ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন জনপ্রিয় অভিনেতা টেলি সামাদ

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ৭ এপ্রিল ২০১৯

 চলে গেলেন জনপ্রিয়  অভিনেতা  টেলি  সামাদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রুপালি পর্দায় তিনি দর্শককে হাসিয়েছেন বারবার। দিয়েছেন নির্মল বিনোদন। কৌতুকমিশ্রিত অনন্য অভিনয়শৈলীতে দাগ কেটেছেন সিনেমাপ্রেমীদের হৃদয়ে। এবার দর্শককে হাসানো সেই প্রখ্যাত অভিনেতা কাঁদালেন সবাইকে। না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন কৌতুক অভিনেতা টেলি সামাদ। শনিবার দুপুরে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি হৃদরোগ, ব্লাড ক্যান্সার ও বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। গুণী এই অভিনেতা দুই স্ত্রী নিগার সুলতানা ও রেখা সামাদ, দুই মেয়ে সোহেলা সামাদ, সায়মা সামাদ ও ছেলে সুমন এবং দিগন্ত সামাদকে রেখে গিয়েছেন। রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজার মসজিদে শনিবার সন্ধ্যার পর টেলি সামাদের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। টেলি সামাদের ছেলে দিগন্ত সামাদ জানান, আজ রবিবার বেলা ১১টায় তার মরদেহ নেয়া হবে এফডিসিতে। সেখান থেকে থেকে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানেই বাবার দাফন সম্পন্ন হবে। মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জোহরের পর মা-বাবার কবরের পাশে দাফন করা হবে জনপ্রিয় অভিনেতা টেলি সামাদকে। চলচ্চিত্রের অত্যন্ত শক্তিশালী ও জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা টেলি সামাদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান তিনি। টেলি সামাদের মৃত্যুতে দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। প্রিয় এই মানুষটির মৃত্যু সংবাদ শুনে থমকে গিয়েছেন অনেকেই। চিত্র নায়ক রিয়াজ বলেন, অসম্ভব ভাল মানের একজন অভিনয় শিল্পী ছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে তিনি ভাল গায়ক ছিলেন, পেন্টার হিসেবে খুব ভাল ছবি আঁকতেন। আপাদমস্তক শিল্পী বলতে যা বোঝায়, টেলি সামাদ ভাই সেটাই ছিলেন। টেলি সামাদ আমাদের আইকন ছিলেন। তার সঙ্গে যে কয়টা সিনেমায় অভিনয় করেছি। প্রত্যেকটা ছবিতেই তার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কেউ তার শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে না। দীর্ঘ সময়ের বর্ণাঢ্য শিল্পী জীবন টেলি সামাদের। চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতা হিসেবেই জনপ্রিয়তা পান তিনি। ১৯৪৫ সালের ৮ জানুয়ারি বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন টেলি সামাদ। তিনি এক সময় বাংলা চলচ্চিত্রে রবিউল, খান জয়নুল, আশীষ কুমার লৌহ, আনিস, লালু, হাসমতের মতো গুণী কৌতুক অভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। বিটিভির ক্যামেরাম্যান মোস্তফা মামুন আবদুস সামাদ বাদ দিয়ে টেলি সামাদ নামটা দিয়েছিলেন। কাজী হায়াত পরিচালিত ‘মনা পাগলা’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তিনি। সত্তরের দশক থেকে তাকে পর্দায় দেখেছেন দর্শকরা। তার অভিনয় দর্শকদের মনে আজও গেঁথে আছে। নজরুল ইসলামের পরিচালনায় ১৯৭৩ সালের দিকে ‘কার বৌ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে এই অঙ্গনে পথচলা শুরু করেন তিনি। তবে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে তার অভিনীত ‘পায়ে চলার পথ’ ছবিটি। এরপর ছয় শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। অভিনয়ের বাইরে ৫০টির বেশি ছবিতে তিনি গান করেছেন। এক জীবনে অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করে টেলি সামাদ জয় করে নিয়েছেন এদেশের অসংখ্য সিনেমাপ্রেমীর হৃদয়। ১৯৭৩ সালে ‘কার বউ’ চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। ‘নয়নমনি’ ও ‘পায়ে চলার পথ’সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দর্শকপ্রিয়তা লাভ করেন। ‘মনা পাগলা’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি ৫০টির মতো চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন। অভিনয়জীবনে চার দশকে ৬০০’র মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান মোস্তফা মামুন তার ডাক নাম দিয়েছিলেন টেলি সামাদ। তারপর থেকে তিনি এ নামেই পরিচিত হন। ২০১৫ সালে তার অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘জিরো ডিগ্রী’ মুক্তি পায়। তার অভিনীত জনপ্রিয় সিনেমা হচ্ছে- জিরো ডিগ্রী (২০১৫), কুমারী মা (২০১৩), সাথী হারা নাগিন (২০১১), মায়ের চোখ (২০১০), আমার স্বপ্ন আমার সংসার (২০১০), রিকসাওয়ালার ছেলে (২০১০), মন বসে না পড়ার টেবিলে (২০০৯), কাজের মানুষ (২০০৯), মায়ের হাতে বেহেস্তের চাবি (২০০৯), কে আমি (২০০৯), কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩), মিস লোলিতা (১৯৮৫), নতুন বউ (১৯৮৩), মাটির ঘর (১৯৭৯), নাগরদোলা (১৯৭৯), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), অশিক্ষিত (১৯৭৮), জয় পরাজয় (১৯৭৬), গুন্ডা (১৯৭৬), সুজন সখী (১৯৭৫), চাষীর মেয়ে (১৯৭৫), রঙিন রূপবান, ভাত দে। কৌতুক অভিনয়কে ভালবেসে তিনি নেমে পড়েছিলেন অভিনয়ের আঙ্গিনাতেই। নানা মাধ্যমে অভিনয় করলেও চলচ্চিত্রের টেলি সামাদকেই মানুষ চিনেছে, ভাল বেসেছে। নানা রকম সিনেমায় চার চারটি দশক তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন অভিনয়ে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তিনি একজন হাসির ফেরিওয়ালা হয়ে হাসি বিলিয়েছেন মানুষের মনে অন্তরে। যিনি হাসান তিনি প্রিয়জন। সেই প্রিয়জনের বিরহে তো প্রাণ কাঁদবেই। টেলি সামাদকে হারিয়ে আজ কাঁদছে বাংলাদেশ; কাঁদছে এ দেশের চলচ্চিত্র।
×