ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রতিবাদে দিনভর বিক্ষোভ

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১০ ডিসেম্বর ২০১৮

 মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রতিবাদে দিনভর বিক্ষোভ

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিতদের বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। আগের দিনের মতো রবিবারও দিনভর বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে দলের মনোনয়নবঞ্চিতদের কর্মী-সমর্থকরা সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ এনে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। এ সময় তাদের মুখে স্লোগান ছিল- ‘অবৈধ নমিনেশন মানি না মানি না’, ‘মনোনয়ন বাণিজ্য করেছে যারা সরকারের দালাল তারা’, অবিলম্বে প্রার্থী পরিবর্তন করতে হবে করতে হবে’। এ সময় ভেতর থেকে বার বার মাইকিং করে তাদের নিজে নিজ এলাকায় যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তবে এ আহ্বানের প্রতিবাদে এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা গুলশান কার্যালয়ের গেট ভাঙ্গার চেষ্টা করে। সন্ধ্যায় গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে মনোনয়নবঞ্চিতদের তোপের মুখে পড়েন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এ সময় তিনি বলেন, তিনি বিএনপির কেউ নন, মনোনয়ন দেয়াও তার বিষয় নয়। এদিকে ঝিনাইদহ-৩ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেলেও শেষ মুহূর্তে জামায়াতের চাপে তাকে পরিবর্তন করে জামায়াতের মতিয়ার রহমানকে আসনটি দিয়ে দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক কণ্ঠশিল্পী মনির খান। রবিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বিএনপি ছাড়ার ঘোষণা দেন। শেষ দিনে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে গিয়ে বিএনপির হ-য-ব-র-ল অবস্থা। মনোনয়নবঞ্চিতদের চাপের মুখে শেষ মুহূর্তে কিছু আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করেছে বিএনপি। আবার প্রার্থী পরিবর্তন করেও আবার বাতিল করে নতুন প্রার্থী দেয়া হয়েছে। যেমন রবিবার নতুন করে মনোনয়ন পান আগের দিন খালেদার গুলশান কার্যালয়ের দরজায় লাথি-ঘুষি মারা দলটির প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ারপুত্র ডাবলু। মানিকগঞ্জ-১ আসনে আগে এম এ জিন্নাহ কবিরকে দেয়া হলেও পরে চাপের মুখে ডাবলুকে মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আবারও ডাবলুকে বাদ দিয়ে আগের প্রার্থী বহাল রাখা হয়। এ ছাড়া শেরপুর-২ আসনে মোখলেছুর রহমান রিপনকে বাদ দিয়ে জাহেদ আলী চৌধুরী, ভোলা-১ আসনে বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থকে পরিবর্তন করে দেয়া হয় বিএনপির গোলাম নবী আলমগীর, সিরাজগঞ্জ-৬ আসনে কামরুদ্দিন ইয়াহিয়া খানকে বাদ দিয়ে ড. এম এ মুহিত, ঢাকা-১৪ আসনে আমিনুল ইসলামকে বাদ দিয়ে আবুবকর সিদ্দিক সাজু, চট্টগ্রাম-৮ আসনে মোর্শেদ খানের পরিবর্তে আবু সুফিয়ান, সাতক্ষীরা- আসনে জামায়াতের মুফতি রবিউল বাশারকে বাদ দিয়ে বিএনপির ড. শহীদুল আলমকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এ ছাড়া একাধিক প্রার্থীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত কুমিল্লা-৫ এ অধ্যক্ষ ইউনুসকে, কুমিল্লা-১০ এ মনিরুল হক চৌধুরীকে, ফেনী-১ আসনে রফিকুল ইসলাম মজনুকে, ঢাকা-৫ এ নবীউল্লাহ নবীকে, ঢাকা-১ এ আবু আশফাককে, সিলেট-৬ আসনে ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী ও ঢাকা-১৭ আসনে বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থকে মনোনয়ন দেয়া হয়। আগের দিন নড়াইল-১ ও ময়মনসিংহ-৩ আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করে বিএনপি। নড়াইল-১ আসনে আগে দেয়া হয়েছিল সাজ্জাদ হোসেনকে। পরে তার জায়গায় বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলমকে দেয়া হয়। আর ময়মনসিংহ-৩ আসনে আগে দেয়া হয়েছিল আহাম্মদ তায়েবুর রহমান হিরণকে। পরে তার জায়গায় এস এম ইকবাল হোসেনকে মনোনয়ন দেয়া হয়। শনিবার মধ্যরাতে মনোনয়ন বঞ্চিতদের হামলার শিকার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রবিবার গুলশান কার্যালয়ে যাননি। এ কারণে গুলশান কার্যালয়ে মনোনয়ন বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। তবে মির্জা ফখরুল উত্তরার বাসায় বসে দলীয় ক’জন প্রার্থীর মধ্যে মনোনয়ন বিতরণসহ প্রয়োজনীয় কাজ সেরেছেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানসহ কিছু নেতাকর্মী গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করলেও তারা ভেতর থেকে গেট বন্ধ করে রাখেন। গুলশান-২ নম্বরের ৮৬ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাড়ি অর্থাৎ খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের প্রধান ফটকে দায়িত্ব পালনরত নিরাপত্তাকর্মীরা জানিয়েছেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা শনিবার গভীর রাতে কার্যালয় থেকে বের হয়ে গেছেন। এরপর আর আসেননি। সকাল ১০টা থেকে মনোনয়নবঞ্চিত কুমিল্লা-৪ আসনের মনোনয়নবঞ্চিত সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী, মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের এম আবদুল্লাহ, ঢাকা-৬ আসনের ইঞ্জিনিয়ার ইশরাকের পক্ষে কয়েক শত কর্মী-সমর্থক বিক্ষোভ শুরু করে। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে সিনিয়র নেতাদের নামে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ আনে। সেই সঙ্গে অবিলম্বে মনোনয়নবঞ্চিত যোগ্য নেতাদের মনোনয়ন দেয়ার দাবি জানায়। কিন্তু তাদের দাবি অগ্রাহ্য করে বার বার গুলশান কার্যালয়ের ভেতর থেকে মাইকে বিক্ষোভকারীদের নিজ নিজ এলাকায় চলে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু যখনি এমন আহ্বান জানানো হয় তখনই বিক্ষোভকারীরা আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে হঠাৎ করে উত্তেজনা বেড়ে যায়। তারা খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের প্রধান গেট ফটক ভাঙ্গার চেষ্টা চালায়। এ সময় বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয় থেকে বিক্ষোভ না করার অনুরোধ জানিয়ে মাইকে বলা হয়, আজ অফিস বন্ধ। এতে আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয় বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভে অংশ নেয়া কুমিল্লা-৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী মঞ্জুরুল আহসান মুন্সীর সমর্থকরা মাথায় সাদা কাপড় পরে গুলশান কার্যালয়ের ভেতরে থাকা নেতাকর্মীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যদি মঞ্জুরুল আহসান মুন্সীকে মনোনয়ন না দেয়া হয় তাহলে তারা ১৫ দিনের জন্য অনশনে যাবেন। এ সময় কেউ কেউ বলেন, ‘আমরা গণহারে পদত্যাগ করব’। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা আরও বলেন, কুমিল্লা-৪ আসনে জেএসডির আবদুল মালেক রতনের সঙ্গে এলাকার মানুষের কোন সম্পর্ক নেই। তিনি ভোটকেন্দ্রে কোন এজেন্ট দিতে পারবেন না। আমরা তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলাম। তারা বলেন, মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী বিএনপির রাজনীতি করেন বলেই তার বিরুদ্ধে ২৯ মামলা। মঞ্জুরুল আহসান মুন্সীর পক্ষে বিক্ষোভকারী দলের কর্মী সোহরাব বলেন, মুন্সীভাই আমাদের দলের নেতা, কুমিল্লা-৪ আসন থেকে তিনি চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাকে বাদ দিয়ে যাকে দেয়া হয়েছে তিনি কখনই এলাকায় যান না। আমরা তাকে চিনি না, তাকে আমরা মানি না। অবৈধ নমিনেশন মানি না। মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের মনোনয়নবঞ্চিত এম আবদুল্লাহর সমর্থকরাও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বলেন, এম আবদুল্লাহর মনোনয়ন না নিয়ে তারা ফিরবেন না। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এম আবদুল্লাহর কর্মী-সমর্থকরা মাথায় সাদা কাপড়ের ব্যান্ড লাগিয়ে বিক্ষোভ গুলশান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। তারা চিৎকার করে বলতে থাকে আমরা আবদুল্লাহ ভাইকে চাই, অন্য কাউকে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে মেনে নেব না। এ আসনে ধানের শীষ প্রতীক পাওয়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে ভোটারদের সংযোগ নেই বলেও তারা জানান। বিক্ষোভে অংশ নেয়া ছাত্রদলের কর্মী হামিদ বলেন, শাহ মোয়াজ্জেম বড় নেতা। ওনার বয়স হয়ে গেছে। এলাকায় যান না। দুপুর ১টার দিকে ঢাকা-১ আসনের আবু আশফাক উদ্দিনের সমর্থকদেরও গুলশান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। তবে দেড়টার দিকে তার মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি দলীয় হাইকমান্ড থেকে নিশ্চিত করা হলে তার কর্মী-সমর্থকরা সেখান থেকে চলে যায়। উল্লেখ্য, শুক্রবার রাতে কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে গুলশান কার্যালয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও একপর্যায়ে মনোনয়ন না দেয়ায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে আবদুল হামিদ ডাবলু। তবে রবিবার তাকে মানিকগঞ্জ-১ আসনে মনোনয়ন দিলে তার সমর্থকরা আর বিক্ষোভ করেনি। এর আগে শনিবার সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চাঁদপুর-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলন, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকার ও গোপালগঞ্জ-১ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী সেলিমুজ্জামানসহ বেশ ক’জন মনোনয়নবঞ্চিত নেতার কর্মী-সমর্থকরা নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে এবং তালা ঝুলিয়ে দেয়। তারা শনিবার মধ্যরাতে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িতে হামলা করে। গাড়ি ভাংচুরের পাশাপাশি তারা এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে মির্জা ফখরুলকে অবরুদ্ধ করে রাখে। এদিকে রবিবার দুপুরে নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মনোনয়নবঞ্চিতদের বিক্ষোভের বিষয়ে জানতে চাইলে দলের মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, তাদেরকে শান্ত থাকতে এবং নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যেতে বলা হয়েছে। তবে দু’এক দিনের মধ্যে ক্ষোভের নিরসন হবে বলে আশা করছি।
×