ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথম শিশু প্রহরে খুদে পড়ুয়াদের পদচারণা

প্রকাশিত: ০৯:৩১, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

প্রথম শিশু প্রহরে খুদে পড়ুয়াদের পদচারণা

আশা ছিল সকাল থেকেই আসবে শিশুরা। খুদে পাঠকে গমগম করবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। তবে শনিবার মেলার দ্বিতীয় দিনেই প্রথম শিশুপ্রহর হওয়া তেমনটা হয়নি। কারণ সবে দাঁড়াতে শেখা শিশুর মতোই অবস্থা গ্রন্থমেলার। অনেকটা যেন ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে চলা। এমন প্রেক্ষাপটে প্রকাশকরাও ভাবেননি যে খুদে পাঠকে ভরপুর হবে প্রথম শিশুপ্রহর। তেমন জমে না উঠলেও একেবারে ম্লানও ছিল না প্রথম শিশুপ্রহরটি। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু চত্বরে স্নিগ্ধতা ছড়িয়েছে অল্প কিছু খুদে বইপড়ুয়া। এদিকে মেলার দ্বিতীয় দিনে খুলে গেছে সব স্টল। জ্বলেছে আলো সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে। আর তুমুল ভিড় না থাকলেও জড়তা কাটিয়ে শুরু হয়েছে পাঠকের আনাগোনা। সেই সুবাদে নান্দনিক স্টল বিন্যাসের মেলায় সূচনা হয়েছে বইয়ের অল্পস্বল্প বেচাবিক্রি। আসতে শুরু করেছে কৌতূহলী পাঠকরা। বই না কিনলেও ঢুঁ মারছেন স্টলে স্টলে। নেড়েচেড়ে দেখছেন নতুন আসা বইটি। পছন্দের বইটি আগামী দিনে সংগ্রহের পরিকল্পনার করছেন। অন্যদিকে দর্শনার্থী ও পাঠককে স্বস্তি দিয়ে দিয়েছে উদ্যান অংশের পরিচ্ছন্ন টয়লেট। এদিকে সকালে পানি ছিটানো হলেও প্রথম দিনের মতো দ্বিতীয় দিনেও বিকেলে মেলার আগন্তুকদের সইতে হয়েছে ধুলার উৎপাত। এছাড়া মেলার স্টলের অবস্থান ও নির্দেশনাসংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরার জন্য দোয়েল চত্বর ও টিএসসির ডিজিটাল মনিটর চালু হয়নি শনিবারও। এ বছর বারবার প্রশংসিত হচ্ছে স্টল নান্দনিক স্টল বিন্যাস। এ প্রসঙ্গে প্রকাশনা সংস্থা মাওলা ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী আহমেদ মাহমুদুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর তার পরিকল্পনার যথার্থ বাস্তবায়ন ঘটিয়ে আমাদের একটি মনের মতো মেলা উপহার দিয়েছেন। শুধু প্রকাশক নয়, পাঠককেও স্বাচ্ছন্দ্য দিচ্ছে মেলার সাজসজ্জা। প্রতিটি স্টলই দৃশ্যমান হয়েছে সুন্দরভাবে। প্রতিবন্ধকতা চত্বরে পাঠকরাও ঘুরছেন ফিরছেন বই দেখছেন মনের আনন্দ নিয়ে। এদিন মেলায় কবি ফরিদ কবির ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেমন কোন লেখকের দেখা মেলেনি। বিকেল গড়ানো সন্ধ্যায় উদ্যানের মেলা অংশে দেখা হয় নাট্যজন রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে বললেন, এবার মেলাটা বেশ গোছানো ও পরিপাটি মনে হচ্ছে। বিন্যাসটা সুন্দর হওয়ায় পাঠকেরা স্বাছন্দ্যে মেলায় ঘুরেফিরে বই কিনতে পারবেন। আলাপচারিতায় ফাঁকে এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জানান, এবারের মেলা আসছে তার প্রবন্ধের বই ‘বুদ্ধিজীবীর দায় ও অন্যান্য’। গ্রন্থটি প্রকাশ করবে প্রকাশনা সংস্থা কথাপ্রকাশ। শনিবার মেলার সূচনা হয় হয় বেলা এগারোটায়। সেই সঙ্গে শুরু হয় প্রথম শিশুপ্রহর। বেলা একটা পর্যন্ত দুই ঘণ্টাব্যাপী ছিলো শিশুপ্রহর। অভিভাবকদের সঙ্গে অল্পকিছু শিশু-কিশোর এসেছিল মেলা প্রাঙ্গণে। ঘুরাঘুরির পাশাপাশি তারা বই সংগ্রহ করেছে উদ্যানে শিশু চত্বর থেকে। এই চত্বরের ভেতর বটতলায় স্থাপন করা হয়েছে সিসিমপুর মঞ্চ। সেখানে সকালে দেখা গেছে শিশুদের প্রিয় টেলিভিশন কার্টুন চরিত্র সিসিমপুরের হালুম, টুকুটুকি, ইকরি ও সিকুকে। নেচে গেয়ে আর শিক্ষামূলক না কথা বলে তারা আনন্দ দিয়েছে খুদে দর্শনার্থীদের। মেলার প্রথম শিশুপ্রহরটি জমে না ওঠা প্রসঙ্গে শিশুতোষ বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা প্রগতি পাবলিশার্সের স্বত্বাধিকারী আসরার মাসুদ বলেন, শিশু প্রহরে আমাদের বেচাবিক্রি সবসময়ই ভালো হয়। তবে এবারে মেলার দ্বিতীয় দিন হওয়ায় সেভাবেই জমেনি। যদিও দ্বিতীয় দিনের বিবেচনায় একেবারে ম্লানও বলা যায় না। এবারের প্রগতি পাবলিশার্স থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের দুটি পপ আপ বই ‘নিশি কবরেজ’ ও ‘কোগ্রামের মধুপন্ডিত’ এসেছে। যার মধ্যে ‘নিশি কবরেজ’ বইটি খুললে আলোও জ্বলে উঠবে বলে জানান তিনি। তিনি আরও জানান, পপ বইয়ের পাশাপাশি শিশুদের জন্য গ্রাফিক নভেল ও হাইপার কমিকসও রয়েছে। শিশু চত্বরে না পড়লেও শিশুতোষ বইয়ের ভালো সংগ্রহ রয়েছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের প্যাভিলিয়নে। সেখানকার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইফতেখার আহমেদ জানান, আশানুরূপ না হলেও, বিক্রি খারাপ হয়নি। ভাল চলেছে মুনতাসীর মামুনের ‘রাজকন্যের জন্য’ ও ‘বেসিক আলী ১১’ বইগুলো। এদকে শনিবার ছিল প্রখ্যাত কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের ৮০তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘স্মৃতিকহন’। ৮০০ টাকা মূল্যের বইটিতে সংযুক্ত হয়েছে তার লেখা চারটি আত্মজীবনী ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’, ‘উঁকি দিকে দিগন্ত’, ‘এই পুরাতন আখরগুলি’ ও ‘দুয়ার হতে দূর’র সংকলিত হয়েছে। নতুন বইয়ের তথ্য : একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, শনিবার মেলায় নতুন বই এসেছে ৮১টি। এর মধ্যে গল্প ১০, উপন্যাস ২০, প্রবন্ধ ৭, কবিতা ১৪, গবেষণা ১, ছড়া ১, জীবনী ৩, রচনাবলী ৪, মুক্তিযুদ্ধ ৪, নাটক ১, বিজ্ঞান ৩, ভ্রমণ ২, ইতিহাস ৫, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ২ এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর বই এসেছে ৭টি। এগুলোর মধ্যে উৎস প্রকাশনী থেকে এসেছে মঈনুস সুলতানের ‘নিকারাগুয়ার পুরাতাত্ত্বিক নগরী ও নির্জন দ্বীপ’ ও মোস্তাফা সেলিমের ‘খবর নিশান’। সময় থেকে বেরিয়েছে আনিসুল হকের ‘দুষ্টু মেয়ের দল’ ও সুমন্ত আসলামের ‘অযান্ত্রিক’। আগামী থেকে বেরিয়েছে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সম্পাদিত মাহবুবুল হক শাকিল স্মারকগ্রন্থ। পুঁথিনিলয় থেকে বেরিয়েছে জাকির তালুকদারের ‘মুষ্টিবদ্ধ সেই হাত’। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে মুনতাসীর মামুনের ‘রাজকন্যের জন্য’। মেলা মঞ্চের আয়োজন : বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় বিজয় : ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক আলোচনাসভা। অনুষ্ঠান। এ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রাবন্ধিক ও গবেষক আবুল মোমেন। আলোচনায় অংশ নেন লেখক-সাংবাদিক হারুন হাবীব, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এমরান কবির চৌধুরী এবং গবেষক মোফাকখারুল ইকবাল। সভাপতিত্ব করেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। প্রাবন্ধিক বলেন, ভাষা আন্দোলন পূর্ববাংলার মানুষকে মুক্তি ও স্বাধীনতার দিশা দিয়েছে। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির লড়াই ক্রমশ পরিণত হয়েছে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতামুখী অনিবার্য সংগ্রামে। এ অঞ্চলের চিন্তানায়ক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের দীর্ঘ সংগ্রামের পরম্পরায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালীরা যে পথে নেমেছিল সে পথ ছিল বীরত্ব, ত্যাগ, সংগ্রাম ও বিজয়ের পথ। সে পথে শেষ গন্তব্যে পৌঁছেছি আমরা নয় মাসের দীর্ঘ সংগ্রাম, অসীম ত্যাগ ও বিপুল বীরত্বের বিনিময়ে। তখন ১৬ ডিসেম্বরের শীতবিকেলের সূর্য পশ্চিম দিগন্তে লালিমা ছড়াচ্ছিল, সে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল রমনার সবুজ চত্বর- আর সেই লাল-সবুজের অপরূপ আলোয় আমাদের বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ যেন বাংলার ও বঙ্গবন্ধুর জয়ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছিল। আলোচকবৃন্দ বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের মোহনায় পৌঁছুতে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত ভাষা-আন্দোলনবাহিত চেতনাই আমাদের ধারাবাহিকভাবে উপনীত করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের দুয়ারে। ভাষার সংগ্রাম আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে জাতিসত্তার আত্মপরিচয় অন্বেষণে। তবে এ পথের যাত্রা কুসমাস্তীর্ণ ছিল না মোটেও। নানামুখী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতি বায়ান্নকে সফল করে তুলেছে একাত্তরে। সভাপতির বক্তব্যে আহমদ রফিক বলেন, ভাষার সংগ্রাম মূলত স্বাধীনতার সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলন চেতনার যে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেছিল তারই বিচ্ছুরিত শিখায় আমরা আমাদের জাতিসত্তার স্বরূপ আবিষ্কার করেছি এবং আঁধার রাতের পরিধি ভেঙ্গে সম্ভব করেছি স্বাধীনতার সুবর্ণ সকাল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি আসাদ মান্নান এবং কবি হালিম আজাদ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ইস্তেকবাল হোসেন এবং লায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলী। সঙ্গীত পরিবেশন করেন তিমির নন্দী, শিবু রায়, রুমানা ইসলাম, আলম আরা মিনু ও শ্যামা সরকার। আজকের গ্রন্থমেলা : আজ রবিবার গ্রন্থমেলার তৃতীয় দিন। মেলা চলবে বিকেল তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত। বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সুবর্ণজয়ন্তী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন গোলাম কুদ্দুছ। আলোচনায় অংশ নেবেন রামেন্দু মজুমদার, মাহফুজা খানম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও আতিউর রহমান। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
×