ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের পাতায় চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দ প্রেমোপাখ্যান

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১ জানুয়ারি ২০১৯

ইতিহাসের পাতায় চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দ প্রেমোপাখ্যান

সঞ্জয় সরকার ॥ বাংলা ভাষার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী (১৫৫০-১৬০০)। তাঁর পিতা দ্বিজবংশী দাস ছিলেন ষোড়শ শতকের বিখ্যাত মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা। চন্দ্রবতীর মায়ের নাম সুলোচনা দাস। কালজয়ী এই মহিলা কবির জন্ম বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার নীলগঞ্জ স্টেশনের কাছাকাছি মাইজকাপন ইউনিয়নের পাতুয়াইর গ্রামে। একসময় এটি কাচারিপাড়া নামেও পরিচিত ছিল। চন্দ্রাবতীর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হচ্ছে- ‘দস্যু কেনারাম’ ও ‘মলুয়া’। এ দু’টি পালাকাব্যই ড. দীনেশ চন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’য় স্থান পেয়েছে। এছাড়া চন্দ্রাবতীর অসমাপ্ত রচনা ‘রামায়ন’ পালাকাব্যটি প্রকাশিত হয়েছে পূর্ববঙ্গ গীতিকায়। এদিকে চন্দ্রাবতীর নিজের জীবনকাহিনী নিয়েও রচিত হয়েছে আরেকটি বিখ্যাত পালাকাব্য- যার নাম ‘চন্দ্রাবতী’। নয়ানচাঁদ ঘোষ রচিত ওই পালাটিও ময়মনসিংহ গীতিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন। বাংলা সাহিত্যের আদি কবি হিসাবে চন্দ্রাবতীর নাম যেভাবে ইতিহাসে পাকপোক্ত স্থান করে নিয়েছে- তেমনি তার বাস্তব জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাঁথাও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষের মুখে মুখে ফিরে এসেছে। আর এসব কাহিনী কালের সাক্ষী হিসেবে আজও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে পাতুইয়ার গ্রামে দর্শনীয় পুরাকীর্তি হয়ে যা এখন- ‘চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির’। চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দ প্রেমোপাখ্যান ও মন্দিরের ইতিহাস ॥ সাহিত্যের প্রতি চন্দ্রাবতীর অনুরাগ ছিল কৈশোর কাল থেকে। পিতা দ্বিজবংশী দাসের মনসামঙ্গল রচনায় চন্দ্রাবতীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল। নয়ানচাঁদ ঘোষ রচিত ‘চন্দ্রাবতী’ পালা থেকে জানা যায়, তার জীবন-ইতিহাস বড়ই করুণ এবং বিয়োগান্তক। চন্দ্রাবতী একদিকে যেমন ছিলেন সাহিত্য প্রতিভাদীপ্ত- তেমনি ছিলেন পরমা সুন্দরী ও রোমান্টিক মনের অধিকারী। তার রূপ ও গুণে মুগ্ধ হয়ে অনেক সম্ভ্রান্ত যুবক তার পানিগ্রহণে ইচ্ছুক হয়ে ছিলেন। কিন্তু চন্দ্রাবতীর হৃদয়ের গহীনে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন জয়ানন্দ নামে সুন্ধা গ্রামের এক ব্রাহ্মণ যুবক। অনাথ জয়ানন্দ মাতুলালয়ে থাকতেন। শৈশব থেকেই তিনি চন্দ্রাবতীর খেলার সাথী ও সহপাঠী ছিলেন। কৈশোর উত্তীর্ণ হলে জয়ানন্দ-চন্দ্রাবতীর সম্পর্ক প্রেমে গড়ায়। চন্দ্রাবতী কাব্যে আছে- ‘‘ডাল যে নোয়াইয়া ধরে জয়ানন্দ সাথী। তুলিল মালতী ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী ।। একদিন তুলি ফুল মালা গাঁথি তায়। সেইত না মালা দিয়া নাগরে সাজায় ।।’’ দ্বিজবংশী দাস প্রথমে চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দের প্রেমের কাহিনী জানতেন না। জানার পর তিনি সানন্দে দু’জনের বিয়ের দিনক্ষণ স্থির করেন। আর তখনই ঘটে চন্দ্রাবতীর জীবনের সবচেয়ে নির্মম ঘটনাটি- যা তার জীবনের গতিপথকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। চন্দ্রাবতীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার পরও বিশ্বাসঘাতক জয়ানন্দ কমলা নামে অন্য এক মুসলিম নারীর প্রেমে আসক্ত হয়ে তাকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হন। চন্দ্রাবতী এ বিয়োগব্যথা মেনে নিতে পারলেন। তিনি মুষড়ে পড়লেন। বিরহ-অভিমানে স্থির করলেন আর কোনদিন বিয়ে করবেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন শুদ্ধাচারিণীর মতো শিবপূজায় মনোনিবেশ করে জীবন কাটিয়ে দেবেন। আর সে বাসনায় পিতার কাছে দুটি প্রার্থনা জানালেন। একটি ফুলেশ্বরী নদীর তীরে শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা ও অন্যটি চিরকুমারী থাকা। স্নেহময় পিতা দ্বিজবংশী দাস কন্যার একান্ত ইচ্ছায় তার দু’টি প্রার্থনাই মঞ্জুর করলেন। কবির ভাষায়ঃ ‘‘অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে শিব পূজা কর আর লেখ রামায়নে’’। দ্বিজবংশী দাস ফুলেশ্বরী নদীর তীরে অনন্য নির্মাণশৈলীতে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। চন্দ্রাবতী যৌবনে যোগিনী সাজলেন। সব ছেড়ে স্থান করে নিলেন মন্দিরে। সকাল-বিকাল শিব পূজা আর রামায়ন রচনায় মনোনিবেশ করলেন। এদিকে আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হতে থাকলেন জয়ানন্দ। একদিন সন্ধ্যায় চন্দ্রাবতী রামায়ন লিখছিলেন। অনুশোচনায় পীড়িত জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা করতে এলেন। কিন্তু অভিমানী চন্দ্রা মন্দিরের কপাট খুললেন না। বাইরে দাঁড়িয়ে শত অনুনয় বিনয়ের পরও ব্যর্থ হয়ে জয়ানন্দ মন্দিরের সামনে বেদিতে মালতী ফুলের রস দিয়ে চার ছত্রের একটি পদে চন্দ্রাবতী ও ধরাধামকে চিরবিদায় জানিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। এরপর গিয়ে ফুলেশ্বরীর জলে আত্মাহুতি দেন। কবির ভাষায় জয়ানন্দের কবিতাটি ছিল এরকম- “শৈশব কালের সঙ্গী তুমি যৈবন কালের সাথী। অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী ।। পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত। বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত।।” অনেক ক্ষণ পরে চন্দ্রাবতী মন্দিরের কপাট খুলে এ কবিতা দেখতে পান। তিনি বুঝতে পারেন জয়ানন্দের আগমনে দেবালয় অপবিত্র হয়েছে। তাই তার লেখা কবিতাটি ধুয়ে মুছে ফেলার জন্য কলসি কাঁখে নদীর ঘাটে জল আনতে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন ফুলেশ্বরীর জলে তার প্রেমিক জয়ানন্দের প্রাণহীন দেহ ভাসছে। এ দৃশ্য দেখার পর চন্দ্রাবতীর মনেও তীব্র অনুশোচনাবোধ জাগ্রত হলো। তিনি আর আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত চন্দ্রাবতী নিজেও ফুলেশ্বরীর জলে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে পরলোকে চিরমিলনের আশায় জয়ানন্দের অনুগামী হলেন। আবার কারো কারো মতে জয়ানন্দের মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পরেই অনুতপ্ত চন্দ্রাবতী স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। কালের বিবর্তনে এখন আর ফুলেশ্বরী নদীটির কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু শিবমন্দিরটি আজও চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দের অমর-বিরহী প্রেমের ট্র্যাজিডি বুকে ধারণ করে নিজস্ব মহিমায় মাথা উঁচু করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্তের দর্শনার্থীরা দেখতে আসেন মন্দিরটি। মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী ও বর্তমান অবস্থা ॥ চন্দ্রাবতীর মন্দিরের নির্মাণ শৈলীর শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য অনন্য। এর চারপাশই প্রচুর কারুকার্যময়। মন্দিরটির উচ্চতা ১১ মিটার। উঁচু ভিত্তির ওপর থেকে তিনটি ধাপে উর্ধগামী হয়ে সুচ্যগ্র শিখরে সমাপ্ত হয়েছে। মন্দিরের পুরো কাঠামোটি আট কোনাকৃতির। আটটি কোনার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য এক দশমিক সাত মিটার। নিচের ধাপটি এক কক্ষবিশিষ্ট। কক্ষে যাবার জন্য একটি দরজা রয়েছে। কক্ষের ভেতরে দিকে জানালার মতো ৫২ সে.মি, প্রস্থ এবং ৯৯ সে.মি দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট সাতটি কুলঙ্গি রয়েছে। প্রত্যেকটি ধাপের চারদিক প্রায় অর্ধ বৃত্তাকার খিলানের সাহায্যে নির্মিত। দ্বিতীয় ধাপটি নির্মাণ করা হয়েছে সরল রেখায়। প্রত্যেক ধাপের কার্নিশ পদ্মপাপড়িতে আবৃত। চূড়ার শেষ প্রান্তে রয়েছে খাঁজ কাটা কারুকাজ। এছাড়া কলসাকৃতির চূড়ার শীর্ষে আছে ‘ফাইনিয়েল’। মন্দিরের ভেতরে রয়েছে শিবমূর্তি। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এ মন্দিরে শিবপূজা অনুষ্ঠিত হয়। জানা গেছে, আগে মন্দিরের ভেতরে কষ্টিপাথরে নির্মিত একটি শিবমূর্তি ছিল। কয়েক বছর আগে সেটি চুরি হয়ে যায়। উল্লেখ্য চন্দ্রাবতীর মন্দিরের ঠিক পাশে একই ধরনের আরও একটি মন্দির আছে। সেটিও দ্বিজবংশী দাসই নির্মাণ করেছিলেন। তিনি সেখানে মনসার পূজা করতেন। বর্তমানে মন্দির দু’টি প্রত্নত্বত্ত বিভাগের আওতায়। নব্বইয়ের দশকে প্রত্নতত্ব বিভাগ চন্দ্রাবতীর মন্দিরটি সংস্কার করে। এতে কিছুটা সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে চন্দ্রাবতীর মন্দিরের পাশে একটি মঞ্চ নির্মাণ করা হয়। মঞ্চটির নাম ‘চন্দ্রাবতী মঞ্চ’। মাঝে মধ্যে ওই মঞ্চে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। এদিকে দ্বিজবংশী দাসের বাড়িটিও চন্দ্রাবতী মন্দিরের কাছেই। তবে ওই বাড়িটির প্রতি কারও নজর নেই। অযত্ন অবহেলায় ঐতিহাসিক বাড়িটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যেভাবে যাবেন ॥ চন্দ্রাবতীর মন্দির দেখতে হলে প্রথমে ঢাকার কমলাপুর থেকে ট্রেনে অথবা মহাখালী বা সায়েদাবাদ স্ট্যান্ড থেকে বাসে চড়ে কিশোরগঞ্জে যেতে হবে। কিশোরগঞ্জ থেকে সিএনজি, অটোরিক্সা বা রিক্সায় নীলগঞ্জ হয়ে পৌঁছতে হবে পাতুইয়ার গ্রামে। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে পাতুইয়ার গ্রামের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। কিশোরগঞ্জ সদরে থাকা-খাওয়ার মতো পর্যাপ্ত হোটেল-রেস্টুরেন্ট আছে।
×