি জড়িত পাঁচ আসামি ফের রিমান্ডে

প্রকাশিত: ১০:৪০, ৩ মে ২০১৯

 কিলিং মিশনে সরাসরি জড়িত পাঁচ আসামি ফের রিমান্ডে

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় কিলিং মিশনে সরাসরি জড়িত ৫ আসামিকে ফের রিমান্ড নিয়েছে পুলিশ। এদিকে এ হত্যার গাফিলতির কারণে ফেনী জেলার পুলিশের চার শীর্ষ কর্মকর্তা ও প্রশাসনের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এরা নুসরাত হত্যার ঘটনাটি ‘আত্মহত্যা’ বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন বলে পুলিশ সদর দফতরের তদন্ত রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, নুসরাত হত্যার ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে গাফিলতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। অন্যদিকে নুসরাত হত্যাকা-ে পুলিশের ভূমিকা যাচাই কমিটির প্রধানকে বদলি করা হয়েছে। ফেনী থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্য মামলার কিলিং মিশনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী ও হত্যার দায় স্বীকারকারী আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম ও জাবেদ হোসেনকে দুই দিন করে রিমান্ড নেয়া হয়েছে। এছাড়া একই সঙ্গে এ হামলার পরিকল্পনাকারী এমরান হোসেন মামুন, মহিউদ্দিন শাকিল ও ইফতেখার হোসেন রানার ৫ দিন করে রিমান্ড নিয়েছে পিআইবি। বৃহস্পতিবার দুপুরে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে এজাহারভুক্ত দুই আসামিসহ ৫ আসামিকে তোলা হয়। এ সময় পিবিআই ফেনী ইউনিট এজাহারভুক্ত আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম ও জাবেদ হোসেনের ৫ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। একই আদালতে এ মামলায় সন্দেহভাজন ও ১৬৪ ধারায় অন্যদের স্বীকারোক্তি পাওয়ার পর গ্রেফতারকৃত এমরান হোসেন মামুন, মহিউদ্দিন শাকিল ও ইফতেখার হোসেন রানার ৭ দিন করে রিমান্ড আবেদন করলে আদালত ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে। এরা এই হামলার পরিকল্পনাকারী। ঘটনা সময় তারা খুনের মিশন সফল করার জন্য মাদ্রাসার বিভিন্নস্থানে পাহারায় ছিলেন। এর আগে গত মঙ্গলবার এজাহারভুক্ত আসামি ও আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তি দেয়া শাহাদাত হোসেন শামীম ও জাবেদ হোসেনকে আদালতে তুলে পিবিআই ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত ২ মে রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করেছিল। পিবিআই সূত্র জানায়, গত ১৪ এপ্রিল আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম ও ২০ এপ্রিল জাবেদ হোসেন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছিল। সদর দফতরের তদন্ত কমিটিতে যা ছিল ॥ ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পিকেএম এনামুল করিম, এসপি এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, এডিশনাল এসপি রবিউল ইসলাম, সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোঃ ইকবালের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এর কারণ তাদের বিরুদ্ধেও দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ সদর দফতরের তদন্ত কমিটি। মঙ্গলবার রাতে পুলিশ সদর দফতরের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বুধবার (১ মে) পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এর আগে নুসরাত হত্যার রহস্য উদঘাটন ও পুলিশের দায়িত্বহীনতার বিষয়ে জানতে ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, সোনাগাজী থানা থেকে প্রত্যাহার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট ৫০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নুসরাত হত্যার তদন্তে গঠিত পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের উচ্চপর্যায়ের কমিটি। সদর দফতর সূত্র জানায়, সোনাগাজী থানার ওসিকে বাঁচাতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাটি ‘আত্মহত্যা’ বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন ফেনীর পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার। শুরু থেকেই এ ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল ফেনীর পুলিশ। মামলার এজাহার নিয়েও কূটচাল চালিয়েছিল। ঘটনার দিন (৬ এপ্রিল) পুলিশ সদর দফতরে মৌখিক মেসেজে এসপি এটাকে আত্মহত্যা বলে মেসেজ দিয়েছিলেন। লিখিত রিপোর্টেও তিনি একই কথা জানিয়েছিলেন। পুলিশ সদর দফতরের তদন্তে এসপি জাহাঙ্গীরের গাফিলতির প্রমাণ পান। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২৭ মার্চ নুসরাত জাহান রাফির যৌন হয়রানির ঘটনাকে সোনাগাজীর ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, সাজানো নাটক। ৬ এপ্রিল যখন নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়, ওই একই ওসি এটাকে বলেন আত্মহত্যার চেষ্টা। আর ফেনীর এসপি এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার নুসরাতকে রক্ষায় সময় না পেলেও ওসির পক্ষে সাফাই গাইতে সময়ের অভাব হয়নি। তিনি আর ওসি মিলেই হয়তো নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার মামলার এজাহারে নানা পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। অধ্যক্ষের নাম বাদ দেয়ারও চেষ্টা ছিল। ওসিকে বাঁচাতে এসপি ছিলেন মরিয়া। ওসিকে প্রত্যাহার করা হলেও এসপি তাতে নারাজ ছিলেন। তিনি বলেন, প্রত্যাহার নয়, বদলি। সূত্র জানায়, নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ফেনীর এসপি এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার ১১ এপ্রিল পুলিশ সদর দফতর, বিশেষ শাখা ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির দফতরে একটি চিঠি পাঠান। তিনি জানান, ঘটনার দিন নুসরাত মাদ্রাসায় যান। এরপর পরীক্ষা হলে তার আসনে ফাইলপত্র রেখে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদের ওপরে বাথরুমের কাছে যান। কিছুক্ষণ পর গায়ে আগুন লাগা অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে চিৎকার করতে করতে নেমে আসেন। তখন কেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ও মাদ্রাসার কর্মচারীরা আগুন নিভিয়ে ফেলেন। এই ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে পরিবারকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তারা মামলা করতে কালক্ষেপণ করেন। পুলিশ নুসরাতের চাচাকে বাদী করে মামলা করতে চায়। তাতে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান আপত্তি জানিয়েছিল। তারা দুইবার এজাহার বদল করেন। সূত্রগুলো জানায়, পুলিশ সদর দফতর গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এই ঘটনায় ফেনীর পুলিশের এডিশনাল এসপি রবিউল ইসলাম, এসআই ইকবালকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পিকেএম এনামুল করিমের বিরুদ্ধেও দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) রাতে পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট শাখায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন সদর দফতরের তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি প্রধান ডিআইজি রুহুল আমিন জানান, পুলিশের যা যা করার কথা ছিল সেটা ঠিকমতো করেছে কি না। সেটা পুলিশ ও নুসরাতের পরিবারসহ স্থানীয়দের জবানবন্দীতে খতিয়ে দেখা হয়েছে। ৩০ এপ্রিল সদর দফতরে বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। এই ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে, তাদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে আমরা সুপারিশ করেছি। নুসরাতের বাবা এমএ মুছা বলেন, একজন দুঃখী পিতা হিসেবে, নুসরাত হত্যায় দোষীরা কেউ ছাড় পাবে না’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই আশ্বাসের যথাযথ বাস্তবায়ন দেখতে চাই। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া ও অপরাধীদের রক্ষার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছিল ফেনীর ওইসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এরপরই অভিযোগটি খতিয়ে দেখতে ১৩ এপ্রিল পুলিশ সদর দফতরের উপ-মহাপরিদর্শক এসএম রুহুল আমিনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্য কমিটি করা হয়। কমিটি দুই দফা সরেজমিন এসে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে। এদিকে বুধবার মে দিবসের দিনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যার ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে গাফিলতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন। ওইদিন রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে লায়ন্স ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষে নুসরাত হত্যার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির প্রসঙ্গে তিনি একথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি ছিল কিনা তা তদন্ত করেছে পুলিশ। গাফিলতি থাকলে সফলতাও পুলিশের। পুরো রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। আবার গাফিলতিও বের করেছে পুলিশ। তাই সব মিলিয়ে পুলিশের সফলতাই বেশি বলে মনে করি। যার যার গাফিলতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। নুসরাত হত্যাকাণ্ড তদন্তে পুলিশের ভূমিকা যাচাই কমিটির প্রধানকে বদলি ॥ পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক (মিডিয়া এ্যান্ড পিআর) এস এম রুহুল আমিনকে বদলি করা হয়েছে। তিনি ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি খতিয়ে দেখতে গঠিত কমিটির প্রধান ছিলেন। গত ৩০ এপ্রিল ওই কমিটি ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম সরকার ও সোনাগাজী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনসহ চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করেছিল। তবে পুলিশ সদর দফতরের (মিডিয়া এ্যান্ড পিআর) সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা জানান, এস এম রুহুল আমিনের বদলি নিয়ে বিভ্রান্তির কোন অবকাশ নেই। তিনি ২৫ এপ্রিল উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদে মানবসম্পদ বিভাগে বদলি হয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে ৩০ এপ্রিল।
×