ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভোরের চিক্চিকে রোদ্দুরে ঠোকাঠুকি, চলছে বইমেলার প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১০ জানুয়ারি ২০১৯

ভোরের চিক্চিকে রোদ্দুরে ঠোকাঠুকি, চলছে বইমেলার প্রস্তুতি

মনোয়ার হোসেন ॥ সকালের চিকচিকে রোদ্দুর ঝরে পড়ে বাংলা একাডেমির আঙিনায়। শীতের দিনে উষ্ণতা ছড়ানো সেই রোদের মাঝে চোখে পড়ে প্রাণজুড়ানো কর্মচাঞ্চল্য। বর্ধমান হাউসসংলগ্ন সবুজ প্রান্তরে শোনা যায় ঠুকঠাক শব্দ। করাতের ঘষাঘষিতে চৌচির হচ্ছে বাঁশের ফালি। কেউ বা আবার বাঁশের গায়ে ঠুকছে পেরেক। দড়ি দিয়ে জোড়া লাগানো হচ্ছে একটির সঙ্গে আরেকটি বাঁশ। নিচের কাঠামো তৈরি হলে ওপরে বিছিয়ে দেয়া হচ্ছে ত্রিপল কিংবা টিন। এভাবেই এগোচ্ছে সময়ের ব্যাপ্তিতে পৃথিবীর দীর্ঘতম বইমেলার সাজসজ্জার কাজ। একাডেমির চারপাশজুড়ে চলমান কর্মযজ্ঞ জানান দিচ্ছে, আসছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। চলছে সেই প্রাণের মেলার প্রস্তুতি। বইমেলার দুই ক্যানভাস বাংলা একাডেমি আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৩ লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে সজ্জিত হবে গ্রন্থমেলা। নবআঙ্গিকে গড়া এবারের মেলার প্রতিপাদ্য ‘বিজয় ৫২ থেকে ৭১ : নবপর্যায়’। বেশ কিছু নতুনত্ব যুক্ত হচ্ছে ১৯ সালের বইমেলায়। মেলার বিন্যাসে থাকছে ব্যাপক পরিবর্তন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভকে কেন্দ্র করে বিন্যস্ত হবে নক্সা। সে নক্সার মাঝে থাকবে বাঙালীর অহঙ্কার বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরা বিজয়ী জাতিসত্তার শিল্পিত ছোঁয়া। পাশাপাশি মেলার রূপকল্পে থাকবে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের বার্তা। নতুন ভাবনার অনুসারী এবারের বইমেলা নির্মিত হবে খ্যাতিমান স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝরের নক্সায়। লেখকের সঙ্গে পাঠকের সৌহার্দ্য বাড়াতে প্রথমবারের মতো মেলায় ঠাঁই পাবে ‘লেখক বলছি’ নামের মঞ্চ। প্রতিদিন পাঁচজন করে লেখক পাঠকের সামনে আসবেন নিজের নতুন বইটি নিয়ে। লেখক-পাঠকে হবে প্রাণবন্ত আলোচনায়। বইয়ের উপস্থাপনাসহ মেলার স্টল থেকে প্যাভিলিয়নের সাজসজ্জা হবে আগের চেয়ে আরও বেশি নান্দনিক। বইয়ের বিকিকিনির পাশাপাশি মেলার প্রতি প্রান্তেই দর্শনার্থীদের স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার বিষয়ে দেয়া হয়েছে বিশেষ মনোযোগ। একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী জনকণ্ঠকে বলেন, পাঠকসহ দর্শনার্থীদের এবার আমরা একটি পরিচ্ছন্ন মেলা উপহার দিতে চাই। মেলার বিন্যাসে দর্শনার্থীদের স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে। ভাল লেখকদের উৎসাহিত করতে পাঠকের সঙ্গে তাদের আলাপচারিতায় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মানসম্মত ফুড কোর্ট কিংবা টয়লেটসহ যেসব বিষয়ে অভিযোগ আছে সেসব সমস্যা দূর করতে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। মেলায় প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। এখন মানুষের হাতে হাতে এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন। সেই সুবাদে মেলাকে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের (জিপিএস) আওতায় আনা হবে। বইমেলায় ঢোকার পর পাঠক ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজের অবস্থান যেমন জানতে পারবে তেমনি তার পছন্দের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে কিভাবে পৌঁছবেন সে নির্দেশনাও পাবেন জিপিএস সিস্টেমের মাধ্যমে। এছাড়া ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের দিকে একটি প্রবেশপথ বাড়ানোর বিষয়ে কথা চলছে গণপূর্ত অধিদফতরের সঙ্গে। একুশে গ্রন্থমেলার নক্সা প্রসঙ্গে কথা হয় স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝরের সঙ্গে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের হাতে সময় খুব কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমরা একটি পরিচ্ছন্ন বইমেলা সাজাতে চাই। আমরা চাই, সবাই যেন স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে মেলায় ঘুরতে পারে। একটা সুন্দর পরিবেশ দেয়ার প্রয়াস নিয়েছি। আমূল বদলে দিতে না পারলেও এবারের বইমেলাকে নতুন চেহারা দেয়ার চেষ্টা করছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে বইমেলার মূল নক্সা। মেলা প্রসঙ্গে মঙ্গলবার কথা হয় গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. জালাল আহমেদের সঙ্গে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছরই একটু একটু করে বইমেলার সৌন্দর্য বাড়ছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার মেলার রূপসজ্জায় থাকবে ব্যাপক পরিবর্তন। জাতিগতভাবে বাঙালীর জীবনে দুটি বিশাল বিজয় আখ্যান রয়েছে। একটি হচ্ছে মাতৃভাষার লড়াই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, অপরটি দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এবারের মেলার নক্সায় থাকবে জাতিসত্তার অহঙ্কারের এই দুই বিজয়ের প্রতিচ্ছবি। একইসঙ্গে দুই বছর পর স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি এবং এক বছর পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদ্্যাপনের পূর্বাভাসও থাকবে মেলার সাজসজ্জায়। এভাবে মেলার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাগিয়ে তোলা হবে জাতির জনকের প্রতি ভালবাসা। প্রখ্যাত স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝরের নক্সায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত হবে বইমেলা। আগের মতো স্বাধীনতা স্তম্ভ আর মেলা প্রাঙ্গণের মাঝে থাকবে না কোন ব্যারিকেড। স্বাধীনতা স্তম্ভের গ্লাস টাওয়ারের আলোয় উদ্ভাসিত হবে মেলা প্রাঙ্গণ। লেখকের সঙ্গে পাঠকের সেতুবন্ধ স্থাপনে প্রথমবারের মতো যুক্ত হচ্ছে ‘লেখক বলছি’ শীর্ষক মঞ্চ। স্বাধীনতা স্তম্ভের সামনের এই মঞ্চ থেকে প্রতিদিন পাঁচজন লেখক মেলায় আসা নতুন বই নিয়ে কথা বলবেন। কোন দিন লেখক কথা বলবেন সেটা কমিটির মাধ্যমে আগের দিন নির্ধারিত হবে। এ আয়োজনে লেখকের নির্বাচিত বই সম্পর্কে প্রথমে দুই মিনিট কথা বলবেন একজন সঞ্চালক। এরপর বইটি নিয়ে লেখক কথা ৮ মিনিট। সব শেষে পাঠক ও দর্শনার্থীর সঙ্গে থাকবে লেখকের ১০ মিনিটের প্রশ্নোত্তর পর্বসহ আলোচনা। কমিটির মাধ্যমে মানসমৃদ্ধ বইয়ের লেখকরাই শুধু আমন্ত্রিত হবেন এ আয়োজনে। মেলার অন্যান্য বিষয়ে জালাল আহমেদ জানান, উদ্যানের শিশু কর্নারকে আরও আকর্ষণীয় আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হবে। আগের মতোই একাডেমির ভেতরে বহেরা তলায় থাকবে লিটল ম্যাগ চত্বর। গ্রন্থমেলার মূল দুটি প্রবেশপথ টিএসসি ও দোয়েল চত্বরে থাকবে মেলা সংক্রান্ত যাবতীয় নির্দেশিকা। দর্শনার্থীদের জন্য থাকবে পর্যাপ্ত বসার ব্যবস্থা। বইয়ের উপস্থাপনাসহ স্টল ও প্যাভিলিয়ন সজ্জা হবে আগের চেয়ে আরও আকর্ষণীয়। স্টল বিন্যাসের ক্ষেত্রে দর্শনার্থীদের স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। বৃদ্ধি করা হবে দর্শনার্থীদের বসার স্থান। নজর দেয়া হবে মানসম্মত খাবারের দোকানের বিষয়ে। পাশাপাশি থাকবে পরিচ্ছন্ন টয়লেট। বরাবরের মতো মেলায় আগত প্রতিবন্ধীদের জন্য থাকবে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা। একাডেমি সূত্র জানায়, গত নবেম্বর থেকেই শুরু হয়েছে মেলা গোছানোর কাজ। মেলায় স্টল পাওয়ার জন্য এ পর্যন্ত আবেদন করেছে ৭শ’ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ৫৫০ প্রতিষ্ঠানকে এক, দুই, তিন, চার ইউনিটের স্টলসহ প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হবে। আগামী ২১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে স্টল বরাদ্দের লটারি। এর মধ্যে ২৪ বাই ২৪ মাপের প্যাভিলিয়ন থাকছে দশটি আর ২০ বাই ২০ মাপের প্যাভিলিয়ন ১৩। চার ইউনিটের স্টল থাকবে ১৯, তিন ইউনিটের স্টল থাকবে ৩৩, দুই ইউনিটের স্টল থাকবে ৯৪ এবং এক ইউনিটের স্টল থাকবে ১১২। এর মধ্যে ১৯ নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রথমবারের মতো সুযোগ পাচ্ছে বইমেলায় অংশ নেয়ার। শিশু কর্নারের ৭৫ ইউনিটে ঠাঁই পাবে শিশু বিষয়ক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহ। যেসব প্রতিষ্ঠানের প্যাভিলিয়ন থাকবে সেগুলো হলো আগামী, অবসর, অনুপম, ঐতিহ্য, তাম্রলিপি, শোভা প্রকাশ, কথাপ্রকাশ, অনন্যা, অন্বেষা, পাঠক সমাবেশ, অন্য প্রকাশ, সময়, মাওলা ব্রাদার্স, কাকলী প্রকাশনী, বাংলা প্রকাশ, উৎস প্রকাশন, অনিন্দ্য প্রকাশ, নালন্দা, জার্নিম্যান বুকস, প্রথমা, পার্ল পাবলিকেশন্স ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ ও পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স।
×