ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বছরজুড়েই আলোচনায় ব্যাংকিং খাত

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮

বছরজুড়েই আলোচনায় ব্যাংকিং খাত

রহিম শেখ ॥ আমানত সঙ্কট, ঋণ কেলেঙ্কারি, সুদ হার কমিয়ে আনাসহ নানা কারণে বছরজুড়ে ব্যাংক খাত ছিল সমালোচনায়। এছাড়া বছরের শেষ ভাগে এসে নতুন দুটি ব্যাংক অনুমোদন ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা রক্ষায় ‘ঋণ পুনর্তফসিলে’র বিষয়টিও আলোচনায় ছিল ব্যাংকিং খাতে। ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারায় বেশির ভাগ ব্যাংকের আমানতে টান পড়ে। তাতে সঙ্কটে পড়ে পুরো ব্যাংক খাত। এ সঙ্কট চলাকালেই ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার নির্দেশনা আসে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। ব্যাংক পরিচালকেরা এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নানাবিধ সুবিধা আদায় করে নেন। এছাড়া এ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ জালিয়াতি ছিল আলোচনায়। ফলে চলতি বছরের নবেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। তাতে মোট খেলাপী ঋণ এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। বছরের একে বারে শেষ ভাগে এসে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে আলোচনায় আসে সেন্টার ফর পলিসি (সিপিডি)। এক সংলাপে সংস্থাটি জানায়, গত ১০ বছরে ব্যাংক খাত থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। যদিও তথ্যটি সঠিক নয় বলে দাবি করেন অর্থমন্ত্রী। একই সঙ্গে ব্যাংকের এমডিরাও বিষয়টি নিয়ে জানা গেছে, ফারমার্স ব্যাংক পুরো খাতে সঙ্কট তৈরি করার পর ব্যাংকটিকে বাঁচাতে সরকারের নির্দেশে এগিয়ে আসে রাষ্ট্র মালিকানাধীন চার ব্যাংক ও একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান। মূলধন সহায়তা ও বন্ড ক্রয়ের মাধ্যমে ব্যাংকটিকে অর্থ সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি পরিচালনারও দায়িত্ব নেয় তারা। বছরের শুরু থেকে নানামুখী সঙ্কটে পড়ে ব্যাংক খাত। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ঋণ আমানতের অনুপাত কমিয়ে দেয়। এ জন্য ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চাপ দেয়। এ নিয়ে দফায় দফায় পিছু হটে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। শেষ পর্যন্ত ঋণ আমানত অনুপাত সমন্বয়ের সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি আরও কিছু সুবিধা আদায় করে নেয় বিএবি। এ অবস্থায় এপ্রিলে ব্যাংক পরিচালকদের এক সভায় ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণার পর বিএবি আরও সুবিধা আদায়ে মাঠে নামে। সুদহার কমাতে নগদ জমার হার কমানো, সরকারী আমানতের অর্ধেক দাবি করে তারা। এ জন্য রাজধানীর একটি হোটেলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে একটি সভাও করেন বিএবি নেতারা। এতে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির। ওই সভাতেই বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নেয় বিএবি। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকের কর্পোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়ে দেয় সরকার। চার ধরনের বিশেষ সুবিধা দেয়া হয় ব্যাংক মালিকদের। ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির চাহিদা অনুযায়ী যেসব সুবিধা দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো সরকারী আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারী ব্যাংকে রাখা, সিআরআর এক শতাংশ কমানো, ঋণ আমানতের হার (এডিআর) সমন্বয়সীমার সময় বাড়ানো এবং রেপো রেট ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। এসব সুবিধা দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী পৃথক দুই অনুষ্ঠানে বলেছিলেন আপনাদের অনেক সুবিধা দিয়েছি, এবার ব্যাংক ঋণের সুদ হার কমান। তখন ব্যাংক মালিকরা কথাও দিয়েছিলেন। এরই অংশ হিসেবে গত ১ জুলাই থেকে ৯ শতাংশের বেশি সুদ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বেসরকারী ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স (বিএবি)। কিন্তু এরপরও কাক্সিক্ষত মাত্রায় সুদের হার কমিয়ে আনা হয়নি। এই অবস্থায় দেশের কার্যরত সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকগুলো ঘোষিত সুদ হার মানছে কিনা তা যাচাইয়ে পরিদর্শনে নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, অনেক চ্যালেঞ্জিং বছর ছিল। আমানতের সঙ্কট ছিল, খেলাপী ঋণও অনেক বেড়েছে। সামনের বছর প্রধান চ্যালেঞ্জ কী হবে, এ নিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের পরে প্রবৃদ্ধির গতির সঙ্গে ব্যবসাও ভাল হবে। তারল্য যোগান দিতে বন্ড মার্কেটের দিকে যেতে হবে। টাকাকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নিতে হবে। আর খেলাপী ঋণ আদায় হবে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এদিকে চলতি বছরে আলোচনায় ছিল জনতা ব্যাংকের এ্যাননটেক্স গ্রুপের সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনা। এ দুই বড় ঋণের বড় অংশই হয়ে পড়েছে খেলাপী। আগের বছরগুলোর মতো চলতি বছরেও ব্যাংক খাতে ঘটে যাওয়া নানা অনিয়ম, কেলেঙ্কারিসহ ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা নিয়ে বছরের শেষ সময়ে এসে এক সংলাপের আয়োজন করে সিপিডি। সংস্থাটি গত ১০ বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য তুলে। সংস্থাটির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে। সুশাসনের অভাবে বিভিন্নভাবে লুটপাট হওয়ায় পুরো আর্থিক খাতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরপর ব্যাংকিং খাত নিয়ে সিপিডির বক্তব্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) সম্প্রতি যে তথ্য প্রকাশ করেছে তা ঠিক নয়। এ নিয়ে ব্যাংক মালিক ও এমডিরাও তাদের প্রতিক্রিয়ায় জানান, গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতে অনেক সাফল্য আছে সেগুলো নিয়েও কথা বলা উচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, আর্থিক অনেক উন্নতি হলেও ব্যাংক খাত নাজুক হয়েছে। প্রভাবশালী ও বেসরকারী ব্যাংকের কিছু পরিচালকের কারণে এমন অবস্থা হয়েছে খাতটির। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতজানু অবস্থাও এ জন্য দায়ী। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীন রাখতে ভারতের গবর্নর পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশে এমনটি দেখা যায় না, সব মাথা পেতে নেয়। ব্যাংক খাতটি ঠিক করতে নতুন সরকারকে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। এদিকে বছরের শেষ সময়ে ব্যাংকিং খাতে আলোচনায় উঠে আসে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে প্রার্থীদের ঋণ পুনর্তফসিলের বিষয়টি। মূলত ‘ঋণখেলাপি’ তকমা থাকায় মনোনয়নপত্র বাতিলের হাত থেকে রক্ষা পেতে ঋণ পুনর্তফসিলের সুযোগ নিয়েছেন অনেকেই। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন পর্যন্ত ২২০ আবেদন অনুমোদন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া অনেক প্রার্থী খেলাপী ঋণের বিষয়টি গোপন করে মনোনয়নপত্র জমা দেন নির্বাচন অফিসে। এছাড়া বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে এসে নতুন দুটি ব্যাংক নীতিগত অনুমোদন দিয়ে আলোচনায় আসে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক দুটির মধ্যে একটির মালিকানা পেয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘কমিউনিটি ব্যাংক অব বাংলাদেশ’। অন্যটি বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ জসিম উদ্দিনের ‘বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড’। শেয়ারহোল্ডার পবিবর্তন ও কর সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তালিকায় থাকা আরও দুটি ব্যাংক বছরের শেষ সময়ে এসে অনুমোদন পায়নি। ব্যাংকগুলো হচ্ছে পিপলস ব্যাংক ও সিটিজেন ব্যাংক।
×